অভিমত
জিআই পণ্যের তালিকায় ইলিশ : আসবে বিশেষ ব্যবস্থার সুফল
কোনো দেশের নির্দিষ্ট কোনো একটি পণ্য যখন ঐতিহ্যবাহী হয় তখন এটিকে সেই দেশের জন্য বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নিতে এর একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড প্যাটেন্ট দেওয়া হয়। এটিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষায় আন্তর্জাতিকভাবে জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য রয়েছে যেগুলো আগে কখনোই সঠিক উদ্যোগের অভাবে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার এ উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে প্রথম জিআই পণ্যের স্ট্যাটাসটি পেয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত জামদানি শাড়ি। আর দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে এ স্ট্যাটাসটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নির্ধারিত কিছু ধারাবাহিক পদ্ধতি সম্পন্ন শেষে ইলিশ মাছ সেই গৌরবজনক স্ট্যাটাসটি পেতে চলেছে, যার ফলে ইলিশ মাছকে বিশ্বে মানুষের কাছে আরো একটি লোভনীয় খাবারের আইটেম হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। আর এটি আমাদের দেশের জন্য বয়ে আনবে সম্মান। এভাবে দেশ-বিদেশে আরো ছড়িয়ে পড়বে ইলিশের সুনাম। সেজন্যই প্রয়োজন এ পণ্যটির আরো উৎপাদন বাড়ানোর। এ বছর (২০১৬) সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে। তার সুফল পেয়েছে সারাদেশবাসী। সেজন্য তারা কমদামে প্রচুর ইলিশ মাছ কিনে খেতে পেরেছে। মনে হচ্ছে ইলিশ যেন প্রকৃত অর্থেই জাতীয় মাছের আসল মর্যাদা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আবারও। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এর আগে ১৯৯৮ সালে এভাবে ইলিশ ধরা পড়েছিল বলে তথ্য দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। কারণ তখনপর্যন্ত নির্বিচারে এভাবে একদিকে ইলিশের বাচ্চা জাটকা এবং অপরদিকে ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা হতো না। তার সুফলই আসলে তখন পাওয়া যেত। এজন্য পরবর্তী সময়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে শুরু হয় জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষার বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ। কিন্তু তারপরও জেলেদের সামাল দিয়ে তা রক্ষা করা যাচ্ছিল না।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করা হতো। তারমধ্যে জাটকা নিধন রোধ, মা ইলিশ ধরা রোধ, কারেন্ট জাল বন্ধ করা, নির্দিষ্ট আকার ও আকৃতির ইলিশ মাছ ধরা রোধ করা, বিদেশে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাজে আসছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থান এবং ইলিশ ধরা জেলেদের পুনর্বাসনের কিছু কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এর আওতা সম্প্রসারণ করা হয়। সেখানে যত দিন জেলেরা ইলিশ মাছ ধরা থেকে বিরত থাকবে তত দিন সরকার থেকে তাদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করার কর্মসূচি নিয়েছে, যা ইতিমধ্যেই সফলতা দেখিয়েছে।
যখন গত বছর (২০১৫) পর্যন্ত দেখা গেল প্রজনন মৌসুমে ১৫ দিনের জন্য মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকার অব্যবহিত পরে মা ইলিশ ধরতে গিয়ে তখনো ইলিশের পেটে প্রচুর পরিমাণে ডিম ছিল। সেজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতে এ বছর তা ১৫ দিনের পরিবর্তে আরো একসপ্তাহ বাড়িয়ে ২২ দিন করা হয়েছিল। যা ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ২০১৬ তারিখ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ইলিশের প্রজনন মৌসুম সাধারণত আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার আগে-পরে কয়েকদিন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এবারও নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হওয়ার পর যখন মাছ ধরা হচ্ছিল তখনো অনেক ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা পড়তে দেখা গেছে। এতে করে নিষেধাজ্ঞার জন্য বর্তমানে নির্ধারিত ২২ দিন সময় নিয়ে আবারও চিন্তা-ভাবনা করার কথা উঠে এসেছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ আরো অনেকে বলেছেন, ‘ইলিশ মাছ সারা বছরই ডিম পাড়ে।
তবে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে সামনে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে’। সেজন্য তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন বর্তমানের ২২ দিন সময়ও নিষেধাজ্ঞার জন্য যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে আরো কার্যকর এবং পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় ২২ দিনের পরিবর্তে দেড় থেকে দুই মাস করলে সবচেয়ে ভালো ফল হয়। সেক্ষেত্রে আর কোনো সংশয় ও শঙ্কা থাকবে না। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের ইলিশের জেলেদের জন্য মানানোও খুবই সহজ। কারণ জেলেরাও এর সুফল পেয়েছে।
তারাও প্রয়োজনীয় ধৈর্য করতে রাজি আছে সরকারের গৃহীত জেলেবান্ধব পদক্ষেপের কারণে। মা ইলিশের পাশাপাশি রয়েছে জাটকা ইলিশ ধরার বিষয়টি। সেই কাজের অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত ঝাটকা নিধন বন্ধ থাকবে সেটি নিশ্চিত করতে পারলে ফলাফল ভালো হবে। এবার নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ মাছ ধরা-বিক্রি, পরিবহন বন্ধ থাকায় এত দিন ইলিশ মাছ খোলাবজারেও বিক্রি বন্ধ থাকায় মাছ হিমঘরে রেখে দিয়েছিল জেলেরা। এখন আবার তা বাজারে উঠছে। দাম এ সময়ে একটু বেশি হলেও মানুষের নাগালের বাইরে যায়নি। সবচেয়ে বড়কথা বাজারে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে থেকে পাওয়া তথ্যে, এবারে চার লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল, আর সবকিচু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর তা আরো বেড়ে সাড়ে চার লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্বে মিঠাপানির মৎস্য চাষে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। অপরদিকে মাছের ৯৫ ভাগ রোগ মুক্তির ওষুধ আবিষ্কার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী ড. লতিফুল বারী।
তিনি শামুক, ঝিনুক, ডিমের পরিত্যক্ত খোলস, সজনার বীজ, কচুরি পাতার মূল ও ধানের কুড়ার ছাই ইত্যাদি হতে প্রাপ্ত উদ্ভাবিত শেল বর্জ্য ব্যবহার করে কোনো রকম রাসায়নিক উপাদান ছাড়াই এ ওষুধ প্রস্ততের ফর্মূলা আবিষ্কার করেছেন। এগুলো দেশের চলমান মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন গতিধারাকে আরো বেগবান করে এ খাতের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখতে পারবে। এভাবেই ফিরে আসবে ইলিশের সুদিন এবং সার্বিক মাছে আরো স্বয়ংসম্পূর্ণতা। আর জিআই পণ্য হিসেবে ইলিশের অন্তর্ভুক্তি এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ বাংলাদেশের জাতীয় মাছটিকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়