প্রথম সারির দুঃখগুলোর একটির নায়ক

অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন সম্প্রতি দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্মান একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাঁকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। যোগ্য ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে পদক নিজেই সম্মানিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
তাঁর সম্পর্কে স্বতন্ত্র কোনো ধারণা গড়ে ওঠার আগেই একদিন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় গিয়েছিলাম, মনে পড়ে। কবিবন্ধু সরকার আমিন ও প্রাবন্ধিক অনু হোসেন ছিলেন উদ্যোক্তা। তাঁর সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না, কারণ আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র নই; এবং তাঁর যে দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : চেতনালোক ও শিল্পরূপ’ এবং ‘প্রসঙ্গ : বাংলা কথাসাহিত্য’- কোনোটিই আমি দেখিনি, আর পড়া তো দূরের কথা। (যদিও পরে তাঁর উল্লিখিত প্রথম বইটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে এবং তাঁর সম্পর্কে একটি ধারণাও তৈরি করতে সুবিধা হয়েছে।) বইটি পড়ে অনুভব করেছি তাঁর টনক গদ্যের ঝলকানি। তরল এবং শ্যাওলাধরা কিংবা জরাগ্রস্ত একটি বাক্যও তাতে নেই। আছে প্রতিটি শব্দে শব্দে ভ্রমণের ব্যাপ্তি। প্রতিটি বাক্যে-অনুচ্ছেদে ঘটনা, ঘটনাপরম্পরা, ভাবনার বিস্তৃতি এবং প্রতিটি অধ্যায় শেষে সতৃপ্ত মধ্যাহ্নভোজের পর ভাতঘুমের মতো স্বস্তি অনুভূত হয় মনেও।
তারও আগে বন্ধুত্বসূত্রে সরকার আমিন ও অনু হোসেনের কাছে সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পর্কে এত প্রাজ্ঞ ও সারকথা শুনেছি যে, সেদিন তাঁর বাসায় যাওয়ার নেপথ্য ব্যাপারটা ছিল অনেকটা এই দুই বন্ধুর মুখ থেকে শোনা পরিমিত ও অর্থবহ প্রশংসাবচন। সেই প্রথম তাঁর বাসায়, এমনকি তাঁর সাক্ষাৎ মুখোমুখি বসে তাঁকে দেখা এবং তাঁর কথা শোনা। বাসায় ঢুকেই কৌতূহল তীব্র হচ্ছিল যে, যার সম্পর্কে এত শুনেছি; তিনি সরাসরি দেখতে কেমন, কী রকম করে কথা বলেন; তরুণদের কী রকম করে কাছে বা দূরে টানেন কিংবা তিনি যে একজন খ্যাতিমান ও ছাত্রছাত্রীপ্রিয় শিক্ষক সেই হিসেবে তিনি সবাইকে ছাত্রছাত্রী মনে করেন কি না। সাক্ষাতে বুঝেছি যে, তাঁর সঙ্গে তরুণদের কোনো পার্থক্য নেই। তিনি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পছন্দ করেন; আমাদের মতো তরুণদের সঙ্গেও স্নেহ ও সম্মান দিয়ে কথা বলেন; কি বলায় কি পড়াশোনায় তিনি কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ডে বসবাস করেন। সব ক্ষেত্রে নিজেকে আপডেট রাখতে পছন্দ করেন। এর অবশ্য একটা কারণও আছে। কারণটি হলো- সরকার আমিন, সিরাজ সালেকীনদের মতো তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আছে- যারা তাঁকে কখনো পিছিয়ে পড়তে দেয় না। আর এর চেয়ে বড় কারণটি হলো তাঁর নিজের একটি অনুসন্ধিৎসু মন এবং প্রগাঢ় আন্তরিকতা। তিনি যেমন শিক্ষাঙ্গনের সর্বশেষ সংযোজনটি সম্পর্কে ধারণা রাখতে চান, তেমনি পড়তে চান সদ্যাগত তরুণতর কবির কবিতাটি পর্যন্ত। কেউ প্রত্যাশা করলে