শক্তির কবিতা
সুন্দর থেকে হাত পেতে নেয় হৃদয়

অজগরের মাথায় জলে মণির মতো ভোর,
ক্লান্ত বীর এবার ফের ফেরার ঘরে তোর
মা হয়েছেন ফটিকজল, পিতা জোনাক পোকা,
ভিটের ভাঙা ধুলোয় কাঁদে ছাতার-পাখি একা
(প্রত্যাবর্তিত /হে প্রেম হে নৈঃশব্দ)
শিল্প-সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনে যে বিপুল পরিবর্তনসাধিত হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় জোয়ার লেগেছে নাগরিক সমাজে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সব আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর এক অত্যাধুনিক জীবনকে বেছে নিয়েছে মানুষ। এই নাগরিক জীবনে অজস্র ভোগবিলাসের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এর কৃত্রিমতা, ভণ্ডামি ও ক্রুরতা মানুষকে কোনো কোনো সময় অস্থির করে তোলে। ফলে কিছুটা পরিত্রাণ বা পরিতৃপ্তির আশায় কেউ কেউ ফিরে যেতে চান প্রকৃতির কাছে; যেন শৈশব-কৈশোরের আদরমাখা নিসর্গের কাছে প্রত্যাবর্তন। এরকম প্রত্যাবর্তনেরই ইঙ্গিত মেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উপর্যুক্ত পঙক্তিগুলোতে। এবং আরো অনেক কবিতায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়—পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত এক কিংবদন্তি নাম। ব্রিটিশ-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের শুরুটা ওই পঞ্চাশের দশকেই। পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে যাওয়া তখনকার বাংলা কবিতা এক নতুন উন্মাদনায় নব-অভিমুখসন্ধানে অগ্রগামী। ব্রিটিশদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব অংশের কবি-লেখকেরা ভাষিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, পশ্চিম বাংলার সাহিত্যচর্চাকারীদের তা হতে হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠিত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসরমান হওয়াটাই সহজ ছিল। কিন্তু সহজ জিনিসকে সহজভাবে নেওয়া এবং তার গতানুগতিক প্রকাশ ঘটানো প্রতিভাবান লেখকের ধর্ম নয়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো মেধাবী এবং কিছুটা প্রথাবিরোধী ভাবনার কবির পক্ষে সেই প্রথাগত পথের বাইরে কিছু অনুসন্ধান করাটাই স্বাভাবিক। তাঁর হাংরি আন্দোলনে যুক্ত হওয়াটা সেই প্রথাবিরোধিতারই সাক্ষ্য বহন করে। ২৫ নভেম্বর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে, পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর গ্রামে ব্রিটিশ ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া এই কবি জীবনযাপনে প্রচণ্ড বোহেমিয়ান ছিলেন, কিন্তু কবিতায় ছিলেন খুব যত্নবান। তাঁর কবিতায় একই সঙ্গে আধুনিক এবং ক্লাসিক ধারার অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে, যা তাঁর পাঠকের জন্য এক ভিন্নমাত্রার নান্দনিক আবেদন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। প্রেম ও নাগরিক জীবন শক্তির কবিতার প্রধান আলেখ্য হলেও এবং কলকাতাতেই কবিজীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও পল্লী প্রকৃতি ও নিসর্গ তাঁর কবিতার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। নাগরিক জীবনের ইট-কাঠ-পাথরের রুক্ষতার ভেতরেও তিনি অবলীলায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন নিসর্গের নমনীয় নূপুর নিক্বণ। শক্তির অধিক পরিচিত অনুষঙ্গের বাইরে এসে, এই নৈসর্গিক আবহটার দিকে একটু নজর দেওয়া যেতেই পারে।
মানুষ এমন এক প্রাণী, যারা বাঁচার জন্যে মানুষের মাঝে থাকতে চান; আবার বাঁচার জন্যেই মানুষের থেকে দূরে যেতে চান। একটি ভালোবাসায় বাঁচা, অন্যটি ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচা। মানুষের সংস্পর্শ কাঙ্ক্ষিত, অথচ সেই মনুষ্যসঙ্গ এমনই অসহ্য হয়ে উঠতে পারে মাঝেমধ্যে যে, সেই চিরচেনা মানুষ থেকেই দূরে থাকতে সাধ হয় মানুষের। কোনো কোনো আধুনিক কবি তো মানুষের মিতালিকে ‘জঘন্য’ বলতেও দ্বিথা করেন না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে—
মানুষের সংঘ থেকে সরে এসে মাথা করি নিচু
বনের ভিতরে ঝর্ণা, তার কাছে যাবো
