কখনো শেখা বন্ধ করো না : ক্লিন্ট ইস্টউড

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্লিন্ট ইস্টউড কোনো নাম নয়। একটি প্রতিষ্ঠান। সেই কবেকার আমল থেকে তিনি পর্দা কাঁপাচ্ছেন-ভাবলে কেবল বিস্ময় জাগে! দাঁতের গোড়ায় চুরুট আটকানো ঠান্ডা মেজাজের গানফাইটারের অ্যাকশন দেখে বড় হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শুধু বুড়ো হলেও বুড়িয়ে যাননি ক্লিন্ট, দিনদিন যেন আরো তরুণ হচ্ছেন। সমানতালে রয়েছেন অভিনয় আর পরিচালনায়। আজ (৩১ মে ২০১৫) পা দিলেন ৮৫-তে। ২০০৯ সালে এস্কোয়ারের জার্নালে প্রকাশিত এই লেখায় নিজেকে নিজের অতীত-বর্তমান হাতড়েছেন ক্লিন্ট। এই কিংবদন্তি অভিনেতার জন্মদিন উপলক্ষে সেই স্মৃতিচারণার সংক্ষেপিত ভাবান্তর।
আমি ক্লাসে সবচেয়ে লম্বা ছোঁকরা ছিলাম। আর আমরা সব সময় চরকির মতো ঘুরপাক খেতাম। রেডিং, সাক্রামেন্তো, প্যাসিফিক প্যালিসেডস, আবার ঘুরে সাক্রামেন্তো, হেওয়ার্ড, নাইলস, ওকল্যান্ড। সব সময় রাস্তাঘাটে দৌড়ে বেড়াতাম। আমি সব সময়ই ক্লাসের নতুন ছেলে হতাম। এদের যে ওই বয়সী সবাই কেমন খেপিয়ে তোলে তা তো জানার কথা! তেমনটাই হতো। সবাই ভাবত, এই লম্বা লম্বা ছোঁকরাটাকে পরখ করা দরকারি হয়ে পড়েছে। আমি খুব লাজুক টাইপের ছিলাম। তবু এসব খ্যাপানোর জবাব আমার কম দিতে হয়নি!
তখন গ্রেট ডিপ্রেশনের শুরুর দিককার সময়। চাকরিবাকরি নেই। টাকাপয়সারও অবস্থা খারাপ। সে সময় আমার বাবার দুই সন্তান। মানুষ তখন অনেক কঠিন আর কষ্টসহিষ্ণু ছিল।
হঠাৎ করেই ৬৩ বছর বয়সে আমার বাবা মারা গেলেন। এর অনেক পরে আমি ভেবেছি, আমি কেন তাকে আরেকটু বেশি সময় ধরে গলফ খেলতে বলিনি? কেন তার সাথে আরেকটু সময় কাটাইনি? কিন্তু আসলে এগুলোর জন্য কিছু করার নেই। এসব ভাবলে মন খারাপ হবে, কিন্তু আপনার আসলে কিছু করার নেই।
অভিনয়ের ব্যাপারটা ছিল এমন, তখন আমি কলেজে পড়ি। ১৯৫০ সাল, এলএ (লস অ্যাঞ্জেলেস) সিটি কলেজ। আমি এমন একটা লোককে চিনতাম যে বৃহস্পতিবারে অভিনয়ের ক্লাসে যেত। সে একদিন আমাকে ওখানকার সব সুন্দরী আর লাস্যময়ী তরুণীদের গল্প শোনাতে লাগল। তারপরে আমাকে বলল, ‘তুমি তো আমার সাথে গেলেই পারো’! আমিও ভাবলাম, তাই তো! কাজেই আমার মনে হয় অভিনেতা হওয়ার জন্য বেশ কিছু কারণ ছিল আমার! আর তার কথা আসলেই ঠিক ছিল। গিয়ে দেখলাম, সেখানে পুরুষ কম, আর ললনারা রয়েছে প্রচুর! আমিও ভাবলাম, ‘বটে, ওদের তো আমাকে অনেক বেশি বেশি দরকার’! এই তো শুরু, সেখান থেকে ইউনিভার্সেলে গিয়ে ঠেক দেওয়া!
দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ ওয়েস্টার্ন ছবি দেখতে ভালোবাসে। একজন লোক সবকিছুর বিরুদ্ধে একলা লড়ে বাজিমাত করে দিচ্ছে, এই ফ্যান্টাসিটা তারা ভালোবাসে। এই লোকটা মন্দ হলেও সমস্যা নেই। এখানে কোনো বাঁধাধরা আইন-টাইনের ব্যাপার নেই।
আগে আমি যেটা করতাম, প্রতিদিন যে কয়টা চিন-আপ (এক ধরনের ব্যায়াম) দিতাম, পরদিন তার একটা বেশি দিতাম। ও সময়টা পার হয়ে গেছে। এখন ওসব হয় না। বয়স হলে কোনো বিষয়েই আর দ্বিধা কাজ করে না। ভয়ও হয় না। আপনার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেলে লোকে আপনার কীই বা এমন ক্ষতি করতে পারবে?
কাউকে না কাউকে অবশ্যই ভালোমতো বুঝে উঠতে হবে, জানতে হবে। বন্ধু হতে হবে। আমার স্ত্রী আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। সব দিক থেকেই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট, তবে সেটা ছাড়িয়েও তার ব্যাপারটা আলাদা। আমার অন্য নারীর ঘরেও সন্তান রয়েছে। এদের সবাইকে এক জায়গায় করার জন্য আমি ডিনাকে (স্ত্রী) ধন্যবাদ দিতে বাধ্য। সে যে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী, এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো ইগো কাজ করে না। হয়তো সাধারণ প্রবৃত্তিতে এমন অবস্থায় সবাইকে একদম মেরেকেটে ফেলারও ইচ্ছা হতে পারে। কিন্তু সে তা করেনি, বরং সবাইকে এক করেছে। সে আমার প্রথম স্ত্রীর সাথে বন্ধুবৎসল, এমনকি আমার সাবেক প্রেমিকাদের সাথেও তার সদ্ভাব রয়েছে। আমার জীবনে তার প্রভাব বিশাল।
আমি ঠিক সঠিকভাবে ধর্ম পালনকারীদের দলে পড়ি না। তবে আমি একে অসম্মানও করি না। যে বিষয় নিয়ে আমার মধ্যে সংশয় রয়েছে, তা আমি কখনো অন্য কারো ওপর চাপানোর চেষ্টা করি না।
আসলে, একটা ভালো কৌতুক সব সময়েই ভালো কৌতুক। তবে সত্যি বলতে, আমার মুখে এখন আমার সন্তানেরাই কেবল হাসি ফোটাতে পারে। বয়স হলে শিশুদের আরো ভালো লাগে। শিশুরা আপনাকে শেখায় যে আপনার এখনো জীবনের থেকে চমৎকার কিছু পাওয়ার আছে। আপনি চাইলে এখনো জীবন থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবেন। এটাই আসলে জীবনের রহস্য, কখনো শেখা বন্ধ করো না। এটাই ক্যারিয়ারের সিক্রেট। আমি এখনো কাজ করে চলেছি, কারণ আমি মনে করি যে আরো কিছু জানার আছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। কখনোই এমন মনে করবে না যে তুমি সবই পেয়ে গেছ।
হুংকার দিয়ে ওঠার জন্য আমার কোনো অনুশীলন করতে হয় না। এমনিই হয়। একবার চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেলেই তো হলো। বসে বসে ঠায় এমন চিন্তা করার কোনো মানে নেই যে ‘ঠিক আছে, আমি এখন এভাবে চেঁচাব, আমি এখন ওভাবে চেঁচাব’! এ জন্যই আমি তেমন অনুশীলনের ধারকাছ দিয়ে যাই না। আমি ঝটপট শুট করি। আমি চরিত্রটাকে কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমার ঠিকমতো হিসাব থাকে, তবে সবশেষে এটাই সত্য যে দুটোই একসঙ্গে শেষ হয়ে যাবে। আমি এভাবেই বলি, ‘এতদূর এসে চিন্তা করে সব কিছু পণ্ড করো না।’