বন্ধুত্ব দিবসের পরোয়া করে না : খালেদ হোসাইন

খালেদ হোসাইন বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ছড়াকার হিসেবেও রয়েছেন খ্যাতির শীর্ষে। আজ রোববার, ২ আগস্ট, ২০১৫। প্রথা অনুযায়ী আজ বন্ধু দিবস। বন্ধু দিবস উপলক্ষে তিনি এনটিভি অনলাইনকে দিয়েছেন বিশেষ সাক্ষাৎকার।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন স্যার?
খালেদ হোসাইন : আমিও বন্ধু দিবসের শুভকামনা জানাই। আমি ভালো আছি। আশা করি, তোমরাও ভালো আছ।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধুত্বকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
খালেদ হোসাইন : মানুষ সামাজিক জীব। অনেক মানুষের সমবায়ে গঠিত এ সমাজ। একটি সমাজে আত্মীয়স্বজনের বাইরেও অনেক মানুষ থাকে। সেই সম্পর্কের নানা মাত্রা থাকে। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বন্ধু হয়ে ওঠে।
জীবন তো খুব সহজ নয়। অনেক আনন্দের পাশাপাশি নানা রকম জটিলতাও থাকে। বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক সুখে-দুঃখে, সাফল্যে-বিপর্যয়ে যার সান্নিধ্যকে অপরিহার্য মনে হয়। অনেক সম্পর্কই নির্দিষ্ট সময়ের পর ক্লান্তিকর মনে হতে পারে, বন্ধুত্ব যেকোনো রকমের মালিন্য ও অবসাদ থেকে মুক্ত এক অনাবিল সম্পর্ক। বন্ধুত্ব অমর।
শৈলেন শাহরিয়ার : আজকের দিনটা উৎসর্গ করা হয়েছে বন্ধুদের জন্য। মানুষের জীবনে ভালো বন্ধুর গুরুত্ব কতটুকু?
খালেদ হোসাইন : বন্ধুত্ব কোনো দিবসের পরোয়া করে না। তবু এরকম একটি দিনকে আমি তাৎপর্যবহ মনে করি। নানাবিধ জীবন-বাস্তবতায়, জীবন ও জীবিকার চাপে, আমাদের অনেক দরকারি বিষয়-আশয়, এমনকি সম্পর্ককে আমার অনেক সময় ভুলে যাই। বন্ধু দিবস সেই বিস্মৃতি থেকে আমাদের উদ্ধার করে।
কাউকে যদি ভালো মনে না হয়, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব নয়। বন্ধু মানেই ভালো সান্নিধ্য। বিপদে-সম্পদে পাশে থাকে বলে, প্রয়োজনে দিক-নির্দেশনা দেয় বলে, এর গুরুত্ব অপরিসীম।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে স্বার্থহীনতার কথা আসে। কিন্তু এখনকার বন্ধুত্বের বেশির ভাগই কমার্শিয়াল এবং স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। এগুলোকে কি আপনি বন্ধুত্ব বলবেন, নাকি অন্য কিছু?
খালেদ হোসাইন : ভালোলাগাকে যদি একটা স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে বন্ধুত্বে স্বার্থপরতা থাকে। কিন্তু তাতে বেনিয়াবৃত্তি থাকে না। বাণিজ্যবৃত্তি তো বন্ধুত্ব নয়। তাকে আমি বন্ধুত্ব বলে স্বীকার করব না।
শৈলেন শাহরিয়ার : আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, এখন অধ্যাপনা করছেন। ক্যাম্পাসে আপনার দেখা সেই সময় আর এই সময়ের বন্ধুত্বের পার্থক্য কতটুকু?
খালেদ হোসাইন : বন্ধুত্বে মৌলিক উপাদানের তেমন পরিবর্তন ঘটে না। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার অনুষঙ্গও পাল্টে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় নানা অর্থে অনেক বড় হয়েছে, মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, ব্যস্ততা বেড়েছে, প্রেমের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে- এসবের ছাপ পড়েছে বন্ধুত্বের সম্পর্কেও। এখন ছেলেমেয়ে এমন জুটির সংখ্যা বেড়েছে। তখন ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়ে বা সমন্বিত বন্ধুত্ব অনেক ছিল। নানা দল ছিল। একসঙ্গে চলাফেরা করত। গান গেয়ে বেড়াত। বিষ্টিতে ভিজত। কাঁঠাল চুরি করত, মাছও। সেসবের মধ্যে বৈচিত্র্যময় আনন্দ ছিল। এখনকার বন্ধুত্বের স্বাদ কেমন তা এখনকার ছেলেমেয়েরাই ভালো বলতে পারবে। চলতে ফিরতে দেখি-আমার খারাপ লাগে না।
শৈলেন শাহরিয়ার : ছাত্রজীবন আর কর্মজীবনের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো হেরফের আছে কি?
