আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ফ্রয়েড ও মার্কসকে সমন্বয় করেছি লেখায়’

লেখালেখির শুরুতে আমি বিশ্বখ্যাত মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (৬ মে ১৮৫৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯) দ্বারা দারুণ রকম প্রভাবিত ছিলাম। আমার শুরু দিকে সবগুলো লেখাতেই কোনো না কোনোভাবে অস্ট্রীয় এ মনস্তাত্ত্বিকের ছাপ থাকত। ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ দিয়ে মানুষ ও সমাজকে বিশ্লেষণ করতাম আমি। কিন্তু সমাজের সবকিছুর সমাধান ফ্রয়েড দিতে পারেননি। তাই একটা সময় এসে আমি বাঁক বদল করতে বাধ্য হই। আমি তখন আশ্রয় নিই বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল হেইনরিশ মার্কসের (৫ মে ১৮১৮-১৪ মার্চ ১৮৮৩)। মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে আমি তখন লিখতে শুরু করি আমার পরবর্তী রচনাগুলো। তবে অনেকের মতে, আমি কখনো কখনো ফ্রয়েড ও মার্কসকে সমন্বয় করেছি আমার লেখায়। এটাও মিথ্যে নয়।
১৯৩১ সালের জুন মাসে (আষাঢ় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় আমার দুটি গল্প। এর মধ্যে বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকায় ‘মাটির সাকী’ ও টাঙ্গাইলের অগত্যা পত্রিকায় ‘বিড়ম্বনা’। ঠিক এ সময়টায় আমি বিজ্ঞান ও মানবমনস্তত্ত্ব বিষয়ে ব্যাপক অনুশীলনসহ দেশি-বিদেশি সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হয়ে উঠি। পাঠ্য বইয়ের প্রবল অবহেলা দেখা দেওয়ায় সেই বছর প্রথমবার বিএসসি পরীক্ষায় ফেল করি। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে (মাঘ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আমার ‘সর্পিল’ গল্পটি। মার্চ মাসে (চৈত্র ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় ‘ধাক্কা’ এবং প্রবাসী পত্রিকায় ‘যাত্রা’ নামে দুটি গল্প। জুন মাসে (আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) বিচিত্রায় মুদ্রিত হয় ‘জন্মের ইতিহাস’ এবং প্রবাসী’তে ‘ভূমিকম্প’। আগস্ট মাসে (ভাদ্র ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) গল্পলহরী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘শৈলজ শিলা’ গল্প। সেপ্টেম্বর মাসে (আশ্বিন ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) দীপক পত্রিকায় প্রকাশ পায় ‘মহাকালের জটার জট’, প্রবাসী’তে ‘পোড়াকপালী’। উত্তরা পত্রিকায় অক্টোবর মাসে (কার্তিক ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) মুদ্রিত হয় ‘তাঁতির বৌ’ এবং ডিসেম্বরে (পৌষ ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) ‘আইসিএস-এর বৌ’ গল্প।
এদিকে লেখালেখির পাশাপাশি আমি ওই সালই প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে বিএসসি ভর্তি হই সিটি কলেজে। সেখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অকৃতকার্য হই। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরিভাবে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত হই আমি। ১৯৩৩ সালে গল্পলহরীতে এপ্রিলে (বৈশাখ ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) ও জুনে (আষাঢ় ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ‘তফাৎ’ ও ‘গাঁদাফুলের বাগান’ নামে দুটি অনুগল্প। জুনে প্রবাসীতে ‘পোস্টাপিসের পিওন ও তার মেয়ে’, উত্তরা’য় জুলাইয়ে (শ্রাবণ ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) ‘কেরানীর বৌ’, সেপ্টেম্বরে (আশ্বিন ১৩৪০ বঙ্গাব্দ), ‘পূজারীর বৌ’ এবং নভেম্বরে (অগ্রহায়ণ ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) ‘রাজার বৌ’ গল্প প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত বঙ্গশ্রী পত্রিকায় সেপ্টেম্বর মাসে (আশ্বিন ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় ‘সরীসৃপ’ এবং কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা পূর্বাশা পত্রিকায় ‘চোর’ গল্প। ডিসেম্বর মাসে (পৌষ ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) ভারতবর্ষে ছাপা হয় গল্প ‘আত্মহত্যার অধিকার’।
১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। ভারতের মুঙ্গেরে শহরের ওপর বয়ে যায় প্রবল ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে শহরটি পরিণত হয় প্রায় ধ্বংসস্তূপে। এ খবর শোনা মাত্র আমি ছুটে যাই সেখানে। কারণ সে সময় আমার বাবাসহ পরিবারের অনেকেই তখন সেই শহরে অবস্থান করছিলেন। এই ভূমিকম্পের কবলে পড়ে আমার মেঝদা সন্তোষকুমারের এক মেয়ে নিহত হয়। আহত হয় পরিবারের আরো কয়েকজন। এ সময় চরম আর্থিক সংকটে পড়ে আমার পরিবার। সেই সংকট মোকাবিলার জন্য চরম অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি সে সময় কয়েক মাসের জন্য নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। চাকরিসূত্রে ওই সময় আমি থাকতাম কলকাতার দত্তবাগান এলাকার জীবনকৃষ্ণ মিত্র রোডের একটি ভাড়া বাসায়। সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে (ফাল্গুন ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) উত্তরা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’। মার্চে (চৈত্র ১৩৪০ বঙ্গাব্দ) পূর্বাশা পত্রিকায় ‘দুর্ঘটনা’, মে মাসে (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ) নারায়ণ পত্রিকায় ‘ভাঙা পুতুলের পা’ ‘চোখের জলের দাগ’ ও ‘কৌতূহল’ এবং কার্তিক ১৩৪১ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় ‘জীবিকা’ গল্প মুদ্রিত হয়। বঙ্গশ্রী পত্রিকায় এপ্রিল মাসে (বৈশাখ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় আমার বড় গল্প ‘একটি দিন’। পরবর্তী সময়ে এই গল্পটি ধারাবাহিক উপন্যাসে রূপ দেই আমি। ‘একটি সন্ধ্যা’, ‘একটি রাত্রি’ এবং শেষে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ শিরোনামে উপন্যাস আকারে ধারাবাহিক প্রকাশের মাধ্যমে ডিসেম্বর (পৌষ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ) সেটি শেষ হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে সেটিই ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নামে বের হয় উপন্যাস হিসেবে। এটি একটি রূপকধর্মী উপন্যাস। উপন্যাসের ভূমিকায় আমি লিখেছি, “দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর (১৩৪১) বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি। দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয়, বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নতুন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতকগুলো অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলোকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলো কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection- মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।”
একটি তথ্য এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এ উপন্যাসটির নামপত্রে বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছিলাম : (একটি বস্তু সংকেতের কল্পনামূলক কাহিনী)। তবে ‘অতসীমামী’ গল্পের মতো আমার প্রথম লেখা উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ রচনাটিকেও আমি রোমান্টিক বলে বাতিল করে দিতে চেয়েছি। আমার ভাষায়- “...পরেও কি রোমান্টিক কাহিনী আমি লিখিনি- কোমর বেঁধে যখন লিখতে আরম্ভ করেছি? লিখেছি বৈকি, দিবারাত্রির কাব্য তার চরম নিদর্শন।”