সুপরামর্শ দেন বটে, কিন্তু তিনি কখনো কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন বা জোর করে কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন, এমন কথা কখনো শুনিনি। যে কারণে তাঁর বিভাগের বহু বছর আগে ছাত্রত্ব-ফুরিয়ে-যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা এখনো তাঁর কাছে আসেন; তাঁর অভিভাবকত্ব স্বীকার করেন; আদেশ-উপদেশ প্রত্যাশা করেন এমনকি পরিবারের একজন বলে মনে করেন। আর তরুণরা শিল্পচর্চার ভুলচুক ধরিয়ে দিতে তাঁকে শিক্ষকের চেয়ে বেশি কিছু মনে করে। বলতে দ্বিধা নেই, আজ বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় স্বখ্যাত হয়েছেন- এমন অনেকেই ছিলেন সৈয়দ আকরম হোসেনের ছাত্র এবং এই মানুষগুলো অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তাঁর নামটি উচ্চারণ করেও তৃপ্তি পান।
সেদিন সৈয়দ আকরম হোসেনের বাসায় যেমন ভাবির পছন্দের অত্যন্ত সুস্বাদু সস দিয়ে সমুচা খাওয়ার কথা আমি ভুলিনি, তেমনি কোনোদিন ভুলব না এত প্রশংসার নেপথ্যের মানুষটার প্রথম মুখদর্শনের স্মৃতি। কী সাবলীল সুন্দর চেহারার ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসছিল স্পষ্ট উচ্চারণ ও ভরাট কণ্ঠের কথাগুলো। কুশল বিনিময়ের কথাগুলোও আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। সেদিন আড্ডা হয়েছিল বটে, তবে সিরিয়াস কোনো আলোচনা নয়। প্রসঙ্গক্রমে উঠেছিল আমাদের প্রিয় বন্ধু সাদ কামালী, শাহনাজ মুন্নী, মুজিব ইরম, শাহেদ কায়েস, মিহির মুসাকী, শোয়াইব জিবরানের কথা। যেকোনো আড্ডায় আমরা এই কজন মানুষ, কেউ কেউ অনুপস্থিত থাকলেও পরস্পর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। আমাকে তিনি একজন তরুণ বন্ধুর মতো গ্রহণ করেছিলেন। কথা বলেছিলেন বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্যের মনে হয়েছিল, যখন কথা বলছিলেন, মনেই হয়নি যে, আজই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো। কথা হলো। হয়তো তিনি আমার বন্ধুদের কাছে আমার কথা শুনেছেন; কিন্তু প্রথম দর্শনেই এতটা জড়তাহীন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো আচরণ করার ক্ষমতা তাঁর শিক্ষকতাসূত্রে হয়তো এবং তাঁর ব্যতিক্রমী শিক্ষকতাসূত্রেই অন্য তরুণের সঙ্গে নিজের তারুণ্যকে অ্যাডজাস্ট করতে পারা।
সৈয়দ আকরম হোসেনের সঙ্গে জোরালো সম্পর্কের প্রথম সেতুবন্ধটি হলো তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘উলুখাগড়া’। কাগজটির নির্বাহী সম্পাদক (বর্তমানে সম্পাদক) অধ্যাপক সিরাজ সালেকীন সেই সেতুবন্ধের মাধ্যম এবং আমাকে সেই পত্রিকার একজন লেখক হিসেবে সংযুক্তিকরণের প্রধান কাণ্ডারি। এই পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যায় লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি এবং ক্রমে সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদনার দিকটি সম্পর্কে একটি সমৃদ্ধ ধারণা পেয়েছি। তাঁর সম্পাদনার ব্যাপারটিও আমি খুব নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি; কারণ আমি নিজেও ১৮ বছর ধরে ‘শালুক’ নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে আসছি। আমি