মুখটি বাড়িয়ে তার শান্তি ও কল্যাণ বুকে পাবো
আর কোনো কিছু যাঞ্চা নেই।
শান্তির খোঁজে, শক্তির খোঁজে, প্রণয় কিংবা প্রণয়স্পদের খোঁজে, সত্য ও সুন্দরের খোঁজে নিসর্গের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে শক্তি বলেছেন, ‘পথে পড়ে আছে চাঁদ, তাকে নাও তুলে /সংকেতের মতো রাখো এ কৃষ্ণ সিঁথিমূলে /জঙ্গলের, আর নিজে পাহাড়ে দাঁড়াও—/চূড়ায়, আকাশ এসে তোমায় শুধাবে; /এপথে নিঃশব্দে যাও, তার দেখা পাবে। /গাছ আছে, পাখি আছে, চাঁদ আছে জলে /ঐখানে ঢাকো মুখ শান্ত করতলে— /তার দেখা পাবে, যদি চাও /জলে শুয়ে আছে চাঁদ, তাকে তুলে নাও’।
নিসর্গ ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ হলো সবুজ বর্ণে। আর এই সবুজের প্রধান প্রতিভা হলো বৃক্ষ। যে-স্থানে যত বিপুল ও বিচিত্র বৃক্ষের অবস্থান, সে-স্থান ততই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। প্রেম কিংবা প্রেমের দেবতাকে কাছে পেতেও বৃক্ষের কাছে কান পেতেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়—
বড়ো দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো, দেবতা আমার
শিকড়ে, বিহ্বল-প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
(পাবো প্রেম কান পেতে রেখে)
কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে যেমন সন্ধ্যার কথা মনে থাকে না, তেমনি সাময়িক নাগরিক চাকচিক্যে মানুষ ভুলে থাকে তার নিসর্গ দেবতাকে। যখন মনে হয়, এই ভুলে থাকাটা ভুল; তখনই সে ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে, বৃক্ষের কাছে; বৃক্ষকেই মনে করে চিন্ময় সত্ত্বা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সন্দেহাতীতভাবেই বৃক্ষপ্রেমিক কবি। আঙিনার গাছটিকে তাঁর মনে হয়—‘পিতৃপুরুষের স্নিগ্ধ স্মৃতির মতন কেশপাশ এলিয়ে’ ছায়া দিচ্ছে। আর চারদিকে যখন খররৌদ্র এবং গ্রীষ্মের দাবদাহ, তখন মনে হয় ‘সীমাহীন রোদের ভেতরে যেন ঠান্ডা প্রেম তার কুয়োতলা নিয়ে আছে কাছে।’ শুধু কি তাই? শক্তির কবিতায়—মানুষের ‘শান্তি ও অগ্নি’ তথা প্রশান্তি ও প্রতিহিংসা-পরায়ণতার বিপরীত পারম্পর্যের মাঝে গাছই স্বস্তির ‘প্রকৃত চিন্ময়’ রূপ ধারণ করে বসে আছে মাটিতে। মানুষ যেখানে প্রলোভন আর প্রাপ্তিযোগের প্রতিযোগিতায় একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মানসিক-শারীরিক উভয় দিক থেকে, সেখানে ‘একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে’ দেখা যায় না কখনো। তাই স্নেহ-ভালোবাসা, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রয়োজনে একবারের জন্য হলেও গাছের কাছে আশ্রয় পেতে চেয়েছেন কবি। আকুল প্রার্থনার মতো করে বলেছেন :
ও গাছ, আমাকে নাও, মুহূর্তের জন্যে হলে নাও
তোমার ভেতরে আমি ধীর বেড়ে ওঠা দেখে আসি।
পাথরের মতো স্তব্ধ তুমি নও, সম্প্রীতি রয়েছে
রস আছে, স্নেহ আছে, ভালোবাসা, বিবেচনা আছে,
(ও গাছ, আমাকে নাও)
বস্তুত, সবুজের প্রতি, গাছের প্রতি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রবল অনুরক্তই ছিলেন। ‘আমি দেখি’ নামক কবিতাটির শুরুতেই বলেছেন, ‘গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও /আমার দরকার শুধু গাছ দেখা /গাছ দেখে যাওয়া /গাছের সবুজটুকু শরীরে দরকার /আরোগ্যের জন্যে ঐ সবুজের ভীষণ দরকার।’
বহুদিন শহরে কাটানো, শহুরে অসুখে আক্রান্ত যে-কোনো মানুষের জন্যে গাছ অক্সিজেনস্বরূপ। শক্তির দেহমন জুড়েই সেই অক্সিজেনস্বরূপা গাছের আবাহন : ‘চোখ তো সবুজ চায় /দেহ চায় সবুজ বাগান।’ এই সবুজ বাগানের সন্ধানেই কবি গাছের ভিতরে গিয়ে বসেন, গাছের পরিচর্যা করেন, গাছের সঙ্গে প্রেম আদান-প্রদান করেন। কিন্তু সকল কবিই যেমন প্রকৃত কবি নয়, তেমনি সকল গাছও নয় কাঙ্ক্ষিত গাছ। শক্তি বলেন,
সকলেই গাছ নয়, কিছু কিছু
আগাছাও আছে,
তাদের নিড়–নি দিয়ে তুলতে হয়, গাছ
গাছ সুখে থাকে
(গাছ কথা বলে)
গাছ শুধু সবুজের আধার নয়, ফুলেরও সমাহার ঘটায়। এবং ফুলের সৌন্দর্য এমনই যে, গাছের অন্য সকল সুন্দরকে ছাপিয়ে তার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে যায় মানুষের। নিসর্গরাজ্যের সবচেয়ে দ্রুত দৃষ্টি আকৃষ্টকারী এই ফুল, তার দৃশ্য ও সