ঘাসান জাক্তান-বন্দনা

আল কারমেল। আরবি ভাষায় একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পত্রিকা। পাক্ষিক এ পত্রিকা প্রায় দুই দশক ধরে সম্পাদনা করেছেন দিকপাল ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ (১৯৪২-২০০৮)। এ পত্রিকার একই বছরের দুটি সংখ্যায় দারবিশ ছেপেছিলেন অনুজ ঘাসান জাক্তানের দীর্ঘ কবিতা, যার নাম বাংলা করলে হবে ‘একাকী নদীর ধারে’ এবং সমগ্র কবিতা সিরিজ ‘অজুহাত’। বলতে হয়, দারবিশই দীর্ঘ কবিতাটির নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন। প্রাচীন আর আধুনিক কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক সংমিশ্রণে কাহিনী ও কাব্যের মিশ্রণে নতুন ভাষা নির্মাণ অন্বেষণের মধ্য দিয়ে ঘাসানের অসামান্য কবিতা জায়গা করে নিয়েছে সমসময়ের আরবি ও ফিলিস্তিনি কবিতার ভুবনে। তিনি সমসময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিনি কবি। তাঁর ঝুলিতে আছে প্রায় ১০টি কাব্যগ্রন্থ। কবিতা ছাড়াও তিনি উপন্যাস ও নাটক লিখেছেন। নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র।
ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সমর্থক ঘাসান প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সাহিত্য পত্রিকা ‘বাইয়াদের’ সম্পাদনা করেছেন। কবিতাপত্র ‘আল সুয়ারা’ এবং রামাল্লাহ দৈনিক আল আইয়াম-এর সাহিত্য সাময়িকীও সম্পাদনা করেছেন। ফিলিস্তিনের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাহিত্য ও প্রকাশনা বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৩ সালে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ঘাসানকে আরবি ও ফিলিস্তিনি সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য সম্মানসূচক জাতীয় পদকে ভূষিত করেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিউস্টাড আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত ছোট তালিকায় তাঁর নাম আছে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়সহ আরো কয়েকটি ভাষায় তাঁর কবিতা তর্জমা হয়েছে।
কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষের পরিচিতি ও অস্তিত্ব ফিরে ফিরে খোঁজা ঘাসানের কাছে ব্যক্তি ও সামষ্টিক মানুষের স্মৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামষ্টিক আবহে ব্যক্তিমানুষের পরিচয়ের খণ্ডাংশ জড়ো করেন ঘাসান তাঁর কবিতায়। ছুড়ে দেন শিকড়হীন অস্তিত্বের প্রশ্নাবলি। স্পর্শগ্রাহ্য দৈনন্দিন জীবনের ওপর আলো ফেলে ঘাসান কবিতা সাজান। মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা তিনি তুলে নিয়ে আসেন কবিতায়। একটা গোটা জনপদ হারিয়ে ফেলেছে তাঁর ভবিষ্যৎ, তাঁর অবস্থান, তাঁর ভিটে। ঘাসানের মতে, এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভাবদ্যোতক মাধ্যম হলো কবিতা। আর কবির কাজ, লেখকের কাজ উত্তর খোঁজা নয়; তাঁদের কাজ অনবরত প্রশ্ন তোলা।
ঘাসানের জন্ম ১৯৫৪ সালে, বেথলেহেমের কাছে, বেইত জালায়। ১৯৪৮ সালে তাঁর পরিবারকে জাকারিয়া গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্রপন্থীরা। পড়ালেখা করেছেন জর্দানে, এর পর বৈরুত, দামাস্কাস ও তিউনিসে ছিলেন। ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন ১৯৯৪ সালে। থাকেন পশ্চিমতীরের রামাল্লায়। বাবা খলিল জাক্তানও কবি ছিলেন। বাবার মৃত্যু তাঁর জীবনে একটি বিশাল ঘটনা। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : পাহাড়ের টান (১৯৯৮), কাঠকয়লায় জীবনী (২০০৩) এবং খড়ের পাখির মতো আমার পিছু নেয় (২০০৮)। যার নামটি না নিলেই নয়, তিনি হলেন আরব-আমেরিকান কবি ফাদি জুদাহ, ঘাসান জাক্তানের রচনার ইংরেজি অনুবাদক। বাবাকে নিয়ে ঘাসানের লেখা একটি কবিতার (১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বস্তুর বীরত্ব নামক বইয়ে অন্তর্ভুক্ত) কয়েকটি চরণের তর্জমা এ রকম :
‘আর তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া না-থাকা বাড়িটাকে আমি কুড়িয়ে নেবো।
যেন আমরা দুনিয়ায় একা
...তুমি মারা গেলে
যাতে আমি বাজপাখিটা চলে গেলে পর ওর পাখাকে ভাঁজ করতে পারি
আর বিশ্বাস করতে পারি
পড়ে থাকা নীরবতাকে।’
‘কালো ঘোড়া’ নামের কবিতাটির শেষ স্তবকটি এ রকম :
‘যুদ্ধে সবাই মারা গেছে, আমার বন্ধু আর ইশকুলের সতীর্থরা...
আর তাদের ছোট ছোট পা, তাদের উত্তেজিত হাত, পড়ে ছিল
পদদলিত হয়ে ক্লাসরুমের মেঝে, খাবার টেবিল আর ফুটপাতে,
পথচারীদের পশ্চাদভাগ আর কাঁধ...
আমি যেখানেই যাই
আমি শুনি তাদেরকে
আমি দেখি তাদেরকে।’