শীতকাল
কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের পালাবদলে এখন চলছে হেমন্তকাল। এরই মধ্যে হেমন্তের শেষ মাসে পয়লা অগ্রহায়ণ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে বাঙালির আরেক চিরায়ত নতুন ধান কাটার অতিপরিচিত নবান্ন উৎসব। ঋতুপরিক্রমায় পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকাল। শীতকালটি ছয়টি ঋতুর মধ্যে দুই মাসের হলেও এর ব্যাপ্তি আগে-পরে আরো বিস্তৃত থাকে। স্থান ও সময়ভেদে শীতের তীব্রতা নির্ভর করে। কাজেই অগ্রহায়ণ থেকেই শীতের শুরু হয়ে তা ফাল্গুন মাসজুড়েও চলতে থাকে সারা বাংলায়। তারই ধারাবাহিকতায় অগ্রহায়ণ মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একদিকে নবান্ন উত্তোলন, অপরদিকে গ্রামবাংলায় শুরু হয় কিছুটা শীতের আমেজ।
শীতের আগমনী বার্তায় তাই সেই সময় প্রথমে শেষরাতের দিকে শীতের মাধ্যমে চলতে থাকে সব ধরনের মানুষের আনন্দ-বেদনার দিন গণনার পালা। রাতের আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে চাঁদের জোছনাকে কিছুটা ম্লান করে দিতে থাকে। শিশিরভেজা সকালে সবুজ ফসল ও ঘাসের পাতার অগ্রভাগে জমাকৃত কুয়াশার ফোঁটায় সকালের সূর্যের আরো বিচ্ছুরিত হয়ে অন্যরকম শীতের অনুভূতি জাগ্রত হয়। চারিদিকে কাঁচা ধানের নবান্নের বিভিন্ন বাহারি পিঠার গন্ধে হৃদয়-মন ভরে ওঠে। শীতের শুরুতে ঢাকার অদূরে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ হাওরাঞ্চলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। এলাকায় এলাকায় খেজুর ও তালের রসের জন্য গাছ কাটা শুরু হয়।
এখন শীত শুরু হয়েছে। সময় যতই গড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে, ততই শীতের এ তীব্রতা বাড়তে থাকবে দিনে দিনে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে দেখা যায়। সেই ফর্মুলা অনুযায়ী সমুদ্রতীরে শীতের তীব্রতা সবচেয়ে কম। সমুদ্র নিকটবর্তী স্থান থেকে যতই উত্তরের দিকে যাওয়া যায়, ততই শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকে। আর সেজন্য কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ সমুদ্রতীরবর্তী স্থানে এখন শীত নেই বললেই চলে। কিন্তু সে রকমভাবে মানুষের ঘনবসতি এবং কলকারখানা বেশি থাকার কারণে রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এবং উত্তরাঞ্চলে শীতের ভয়াবহতা বেশি হয়। শীতকে নিয়ে সুবিধা ও অসুবিধা দুই ধরনের কথাই রয়েছে। সচ্ছল ও ধনী পরিবারের মানুষের জন্য শীত একটি আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিবছর ফিরে আসে। কিন্তু অসচ্ছল ও প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অভিশাপ হিসেবে ফিরে আসে। সচ্ছল মানুষের শীতের পোশাক-আশাকের কোনো সমস্যা থাকে না। উপরন্তু তারা এ মৌসুমে আরো অনেক বাহারি পোশাক পরার সুযোগ পায়। কিন্তু অসচ্ছল মানুষের জন্য ন্যূনতম একটি কম্বল কিংবা কাঁথা বা শীতের কোনো কাপড়-চোপড় না থাকায় তারা বিপাকে পড়ে যায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের দিকে তাপমাত্রা অধিক হারে নিম্নমুখী হওয়ায় সে সময় এক বা একাধিক শৈত্যপ্রবাহে প্রান্তিক গ্রামীণ ও ছিন্নমূল মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। তবে এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত একটি পরামর্শ রয়েছে। দেখা গেছে, শীতের তীব্রতা শুরু হলে তখন সবাই মানবিকতা প্রদর্শন করে উদ্যোগ গ্রহণ শুরু করে।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। কারণ সেই সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করতে করতে শীত চলে যায়। যে কারণে এর সুফল ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ে পায় না। সে জন্য জানা কথা প্রতিবছর শীতকালে এক বা একাধিক শৈত্যপ্রবাহ আসেই এবং তখন শীতার্ত মানুষের খুব কষ্ট হয়। কাজেই শীত শুরুর আগে থেকেই এসব উদ্যোগ গ্রহণ করে নির্ধারিত এলাকার মানুষদের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাতে তাদের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে। কাজেই শীত সম্পর্কে এ প্রবাদটি শতভাগ সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, আর তা হলো ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’। শীতের সময় একটু সাবধানে থাকারও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ সে সময় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগীদের। কারণ এদের কেউই শীতের ঠান্ডাজনিত ধকল সহ্য করতে পারে না। সে জন্য এ সময় অনেকের অনেক মৌসুমি রোগ-বালাই আক্রমণ করে থাকে। তার মধ্যে ঋতু পরিবর্তন, অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা ওঠানামা করার কারণে অনেকেই ঠান্ডাজনিত রোগের মধ্যে পড়ে যান। তবে স্বাভাবিক চলাফেরা করা ও বাইরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য শীতের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ভালো। কারণ এ সময় প্রকৃতি অত্যন্ত শান্ত থাকে। থাকে না কোন ঝড়-বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
শীতের এ সময়টিকে পর্যটন সময়ও বলা হয়ে থাকে। এ সময় বাচ্চাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা শেষ হয়ে নতুন বছরের বই পাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায়। তখন লেখাপড়ার চাপ কম থাকার কারণে বাচ্চাদের নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো, গ্রামাঞ্চলে বেড়ানো এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য বেরিয়ে পড়া যায়। এভাবেই বাঙালি যার যার মতো করে তাদের শীতকে উপভোগ করে থাকে। সে জন্য বলা হয়, শীতের দিনে কষ্টের চেয়ে আনন্দই বেশি।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়