ক্রাইসিস : সংকট উত্তরণের গল্প

কথাসাহিত্যিক অরুণ কুমার বিশ্বাসের নতুন উপন্যাস ‘ক্রাইসিস’। অরুণ এরই মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর গদ্য সাবলীল আর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় অবলীলায় বাংলা গদ্যের কাঠামোয় ওই ভাষার বাগধারা ও লোকমুখে প্রচলিত প্রবচনের সহজ সুন্দর ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত তিনি। বিশেষত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চরিত্রের কথোপকথনের ধরনটা তাঁর আখ্যানে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘ক্রাইসিস’ উপন্যাসে মাহিন-ফারিয়া-সাদমান-লোপা-রেশমা প্রত্যেকেই নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিনিধি। ২৫টি পরিচ্ছেদে লেখক এদের জীবন, সংরাগ এবং সংকটকে তুলে ধরে একটি ইতিবাচক উপসংহারে উপনীত হয়েছেন। মাহিন-ফারিয়ার দাম্পত্য জীবনের সংকট স্বপ্নময় পরিসমাপ্তিতে নাটকীয় হয়ে উঠেছে।
অরুণ কুমার বিশ্বাস কেবল ইংরেজি নয়, বিশ্বসাহিত্যের ছাত্র হিসেবে জানেন, উপন্যাসের আখ্যান উপস্থাপন কৌশলে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে নর-নারী সম্পর্কের রূপায়ণও পাল্টে গেছে। কারণ, প্রতিটি দেশের উপন্যাসই সে দেশের সমাজ ও সভ্যতার জটিল এবং বহু বঙ্কিমগতির ধারক। সে কারণেই দুদেশের দুটি উপন্যাসের বিষয় একরকম মনে হলেও শেষ পর্যন্ত দেশ-কালের ব্যবধানে বিষয়বস্তু পৃথক হয়ে যায়। সে বিচারে আমরা উপন্যাস পর্যালোচনা করি। গুস্তাফ ফ্লবেয়ার, হেনরি জেমস, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উল্ফ, অলডাস হাক্সলি, ডরোথি রিচার্ডসন, লিও টলস্টয়, দস্তয়োভস্কি প্রমুখের রচনায় নর-নারী সম্পর্কের বিবরণ রয়েছে। উপরন্তু রেবেকা ডয়েস, জন কুপার পাউবিস, মার্গারেট বাউর প্রমুখের লেখার মধ্যে নানা রূপে দেখা যায় চরিত্রের সমাবেশ। বিংশ শতাব্দীতে ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের প্রসারে উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে যৌন-বিকার, যৌন-বিলাস প্রভৃতি অনুষঙ্গে পূর্ণ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নর-নারী সম্পর্কের নতুন বিষয় ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে। আর এসব ঔপন্যাসিকের রচনার সঙ্গে অরুণ কুমারের গভীর পরিচয় আছে। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয়, তাঁর আখ্যানে নর-নারীর ভাবাবেগ কিংবা সংরাগ প্রকাশে সংযম দেখে। তিনি মাহিন-ফারিয়ার দাম্পত্য জীবনের সংকট তুলে ধরেছেন কিংবা ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেছেন ফারিয়া-সাদমানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমে। কিন্তু ভাবাবেগতাড়িত পরিস্থিতি বর্ণনায় খুব সংক্ষিপ্ত ভাষা প্রয়োগ করেছেন। বোঝা যায় তিনি নর-নারীর বাস্তব সংকটকে মুখ্য করে তুলেছেন। সেখানে তাদের যৌন জীবনের প্রসঙ্গ থাকলেও প্রাধান্য পায়নি সেই বিবরণ। বরং ইঙ্গিতে অনেক ঘটনার সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন।