দিবারাত্রির কাব্য তিনটি ভাগে বিভক্ত : প্রথম ভাগে ‘দিনের কবিতা’ দ্বিতীয় ভাগে ‘রাতের কবিতা’ এবং তৃতীয় ভাগে ‘দিবারাত্রির কাব্য’। উপন্যাসের নায়ক হেরম্ব প্রতিটি ভাগেই উপস্থিত থাকে। এই হেরম্বকে ঘিরেই কাহিনী এগুতে থাকে। এ উপন্যাসটি মূলত কোনো কাহিনীনির্ভর রচনা নয়। কেন্দ্রীয় চরিত্র হেরম্ব তার পূর্বপরিচিত সুপ্রিয়ার সংসার দেখতে আসে পাঁচ বছর পর। একসময় সুপ্রিয়া ছিল হেমম্বের প্রেমিকা, এখন দারোগার স্ত্রী। আর একটি দিনের মধ্যে তাদের দুজনার সম্পর্কের নানা টানাপড়েন, জটিলতা, পারস্পরিক আসক্তি, অনাসক্তি এবং মনোজাগতিক নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ‘দিনের কবিতা’ অংশটি শেষ হয়। উপন্যাসটির প্রতিটি ভাগই কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে। কবিতাগুলো রূপকধর্মী। কবিতায় রূপকভাবেই বলা হয়েছে মূল বক্তব্য। যেমন : প্রথমভাগের ঘটনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে এবং হেরম্ব ও সুপ্রিয়ার জীবনের যে পরিণতি দেখা যায় তা ভূমিকা অংশের কবিতায় ‘মৃত মৌমাছি’, ‘শুষ্ক জীর্ণ তৃণ’, ‘মরীচিকা’, ‘বিশীর্ণ মরুতৃণ’, ‘পিঙ্গল সাহারা’, ‘ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক’ ইত্যাদি প্রতীকী রূপে উঠে আসে। সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপাইকুড়া গ্রামে (সুপ্রিয়ার স্বামীর আবাসস্থল) হেরম্বের পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘দিনের কবিতা’র অংশ। এই অংশের ব্যাপ্তি হলো রাত বারোটা থেকে পরের মধ্যরাত পর্যন্ত। এর মধ্যে বিসনা থেকে রূপাইকুড়া থানার সামনে আসতে আসতে রাত বারোটা হতে সকাল সাতটা বেজে যায়। মূলত বারো ঘণ্টার মধ্যবর্তী সময়ে ঘটা ঘটনা নিয়ে ‘দিনের কবিতা’। রূপাইকুড়াতে হেরম্ব এসে পৌঁছায় অত্যন্ত ক্লান্ত, অবসন্ন, রিক্ত ও শূন্য অবস্থায়। এরই মধ্যে হেরম্বের মা মারা যান এবং স্ত্রী উমা আত্মহত্যা করেন। কিন্তু সুপ্রিয়ার কাছে হেরম্বের এ আসা অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত ও আনন্দের। হেরম্বের এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর একপর্যায়ে রূপাইকুড়াতে এসে ঠেকলেও তার এ আসা সুপ্রিয়ার মধ্যে অনেক বেশি উত্তেজনা ও আগ্রহের জন্ম দেয়। স্বামী অশোকের অনুপস্থিতিতে সুপ্রিয়া তার একসময়কার ভালোলাগার মানুষটিকে নানাভাবে উদ্দীপিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু হেরম্ব থাকে নির্বিকার। সত্যিকার অর্থে হেরম্ব জানে না তার কী করতে হবে। এমনই একটি রহস্যময় চরিত্র হিসেবেই হেরম্ব উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে যায়।
‘দিনের কবিতা’ অংশে এক রূপক বিষয় হচ্ছে ‘রান্নাঘর’। এ শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত হয়েছে এবং ‘রান্না’ ও রান্না-বিষয়ক বিভিন্ন শব্দ এ অংশে ঘুরেফিরে বারবার এসেছে। কিশোর বয়স থেকেই সুপ্রিয়া ‘রহস্যময়’ পুরুষ হেরম্বকে ভালোবেসে আসছিল। কিন্তু হেরম্ব ‘ছেলেমানুষ’ সুপ্রিয়াকে ‘ভুলিয়ে ভালিয়ে’ বিয়ে দেয় দারোগা অশোকের সাথে। এ বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি সুপ্রিয়া। তবে বিয়ে যেহেতু হয়েই যায়, সেহেতু তা অস্বীকার করা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। এর ফলে বিয়ের পরে সুপ্রিয়া জীবনযাপনের চেয়ে বেঁচে থাকার দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। আর তারই অংশ হিসেবে সে বেছে নেয় ‘রান্নাঘর’কে। একাকিত্ব ও সংসারের জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে চলার জন্যই রান্নাঘরের প্রতি ভালোবাসা জন্মে সুপ্রিয়ার। উপন্যাসে আমি লিখেছে : ‘গৃহকর্মকে সে সত্য সত্যই এত ভালোবেসেছে যে, মাছের ঝোলের আলু কুটতে বসেই তার মনের আঘাত মিলিয়ে আসে।’
এ উপন্যাসটি নিয়ে প্রাবন্ধিক মো. আশরাফুল ইসলাম তাঁর ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ লেখাটিতে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- “উপন্যাসটির প্রথম ভাগে একটি বিষয়ই স্পষ্ট বোঝা যায়- যা সহজেই কাছে পাওয়া যায়, যাকে পেতে কোনো শ্রম ও চেষ্টার প্রয়োজন হয় না, তার প্রতি মানুষের প্রাপ্তির তীব্রতা, প্রাবল্য থাকে না। সুপ্রিয়ার প্রতি হেরম্বের দৃষ্টিকোণও তাই। হেরম্ব সুপ্রিয়াকে স্ফটিকস্বচ্ছতার মতোই জানে, হেরম্বের কাছে সুপ্রিয়া রহস্যময়, অস্পষ্ট কোনো নারী নয়- তাই সুপ্রিয়ার প্রতি হেরম্ব নির্মোহ, আকর্ষণহীন। হেরম্ব যে সুপ্রিয়ার চিন্তা-চেতনার জগতের সবকিছু গভীরভাবেই বুঝতে পারে তা তার কথাতেই স্পষ্ট : ‘ওই তোর প্রকৃতি। পনের বছর বয়সেই তুই একটু পেকে গিয়েছিলি, সুপ্রিয়া। বাইস-তেইস বছর বয়সে মেয়েরা সারা জীবনের একনিষ্ঠতা অর্জন করে, তোর মধ্যে সেটা পনের বছর বয়সে এসেছিল। তখনই তোর জীবনের দুটো পথ তুই একেবারে স্থির করে ফেলেছিলি।’
