কুবরিক ও ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ

স্ট্যানলি কুবরিক একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। তাঁকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সৃজনশীল ও প্রভাবশালী নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। কুবরিকের চলচ্চিত্রের অধিকাংশই বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মের চলচ্চিত্র সংস্করণ। স্ট্যানলি কুবরিকের চলচ্চিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কাছ থেকে তোলা ক্লোজ-আপ, যাতে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর মুখভঙ্গি ও আবেগ প্রকাশ খুব ভালোভাবে ফুটে ওঠে। কুবরিক তাঁর ছবিতে জুম লেন্সের ব্যবহারেও এনেছিলেরন নতুনত্ব। উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসংগীতের ব্যাপক প্রয়োগ তাঁর চলচ্চিত্রের একটি অন্যতম সংযোজন। এ ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য এবং সৃজনশীল শিল্পবোধের কারণে তিনি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম অত্যুর পরিচালক হিসেবে স্থান পেয়েছেন। ক্যারিয়ারে মোট ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যার প্রায় সবগুলোই চলচ্চিত্রবোদ্ধা এবং সমালোচকদের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে-ফিয়ার অ্যান্ড ডিজায়ার (১৯৫৩), কিলারস কিস (১৯৫৫), দ্য কিলিং (১৯৫৬), পাথস অব গ্লোরি (১৯৫৭), স্পার্টাকাস (১৯৬০), লোলিটা (১৯৬২), ড. স্ট্রেঞ্জলাভ (১৯৬৪), ২০০১ : আ স্পেস ওডিসি (১৯৬৮), অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫), দ্য শাইনিং (১৯৮০), ফুল মেটাল জ্যাকেট (১৯৮৭) এবং আইজ ওয়াইড শাট (১৯৯৯)। ১৯২৮ সালের আজকের দিনে জন্ম হয়েছিল এই অসামান্য নির্মাতার।
স্ট্যানলি কুবরিকের ‘অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ অ্যান্থনি বার্জেস-এর ১৯৬২ সালে বের হওয়া উপন্যাস ‘অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ১৩৬ মিনিট ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজক ও সহলেখক ছিলেন হিসেবেও ছিলেন স্ট্যানলি কুবরিক।
ছবিটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যালকম ম্যাকডয়েল। এই চলচ্চিত্রটি আবর্তিত হয়েছে বিকৃত মানসিকতার এক কিশোর অ্যালেক্স ডিলার্জকে কেন্দ্র করে। ১৭ বছর বয়সী অ্যালেক্সকে ভবিষ্যৎ ইংল্যান্ডের একটি শহরের ছোট অপরাধী দলের প্রধান হিসেবে দেখানো হয়েছে। ছবিটিতে অ্যালেক্সকে অতি সহিংস এবং অতিরিক্ত অসংযত হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন কারণে চলচ্চিত্রটি সমালোচিতও হয়েছে দেশে দেশে। কয়েক দেশে আবার এটি নিষেধাজ্ঞারও মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে একে ‘এক্স’ রেটিং দেওয়া হয়, ফলে স্ট্যানলি কুবরিক স্বেচ্ছায় ছবি থেকে ৩০ সেকেন্ড কেটে বাদ দেন। এরপর ১৯৭৩ সালে পুনর্মুক্তির পর এটি ‘আর’ রেটিং পায়। United States Conference of Catholic Bishops' Office for Film and Broadcasting এই ছবিকে ‘সি’ (নিষিদ্ধ) রেটিং দিয়েছিল। উচ্চমাত্রার সহিংসতা ও যৌনতা সরাসরি প্রদর্শিত হয়েছে উল্লেখ করে তারা ছবিটি নিষিদ্ধ করেছিল। তবে ১৯৮২ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
১৯৭২ সালে ১৪ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্র তার বন্ধুকে হত্যার কারণে অভিযুক্ত হয়। বিচারের সময় তার এই ঘটনার সঙ্গে অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ-এর সম্পর্ক টানা হয়। পরে ১৬ বছরের আরেক কিশোরের ক্ষেত্রে অনেকটা একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এই পরিস্থিতিতে কুবরিক নিজেই ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিওকে যুক্তরাজ্য থেকে সিনেমাটির সরবরাহ উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। যদিও দীর্ঘ ২৭ বছর পর তাঁর মৃত্যুর পর ছবিটি ডিভিডি আকারে আবারও বাজারে ছাড়া হয়। অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ চারটি ক্ষেত্রে- পরিচালনা, সম্পাদনা, সেরা ছবি ও অভিযোজিত চিত্রনাট্য একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করে। এদিকে সাতটি ক্ষেত্রে মনোনয়ন পায় বাফটা পুরস্কারে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে শিল্প নির্দেশনা, চিত্রগ্রহণ, পরিচালনা, ছবি, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য এবং সাউন্ডট্র্যাক। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন সুরকার জন অ্যালকট; সম্পাদনায় বিল বাটলার, সংগীতায়োজনে ওয়েন্ডি কার্লোস এবং শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন জন বেরি।
আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট ১০০ বছরের মার্কিন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা নির্বাচন করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জকে সম্মানিত করে। এগুলো হচ্ছে- ১৯৯৮ সালে সর্বকালের সেরা ১০০ ছবির তালিকায় ৪৬ নম্বর স্থান; ২০০১ সালে সর্বকালের সেরা ১০০ থ্রিলার চলচ্চিত্রের তালিকায় ২১ নম্বর স্থান; সর্বকালের সেরা ভিলেনের তালিকায় অ্যালেক্স ডিলার্জকে ১২ নম্বর স্থান দেয় ২০০৩ সালে; এবং ২০০৮ সালে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্রের তালিকায় অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জকে চার নম্বর স্থান দেওয়া হয়।
অ্যালেক্স ডিলার্জ একজন কিশোর যে তার পরিবারের সঙ্গে ইংল্যান্ডের একটি শহরে থাকে। তার পরই সে ছাড়া আছেন তার মা ও বাবা। এর বাইরে তার বন্ধু আছে তিনজন যাদের সে ড্রুগস বলে ডাকে। এই তিন বন্ধু হচ্ছে জর্জ, ডিম ও পিট। তারা একসঙ্গে শহরে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে বেড়ায়। খুন, ধর্ষণ, মানুষকে পেটানো ও শারীরিক নির্যাতন করাই তাদের শখ। স্থানীয় করোভা মিল্কবারে তারা চারজন প্রতি সন্ধ্যায় নেশাদ্রব্য-মিশ্রিত দুধ পান করে এবং নেশাসক্ত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে নানা ধরনের সহিংস আচরণ করতে থাকে। এমনই একদিন তারা এক ধনী মহিলার বাড়িতে যায়। যখন অ্যালেক্স ওই মহিলাকে আক্রমণ করে বসে, তখনই পুলিশের সাইরেন শুনতে পাওয়া যায়। সে সময় অ্যালেক্স পালাতে চাইলে বন্ধুরা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশের হাতে ফেলে পালিয়ে যায়। এ কারণে অ্যালেক্স পুলিশ অফিসার পি আর ডেলটয়েডের হাতে ধরা পড়ে। পুলিশ অ্যালেক্সের সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে আগে থেকেই দৃষ্টি রাখছিল। পুলিশ পরে তাকে জেলে পাঠায়। যখন অ্যালেক্সকে জেলে পাঠানো হয়, তখন সরকার অপরাধীদের অপরাধপ্রবণতা কমানোর জন্য একধরনের মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছিল।
এই মানসিক চিকিৎসাটির নাম লুডোভিকো টেকনিক। এ ক্ষেত্রে গবেষকদের পছন্দ ছিল অত্যধিক সহিংস অপরাধী। ঘটনাচক্রে অ্যালেক্সকে সরকারের এই পরীক্ষামূলক লুডোভিকো প্রকল্পে ব্যবহার করার জন্য বাছাই করা হয়। এই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীদের সংশোধন করা। অপরাধীদের একধরনের মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার মাধমে এমন অবস্থায় উপনীত করা যেন তারা কোনো ধরনের সহিংসতা ঘটাতে উদ্যত হলে তাদের ভেতরের অভিব্যক্তি উল্টো কাজ করবে। এতে তারা নিজেকে সহিংস মনোভাব থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। সমাজের যেকোনো ক্ষতি করতে তারা অক্ষম হয়ে পড়বে।
অ্যালেক্সের ওপর এই পরীক্ষা চালানোর পর তাকে জেল থেকে মুক্ত করা হয়। সে বাইরের পৃথিবীতে ফিরে আসার পর অপরাধপ্রবণতা জেগে উঠত কিন্তু বিশেষ লুডোভিকো চিকিৎসার কারণে সে সহিংসতা ঘটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এর ফলে তাকে পোহাতে হয় অমানবিক মানসিক অবস্থা। আবার জেলে যাওয়ার আগে সে যে সহিংস আচরণগুলো করত তার প্রতিটিই তার দিকে ফিরে আসতে থাকে। অ্যালেক্স জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর এভাবেই এগোতে থাকে ছবির কাহিনী। লুডোভিকো চিকিৎসার প্রভাব এবং সমাজে অগ্রহণযোগ্যতা, এই দুইয়ের সংমিশ্রণে বিচিত্র এক অমানবিক পরিস্থিতিতে প্রবেশ করে অ্যালেক্সের জীবন। এভাবেই অপরাধ ও শাস্তির দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলা হয় স্ট্যানলি কুবরিকের অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ চলচ্চিত্রটিতে।
এই চলচ্চিত্রের স্থান ও কাল অনির্দিষ্ট। চলচ্চিত্রটি স্ট্যানলি কুবরিক বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছেন। বলাবাহুল্য ক্যামেরার ওপর কুবরিক খুব গুরুত্ব দেন; যার প্রমাণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রথাবিরোধী শট এবং ক্যামেরা পজিশন। এই চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সংলাপের বৈচিত্র্য। এখানে অনেকটা ব্রিটিশ টানে ইংরেজির ব্যবহার রয়েছে যাতে কুবরিক যোগ করেছেন অসংখ্যা স্ল্যাং, আবার কিছু কিছু রুশ শব্দের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো।
এমনকি কখনো কিছুর শব্দের অর্থ বোঝাও দুঃসাধ্য বলে মনে হয়েছে। এই ছবিতে মূল চরিত্রে ম্যালকম ম্যাকডয়েল অসামান্য অভিনয়ে অ্যালেক্সের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম ভাগের ধর্ষকামী সহিংস কিশোরের চরিত্রে তিনি যেমন দুর্দান্ত তেমনি শেষভাগের অসহায়ত্বের রূপায়ণও তিনি করেছেন অভিনব দক্ষতায়। এতে অন্য আরো চরিত্র আছে বটে, তবে প্রোটাগনিস্ট অ্যালেক্সের পারফরম্যান্সই ছবিটিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। এই চলচ্চিত্রে স্ট্যানলি কুবরিকের ব্যক্তিগত প্রভাব এবং শিল্পসম্মত নিয়ন্ত্রণ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁকে চলচ্চিত্রটির লেখক বা অত্যুর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলা যায়। কুবরিকের অসাধারণ গল্প বলার ধরনের সঙ্গে ব্যতিক্রমী ক্যামেরার কাজ, সঙ্গে বিভিন্ন প্রতীকের যোগ নিঃসন্দেহে অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা অত্যুর চলচ্চিত্রের আসনে বসিয়েছে।