অরুণ কুমার বিশ্বাস ‘ক্রাইসিস’ তৈরি করেছেন প্রথম পরিচ্ছেদ থেকেই। তিনি দেখিয়েছেন, দাম্পত্য জীবনে ফারিয়া অসুখী। তার মনস্তত্ত্বে ভালোবাসাহীন স্বামীর সংসারে বন্দিত্বের হাহাকার। কিন্তু একজন নারী যে মাতৃত্বের দায়বদ্ধতা, পরিবার ও সমাজের দায়বদ্ধতাসহ সমস্ত কিছুর দায়বদ্ধতা নিয়ে জীবনযাপন করে, সেখান থেকেও সে বিচ্ছিন্ন। লেখক সন্তানহীনতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ফারিয়ার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা নিজের দৈহিক সৌন্দর্যের অবলুপ্তির আশঙ্কাকে চিহ্নিত করে। ফারিয়া যদি সাদমানকে গভীরভাবে ভালোবাসত, তাহলে তার অপেক্ষা করার অনুরোধ সে ফেলতে পারত না। কিন্তু লেখকের কাহিনীবিন্যাসের দক্ষতায় পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে তার হাঁপিয়ে ওঠা এবং স্বামী মাহিনের সঙ্গে রেশমার সম্পর্ক নিয়ে মানসিক সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দিশা খুঁজে বেড়ানোর তীব্র আকুতি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। আধুনিক সভ্যতার বিশিষ্ট স্তরে দাম্পত্য জীবনের সংকট ও অন্তর্জটিলতা কতখানি কঠিন ও তীব্র এবং মানব সম্পর্কের বিচিত্র রূপের বহুমাত্রিক জটিলতা কতখানি সুবিস্তৃত, সেটা ‘ক্রাইসিস’ উপন্যাসে খুব সূক্ষ্মভাবে রূপায়িত হয়েছে।
উপন্যাসটির আখ্যান বিন্যাসে একাধিক পরিচ্ছেদে নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন অরুণ কুমার। ‘ওথেলো সিনড্রোমে’র প্রসঙ্গ স্মরণে রেখে বলা যায়, এ উপন্যাসে ‘পঞ্চ অঙ্ক’ নাটকের পদ্ধতি যেন অনুসরণ করা হয়েছে। প্রথম থেকে দাম্পত্য সংকট, একুশ পরিচ্ছেদে তার উত্তুঙ্গ মুহূর্ত এবং পরবর্তী অংশে সংকট নিরসনের পথরেখায় কাহিনী ইতিবাচকতায় মোড় নিয়েছে। ফারিয়া-মাহিনের দাম্পত্য জীবনে সংকট সমাধানের পথে লেখককে পরিবার এবং পরিবারের বাইরের নর-নারীর সম্পর্কগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে। তবে নর-নারীর বহির্জীবন অপেক্ষা অন্তর্জীবনের জটিল ও বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বময়তাকে কাহিনী সূত্রে উপস্থাপন না করে ঘটনার আবহে রূপদান করেছেন তিনি, যার কারণে চরিত্রের অন্তর্মুখিন সংকটগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই শতাব্দীর কিছু উল্লেখযোগ্য সূত্র জীবনব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে লেখকের কাছে। এ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড এবং ইয়ুং-এর প্রভাব লক্ষণীয়। ফ্রয়েডের লিবিডোতাত্ত্বিক চেতনার প্রতিফল মানবসম্পর্কের মধ্যে ঔপন্যাসিক সচেতনভাবেই অনুসরণ করেছেন। সমাজের নানামুখী অস্থিরতার মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে মানুষের মনোময় সত্তার সন্ধানী হয়ে উঠেছেন লেখক। তিনি জীবনের সমগ্রতা সন্ধানে রস গ্রহণ করেছেন শিল্পের বিভিন্ন শাখা থেকে। আর এভাবে মানুষের মন, মনের নানামুখী ক্রিয়া, অবদমন, অবদমনের ফলে নানামুখী মানসিক সমস্যা, একাকিত্ব, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং সর্বোপরি সংকট অতিক্রম করে সুস্থিত জীবনের গল্প রচনা করেছেন অরুণ কুমার বিশ্বাস তাঁর ‘ক্রাইসিস’ উপন্যাসে।
ক্রাইসিস : অরুণ কুমার বিশ্বাস, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য : ২৫০ টাকা, ২০১৭