হেরম্ব ও সুপ্রিয়ার মধ্যে তাই প্রথম থেকেই হেরম্ব একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। ঔপন্যাসিক তাদের দূরত্বকে রূপকের সাহায্যে তুলে ধরেছেন। ‘উঠানে চনচনে রোদ’ সুপ্রিয়া ও হেরম্বের মধ্যে দূরত্বের রূপক হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম ভাগ তাদের দূরত্বের আভাসটি স্পষ্ট করেই সমাপ্ত হয়েছে। আর এ ভাগের শেষে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সুপ্রিয়া হেরম্বের বিপ্রতীপ, অব্যাখ্যাত, জটিল এবং অমীমাংসিত সম্পর্ক একটি অসাধারণ পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করে তা বুঝে নেওয়ার বা চিন্তা করার ভার পাঠক-মস্তিষ্কের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আর সে পরিপ্রেক্ষিত প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে নিম্নোক্তভাবে : ‘আকাশ মেঘে ঢাকা। ওদিকে বিদ্যুৎ চমকায়। শুকনো ঘাসে-ঢাকা মাঠে হেরম্ব আস্তে আস্তে পায়চারি করে। আজ রাত্রে যদি বৃষ্টি হয় কাল হয়তো মাঠের বিবর্ণ বিশীর্ণ তৃণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।’
প্রথম ভাগের শুরুর কবিতায় আমরা যে ‘বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণের’ কথা পেয়েছিলাম তা এ ভাগের অন্তিমে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার অপূর্ব অনিশ্চিত আশ্বাসের আভাস আছে।”
দ্বিতীয় পর্বটি ‘রাতের কবিতা’ও শুরু হয় একটি কবিতা দিয়ে। এই কবিতাও রূপক অর্থ বহন করেছে। এই অংশের ‘আনন্দ’ নামের নারী চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আনন্দ একরকম অজ্ঞাত, অস্পষ্ট এবং রহস্যময়। হেরম্বের কাছে তাই আনন্দ অনায়াসেই মোহ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এই পর্বে দিনের চেয়ে রাতের অন্ধকারেই ঘটনা সংঘটিত হয় বেশি। তা ছাড়া হেরম্ব ও আনন্দের মধ্যে এই ভাগে এসে প্রেম নিয়ে কথা হয় বিস্তর। আলোচনা, পর্যালোচনা, তর্ক চলে অনেক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যে যার বিশ্বাসে স্থির থাকে। আনন্দ নিজেকে রহস্যের জালের মধ্যে ঢেকে রাখে অনেকটা রাতের আঁধারের মতো করে। পর্ব শুরুর ভূমিকা-কবিতাটিতে ‘রাত্রি’ শব্দটি তিনবার ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন, আনন্দ এই ‘রাত্রি’ই প্রতীক।
আশরাফুল ইসলামের ভাষায়- “বাবা-মায়ের প্রণয়ঘটিত বিয়ের পরবর্তীকালে একটি বিচ্ছিন্ন-বিশৃঙ্খল ও ক্লেদাক্ত পরিবেশে বসবাস আনন্দের মন ও মানসিকতাকে বিব্রত, বিপর্যন্ত, অসহায় করে তুলেছে, আনন্দ তাই কামনা করেছে চিরায়ত অবিচ্ছেদ্য প্রেম। কিন্তু হেরম্ব এই চিরায়ত প্রেমের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। আনন্দ হেরম্বের আলোচনাতেও বারবার এ বিপরীতমুখী স্রোতে উঠে এসেছে :
আনন্দ বলল, ‘প্রেম কতদিন বাঁচে?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘কী করে বলব আনন্দ! দিন গুনে বলা যায় না। তবে বেশি দিন নয়। একদিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস।’
‘মোটে’
হেরম্ব আবার হেসে বলল, ‘মোটে হলো? এক মাসের বেশি প্রেম কারো সহ্য হয়? মরে যাবে আনন্দ- এক মাসের বেশি হৃদয়ে প্রেমকে পুষে রাখতে হলে মানুষ মরে যাবে। মানুষ একদিন কি দু’দিন মাতাল হয়ে থাকতে পারে। জলের সঙ্গে মদের যে সম্পর্ক মদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তাই- প্রেম এক তেজী নেশা।’
আনন্দের প্রেম নিবেদন হেরম্বের কাছে তাই উপেক্ষণীয়। ...অর্থাৎ একটি অস্পষ্ট, রহস্যময় ও দুষ্প্রাপ্যকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন সত্যিকার প্রেম। ‘দিনের কবিতা’য় সুপ্রিয়া ‘দিন’ আর ‘রাতের কবিতা’য় রহস্যময় অস্পষ্ট দুষ্প্রাপ্য আনন্দ ‘রাত’।”