তাঁর সম্পাদনা থেকে কিছু নিতে চেষ্টা এবং ‘শালুক’কে আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। ‘উলুখাগড়া’র প্রতিটি পৃষ্ঠা খুব হিসেব করে উল্টেছি; বানান, বিন্যাস সব কিছু খেয়াল করে তাঁর সম্পর্কে দিন দিন আরো আকৃষ্ট হয়েছি। কিন্তু তাঁর সম্পাদিত এই পত্রিকাটির কোনো সম্পাদকীয় থাকে না। তাঁর ধারণা টেক্সট পড়ে পাঠকই তাঁর মনের মতো করে পত্রিকার সম্পাদকীয়-চিন্তা সম্পর্কে ধারণা করে নেবেন। এটি একদিকে যেমন যৌক্তিক মনে হয়েছে; আবার অন্যদিকে ব্যাপারটিকে অযৌক্তিক মনে করে তাকে উড়িয়ে দিয়েছি। কারণ আমার সম্পাদিত ‘শালুক’-এর প্রতিটি সংখ্যার সম্পাদকীয় পড়ে লিটলম্যাগ পাঠকদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক গুঞ্জন শুনেছি এবং পত্রিকাটির ভেতরের টেক্সটের প্রতি তাদের আগ্রহবৃদ্ধির গল্পও শুনেছি। এমনকি ‘শালুক’-এর সম্পাদকীয়-ভঙ্গি নকল করে অনেককে সম্পাদকীয় লিখতেও দেখেছি। শুধু এ কারণে নয়; যথাসময়ে রাষ্ট্রিক অরাজকতার ও কুশাসনের বিরুদ্ধে ‘শালুক’-এর সম্পাদকীয়তে একটি করে প্রতিবাদ থাকত পাশাপাশি যা ‘শালুক’-এর কর্মীরাও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে পত্রিকাটিকে নিজেদের স্বচ্ছ অবস্থানের পুখপত্র ভাবতে দ্বিধাহীন হয়েছে।
এটি কোনো মতবিরোধের ব্যাপার নয়, আমি বলব ভিন্নমতের ব্যাপার। এই ভিন্নমত দুটি পত্রিকাকে দুটি অবস্থানে রেখে বিবেচনা করতে পথ তৈরি করেছে এবং পাঠকের গভীরে দুটি দরজা খুলতে ভূমিকা রেখেছে। ‘উলুখাগড়া’র প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল বলে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার একটি রিভিউও ছেপেছিলাম ‘শালুক’-এ।
আমরা দূরে দূরে যার যার অবস্থানে থেকেছি বটে; কিন্তু সৈয়দ আকরম হোসেন এক সপ্তাহের জন্যও আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। কারণ তাঁর এত এত মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে যে, তাঁরা কখনো এই সুযোগটি দেয়নি। ‘উলুখাগড়া’সংক্রান্ত এক আলোচনায় আরো একবার গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। সেবারও তাঁর চিন্তা, কথা বলার ভঙ্গিতে আকৃষ্ট হয়েছি।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। শুধু ভেবেছি- একজন বক্তার পড়ালেখার পরিধি ও চিন্তার অতলতা কতটা থাকলে এমন মনোযোগকাড়া সাবলীল বক্তৃতা দিতে পারেন। ভেবেছি, একজন মানুষের বৈদগ্ধ্য কতটুকু হলে কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই কোনো ধ্রুপদী বইয়ের ভাষার মতো অনর্গল বক্তৃতা দিয়ে যেতে পারেন। মানুষের স্মিতহাস্যোজ্জ্বল মুখের কথায়ও যে গাম্ভীর্য ও সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠতে পারে; তেমন একজন মানুষের নাম বলতে বললে আমি সৈয়দ আকরম হোসেনের কথাই বলব। এই মানুষটির কাছ থেকে আমি যে যৎসামান্য স্নেহ পেয়েছি; তা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সবশেষে আজ প্রকাশ করেই ফেলি যে, আমার জীবনে যে প্রথম সারির দুঃখগুলো আছে, তার বিশেষ একটি দুঃখ হলো- সৈয়দ আকরম হোসেনের মতো একজন শিক্ষকের সরাসরি ছাত্র হতে না পারা। আমার এই দুঃখের নায়ক হয়ে আছেন তিনি এবং থাকবেনও তো আমৃত্যু।