শরৎচন্দ্রের সাহিত্য নিয়ে দুটি কথা

শরৎচন্দ্র ১৯৩৫ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডক্টরেট উপাধি গ্রহণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ স্যার জন এন্ডারসন শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার লেখার মধ্যে মুসলমান সমাজের পরিচয় হিন্দু সমাজের তুলনায় এত অল্প কেন? শরৎচন্দ্র অতি অল্প কথায় এর জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো মুসলমান চরিত্র আমার রচনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ শরৎচন্দ্র প্রতিশ্রুতি দেন, ভবিষ্যৎ উপন্যাসে তিনি মুসলমান সমাজ ও জীবনকে প্রধান্য দেবেন।
ঢাকায় অবস্থানকালে চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের আতিথ্য গ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। সেখান থেকে কিছুদিন রোগভোগ করার পর তিনি প্রথমে স্বগৃহে অতঃপর সেখান থেকে দেওঘরে বাড়ি পরিবর্তনের জন্য চলে যান। এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি তাঁর সুস্থ দেহে আরো বেশিদিন জীবিত থাকলে তাঁর প্রতিশ্রুতি কতটুকু পালন করতে পারতেন তা বিচার করে দেখা যেতে পারে। শরৎ কথাসাহিত্যে মুসলিম চরিত্র একটি প্রাধান্য লাভ করেছে। তা প্রায় একই স্তরের সমাজ থেকে এসেছে। একটি পল্লী সমাজের আকবর লাঠিয়াল, দ্বিতীয়টি মহেশ ছোট গল্পের গফুর। দুই-ই কৃষক সমাজের চরিত্র। তবে আকবর বীর, গফুর দরিদ্র, নীতিবোধ উভয়ের সমান।
বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি বিশিষ্ট ধর্মবোধ আছে। ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে কেউ কেউ অনুভব করেছে। এই সম্পর্কে দীনবন্ধু নীল দর্পণ নাটকের তোরাপের চরিত্র স্মরণ করা যেতে পারে। তোরাপ ও আকবর লাঠিয়ালের বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই। তোরাপ যে রকম বলে, ‘মুই নেমক হারামি করতে পারব না।’ আকবরও তেমনি বলে যে, ‘সব সইতে পারি কিন্তু বেঈমানি সইতে পারিনি’। আকবর লাঠিয়ালের এই বিষয়ক দৃঢ়তা দেখে বেনি গোপাল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শরতের এই চেতনায় বাংলার মুসলমান সমাজের একটি সত্য জীবন চেতনা ছিল। সেই জন্য পল্লী সমাজের মধ্যে একটি সামান্য চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও আকবর লাঠিয়াল শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। মহেশ গল্পের গফুর ও তার কন্যা আমেনার চরিত্র তাদের জীবনের একান্ত দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করেছে বলে তাদের মধ্যদিয়ে কোনো চরিত্রে-শক্তির বিকাশ সম্ভব হয়ে উঠেনি। অত্যাচারীর হাত থেকে এরা ক্রমাগত পীড়নই লাভ করেছে তাদের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করবার কোনো শক্তিই তাদের ছিল না, সে পথে তারা অগ্রসরও হয়নি। কিন্তু এই অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যেও অসহায় অবলা জীবের প্রতি তাদের একান্ত আত্মীয়তাবোধ এই কাহিনীটির মধ্যে এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি করেছে।
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আকবর কিংবা গফুর এদের চরিত্রের পরিকল্পনা যতই সার্থক এবং সহানুভূতিপূর্ণ হোক, এদের ভেতর দিয়ে বাংলার বৃহত্তর মুসলমান সমাজের সামগ্রিক পরিচয়ের একাংশ প্রকাশ পেতে পারেনি। মুসলমান বলেই যে গফুর এই অত্যাচারের ভাগী হয়েছে তা নয়, সে দরিদ্র ও অসহায় বলেই তার ওপর অত্যাচার এত কঠিন হয়ে উঠেছে। এমন কি, অসহায় দরিদ্র হিন্দু নীচু জাতির ওপরও সমাজের এমনই অত্যাচার দেখতে পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্রের 'অভাগীর স্বর্গ' ইত্যাদির মধ্যেও তার পরিচয় আছে। সুতরাং গফুর মুসলমান সমাজের সূত্রে এই কাহিনীতে আসেনি- অসহায়, দরিদ্র ও অত্যাচারিতের প্রতীকরূপেই সে এখানে এসেছে।
বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমাজ এ দেশের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রকে যতখানি শ্রদ্ধা করে, আর কাউকে ততে শ্রদ্ধা করে না। তথাপি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের একটি উক্তি তাদের আঘাত করেছে। তাঁর 'শ্রীকান্ত' প্রথম পর্বের শ্রীকান্তের একটি উক্তি। তার কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের যেদিন প্রথম পরিচয় হয়, সেদিন শরৎচন্দ্র শ্রীকান্তের জবানীতে লিখেছেন, বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে একটা ফুটবল ম্যাচ ছিল। এই উক্তি থেকে আপাত দৃষ্টিতে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মুসলমান বাঙালি নহে, তাহারা মুসলমান মাত্র, অন্তত শরৎচন্দ্রের তাই বিশ্বাস। কিন্তু শরৎচন্দ্র যে এই অর্থে কথাটি ব্যবহার করেননি, তা আমারা সবাই না জানলেও অনেকেই জানি। এখানে শরৎচন্দ্র ভাগলপুরের উল্লেখ করেছেন। সেখানকার বাঙালিরা বাংলা ভাষাভাষী হলেও মুসলমানরা হিন্দি ও উর্দু ভাষাভাষী। বাঙালি ও মুসলমান ছাত্র অর্থে তিনি বাংলা ভাষাভাষী ও হিন্দি বা উর্দু ভাষাভাষী ছাত্রই মনে করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাইরের বাঙালি ও অবাঙালি সমাজ সম্পর্কে যাঁদের কিছুমাত্রও জ্ঞান আছে, তাঁরা জানেন যে, এর ভেতর দিয়ে শরৎচন্দ্র বাঙালি মুসলমানকে লক্ষ্য করেননি। কিন্তু পূর্ববাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকের সঙ্গেই বাংলার বাইরের মুসলমানদের বিশেষ কোনো যোগ নেই, তবে দেশ বিভাগের পর ইদানীং সে যোগ কিছু সৃষ্টি হওয়ার ফলে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এই ভুল ধারণা কতকটা দূর হওয়ার সুযোগ দেখা দিয়েছে।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মধ্যে নারী-চরিত্রই প্রধান্য লাভ করেছে। একমাত্র মহেশ ছোটগল্পের আমিনা চরিত্র ছাড়া শরৎচন্দ্র মুসলমান সমাজের নারী-চরিত্রের আর কোনো পরিচয় দিতে পারেননি। কিন্তু আমিনা কতটুকু চরিত্র? এ যে উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়, তা সবাই স্বীকার করবে। বাংলার মুসলমান সমাজের স্ত্রী চরিত্র সম্পর্কে শরৎচন্দ্র সে পথে অগ্রসর হলেও তাঁকে একান্তভাবে কল্পনাকে আশ্রয় করতে হতো। শরৎচন্দ্রের পক্ষে তার ফল যে সার্থক হতো না, তা বলাই বাহুল্য। মুসলমান সমাজে স্ত্রী-স্বাধীনতা ও স্ত্রীসমাজ যেভাবে পর্দার অন্তরালে জীবনযাপন করে সেখানে কোনো ঔপন্যাসিকের পক্ষে প্রত্যক্ষ দৃষ্টি বিস্তার করা অসম্ভব। অথচ জীবনের জটিলতায় তথা ঔপন্যাসিক উপাদানের দিক থেকে তার মধ্যে কিছু অভাব আছে, তা বলা যায় না।
১৯৩৭ সাল। প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন শরৎচন্দ্র। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন-চার মাস কাটিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এই সময় তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা ছড়িয়ে পড়ে তাঁর পাকস্থলী পর্যন্ত। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তাঁর অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪নং ভিক্টোরিয়া টেরাসের পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি শল্যচিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু চার দিন পরে অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অপরাজেয় এ কথাশিল্পী।