খালেদ হোসাইন : বন্ধুত্ব যদি হয় তবে যে কোনো ক্ষেত্রেই তার চরিত্রের মৌলিকত্ব অভিন্ন। শৈশবের বন্ধুরাই প্রকৃত বন্ধু এমন বলা হয়। একসময় হয়তো তা অনেক বেশি সত্য ছিল। এখন তো আর মানুষ তার জন্মভিটায় স্থির থাকতে পারে না। চলতে হয়। নানা বাঁক পেরুতে হয়। সব জায়গায়ই বন্ধুত্বের হাতছানি থাকে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেও।
‘কর্মক্ষেত্রে কোনো বন্ধুত্ব হয় না’-এটি প্রায় প্রবাদ। কারণ এখানে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত থাকে। ‘প্রফেশনাল জেলাসি’ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সব সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। আমি মনে করি, কর্মক্ষেত্রেও বন্ধুত্ব হতে পারে। তবে শৈশব-কৈশোরের নির্মলতা তো এখানে আশা করা ঠিক নয়, পথের বাঁকে বাঁকে যেমন অনন্যতা থাকে, এখানেও তা-ই হয়। পরিণত বয়সের বন্ধুত্বের স্বভাব ও স্বাদ স্বতন্ত্র। তার সৌরভও আলাদা।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধু দিবসে কোনো বন্ধুকে কি খুব মনে পড়ছে?
খালেদ হোসাইন : এমন তো হয়ই। এতে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার কোনো তুলনা হয় না। কারণ কেবল বন্ধুর সঙ্গেই তো দেখা হয় না, সে নিয়ে আসে অতীতের প্রায় বিস্মৃত এক কোমল-মনোরম মায়াবী অধ্যায়। তখন সে হয়ে ওঠে বহু আগে পাঠ করা এক অনিঃশেষ গ্রন্থ। টেনে নিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর মর্মকেন্দ্রে। সে আনন্দ অদ্ভুত এক মুক্তির অনুভূতি দেয়।
শৈলেন শাহরিয়ার : হঠাৎ করে আপনার ছোটবেলার কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কতটুকু খুশি হবেন?
খালেদ হোসাইন : বন্ধু দিবসে এখন আমার অনেক বন্ধুর কথাই মনে পড়ছে। প্রাইমারি স্কুলের অনেক সহপাঠীর সঙ্গে স্কুল পেরুনোর পরে আর দেখা হয়নি। ওদের কথা খুব মনে পড়ে, হযরত, মহিউদ্দিন, আমির, আম্বিয়া, আয়শা-কত!
বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছি- আজমের সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। ওর কথাও মনে পড়ল।
শৈলেন শাহরিয়ার : আপনার কাছে বন্ধু দিবসের গুরুত্ব কতটুকু? আদৌ এর প্রয়োজন আছে কি?
খালেদ হোসাইন : এর গুরুত্ব এই যে এ স্মৃতির জানালাটা খুলে দেয়। নতুন আলো-বাতাস আসে বহুদূর থেকে ধেয়ে। আমার কাছে এর মূল্য আছে। প্রয়োজন আছে।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধুদের নিয়ে আপনার কোনো স্মরণীয় ঘটনা, যা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না...
খালেদ হোসাইন : বয়স তো হলো কিছু। অনেক বন্ধু, অনেক ঘটনা। অনেক বিশেষ ঘটনা। তার মধ্যে অনেক ঘটনা কৌতুককর, কিছু বেদনাত্মক। স্বল্প-পরিসরে তা বলা সম্ভব নয়।
আমার আগের ইয়ারে ইংরেজিতে অনার্স পড়ত জীবন নন্দী। অদ্ভুত এক জীবন ছিল ওর। মরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয়। একসময় সে বাঁচার জন্য, সুন্দর একটা জীবনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সেই সময় এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় জীবন নন্দী। ওর কথা মনে পড়লে খারাপ লাগে। স্বামীবিবর্জিত ওর মায়ের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।
শৈলেন শাহরিয়ার : বন্ধুদের নিয়ে আপনার লেখা কোনো কবিতা...
খালেদ হোসাইন : বন্ধুত্ব নিয়ে বা বন্ধুদের নিয়ে একটি প্রিয় কবিতা আছে, ‘শকার-যাত্রার আয়োজনে’। অনেক বড়। অন্য একটি কবিতা : ‘আমরা কজন’
আমরা কজন মীরার ভজন শুনি
আমরা কজন জল পোড়াতে যাই
আমরা কজন অগ্নিস্নান করি-
স্মিতমুখে দেখেন মীরাবাই।
আমরা কজন গাছতলাতে থাকি
কাছ থেকে খুব দূরেও চলে যাই
আমরা কজন স্বজন হয়ে থাকি
শত্রু হওয়ার কোনো উপায় নাই।
আমরা কজন প্রাণ খুলে খুব হাসি
আমরা কজন ধুতুরাফল খাই
আমরা কজন মরে পড়ে থাকি
আসলে তো মৃত্যুকে ধমকাই।
আমরা কজন কেবল ভালোবাসি
বিমূঢ় হয়ে থাকি বেদনায়
রক্ত-চোখের শাসন তবু দেখি
আমরা তবু হৃদয়তীর্থে যাই।
আমরা কজন সবার চেয়ে সুখী
আমরা কজন সবচে দুঃখ পাই
আমরা কজন বৃক্ষ হয়ে থাকি-
দেখে মুচকি হাসেন মীরাবাই।