তারেক মাসুদ স্মরণ
‘ব্যথা যে দেয় তারও তো ব্যথা থাকতে পারে’

তারেক মাসুদ বলতেন, একজন সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্র নির্মাতার কাজ হচ্ছে দর্শকের মনে অস্বস্তি তৈরি করা। প্রশ্ন তৈরি করা। প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দর্শক আরো কিছুক্ষণ বসে থাকবে। হাততালি দিতে ভুলে যাবে। কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল অথবা নিশ্চিত হতে না পারা একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে খানিক বাদে ভ্রূ কুঁচকে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাবে। সে ভাবনাটা হয়তো পরবর্তী কয়েক দিন তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।
‘মাটির ময়না’ বোধ হয় এমন একটি চলচ্চিত্র, শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এর রেশ থেকে যায়। বুকের ভেতর খানিকটা শূন্যতা এসে ভর করে। প্রদর্শনী শেষে হাততালি দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু ভাবনার খোরাক হাতে আসে অনেক। ‘অন্তর্যাত্রা’ কি একই রকম? অথবা ‘রানওয়ে’? ‘রানওয়ে’ বোধ হয় ভাবনার খোরাক জোগায় একটু বেশি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন চলচ্চিত্র আমরা প্রতি দশকে একটার বেশি পাই না। সবাই আমাদের বিনোদন দিতে চায়। কেউ গলা ফাটিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ শরীর দেখিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ সুড়সুড়ি দিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ অস্ত্রের হিংস্রতা আর রক্তারক্তি দেখিয়ে বিনোদন দিতে চায়। বেশির ভাগ আবার এর সবকিছু একসঙ্গে মিশিয়ে ঘোল বানিয়ে বিনোদন দিতে চায়। কী আর করা! তবে পরিণত মানুষের বিনোদন যে পরিণত ভাবনায় হতে পারে, এ কথা বোধ হয় সবাইকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না।
একজন নির্মাতার ক্রমে পরিণত হয়ে ওঠার পথে যে যাত্রা, সে যাত্রা তাঁর একান্ত নিজস্ব হলেও তা থেকে যে প্রাপ্তি ঘটে, তা অন্য সবার। তাঁর দর্শকের, তাঁর সহযোগীর। কিন্তু পরিণত হয়ে ওঠার পর যখন তাঁর সবচেয়ে ক্ষুরধার কাজটি করার সময় আসে, আর তখনই যদি সে হারিয়ে যায় সে ক্ষতি কার? সে ক্ষতিটাও আসলে দর্শকের এবং তাঁর সহযোগীদেরই বেশি। তারেক মাসুদ বোধ হয় পরিণত হয়ে ওঠার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, এ দেশে একজন সৃজনশীল মানুষ যতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। নইলে দেশভাগের মতো এমন একটি বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারেন কী করে?
ব্যক্তিগতভাবে কেউ যখন আমাকে ফিল্মমেকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। সঙ্গে সঙ্গেই শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করি, বলি—‘প্র্যাকটিসিং ফিল্মমেকার’। কৌতূহলী চোখের সামনে খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করি। একজন ডাক্তার যেমন ৩০ বছর ডাক্তারি করেও বলে, অমুক জায়গায় প্র্যাকটিস করছি; একজন উকিল যেমন অনেক সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পরও বলেন, সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করছি; একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকেও আসলে সারা জীবন এমন প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর পর কেউ সিনিয়র, কেউ জুনিয়র। কেউ নবীন, কেউ প্রবীণ। এই মাধ্যমে শিক্ষার কোনো শেষ নেই। পুরোপুরি হয়ে ওঠার জন্য সময় লাগে। সারা জীবন জানা-বোঝার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। শিল্পের সব শাখায় দখল অথবা দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হয়। আমরা দেখি, ৩৯টি চলচ্চিত্রের মাস্টারমেকার সত্যজিৎ রায় জীবন-সায়াহ্নে এসেও প্রিয় ছবির কথা অনায়াসে বলতে পারেন না। জানতে চাইলে অনেক ভেবেচিন্তে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত আমি চারুলতায় সবচেয়ে কম ভুল করেছি!’
সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজি’র মতো একটা অসাধারণ ট্রিলজি নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তারেক ভাই। সেই ভাবনা থেকেই ‘কাগজের ফুল’-এর বীজ বপন। এটা হতো প্রিক্যুয়াল। জানতে চেয়েছিলাম, যখন ‘মাটির ময়না’র সিক্যুয়াল নির্মাণ করবেন, তখন কোন গল্পটা বেছে নেবেন? প্রথমবার বলেছিলেন, ‘এতদিন কি বাঁচব?’ উত্তরের জন্য নাছোড়বান্দার মতো লেগেছিলাম। যদি বাঁচেন, তাহলে কোন গল্পটা বেছে নেবেন? চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন, ‘মাটির ময়নার আনুর বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমার যৌবনের গল্প।’ সেই যৌবনের গল্প আমরা কিছুটা জেনেছিলাম। মাদ্রাসার ছাত্র মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধে। তার পর একদিন সে হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র নির্মাতা। সিনেমার মতোই গল্প। অথবা গল্পের চেয়ে বেশি কিছু। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম সেই ট্রিলজি থেকে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যোগ হওয়ার মতো আরো দুটি স্বর্ণপালক আগস্টের এক বৃষ্টির দিনে মহাসড়কের পিচঢালা পথে মহাপ্রাণের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু মহাপ্রাণ বলে কথা। এই দৃশ্য থেকে মিলিয়ে যাওয়ার পরও কতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি আমাদের জীবনে। আমাদের মুক্তির গানে গানে, আমাদের অন্তর্গত যাত্রায়, আমাদের মন ও মননে। বলে যাওয়া কত কথা, সৃজনশীল কত কাজের সমাহার। কত কত উচ্চারণ আর উদ্বেলিত হাসির শব্দ আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকে। ভাবতে ভালো লাগে না, আপনি নেই। তবুও আজ চার বছর হয়ে গেল, আপনি নেই এটাই সত্যি।
চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি কথা আপনার খুব প্রিয় ছিল, ‘ফিল্ম মেকিং ইজ আ চেইন অব লাই, হুইচ ইনটেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার ট্রুথ।’ কিয়ারোস্তামির এই কথাটি আপনি রিফ্রেজ করে বলতেন, ‘ফিল্ম মেকিং ইজ আ আগলি প্রসেস হুইচ ইনটেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার বিউটি।’ বলার জায়গা থেকে দুজনের পার্সপেক্টিভ ভিন্ন হলেও দুটো কথাই প্রয়োজনীয়, দুটো কথাই আপনাদের অভিজ্ঞতাজাত সৃজনশীল অভিজ্ঞান। নিজেদের কাজটুকু করতে গিয়ে আপনাদের এসব কথার আক্ষরিক প্রমাণ আমরা সব সময়েই পেয়ে থাকি।
‘মাটির ময়না’র আয়শা চরিত্রের মুখে উচ্চারিত সংলাপটি আপনার নিজেরও খুব প্রিয় ছিল, ‘ব্যথা যে দেয় তারও তো ব্যথা থাকতে পারে।’ কত অবলীলায় জীবনের গূঢ় অনুভূতির কথা বলে গেছেন নানা ভঙ্গিতে। ব্যথা আপনিও দিয়েছেন আমাদের। আপনার অবেলায় চলে যাওয়া পুরো জাতি তার নিজের শরীরে ক্ষত হিসেবে দেখেছে। সৃজনশীল প্রাণের এমন অপচয় কে মানতে পারে! কিন্তু আপনার নিজের ব্যথা কি অনেক বেশি ছিল? জানা হলো না।
আশার কথা, আপনার ছড়িয়ে দেওয়া স্বপ্নের বীজ আজ লাখো তরুণের প্রাণে। যে স্বপ্নের বীজ আপনি বপন করে গেছেন, তা নিশ্চয়ই একদিন নানা বর্ণের ফুল হয়ে ফুটবে সমাজ ও সংস্কৃতির সকল স্তরে, সকল ধর্মের সকল পার্বণ আর সকল উৎসবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে রেখে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে আপনার ভূমিকা ও স্বপ্নকে আরেকবার শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে এগিয়ে নেওয়ার আপনার সফল প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আপনার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া আপনার সকল প্রকল্পের মেধাবী সহযোদ্ধা মিশুক ভাই, মিশুক মুনীরকে। স্মরণ করছি প্রিয় সহযোগী ওয়াসিম ভাই, গাড়িচালক মুস্তাফিজ ও জামালকে। আপনাদের সকলের কাজ ও কাজের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া অনেক স্মৃতি আমাদের পাথেয় হয়ে আছে, থাকবে।
আপনি বলতেন, ‘সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে রিলে-রেসের মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়।’ নতুন প্রজন্ম আপনার চাওয়ার মতো করেই তৈরি হচ্ছে আপনার দেওয়া আলোকবর্তিকাটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা জানি, চলচ্চিত্র সংস্কৃতির উত্তরণেই আপনার অসমাপ্ত কাজের পূর্ণতা। আপনার আত্মার প্রশান্তি।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আমরা সকলে আপনাদের শান্তি কামনা করি সব সময়।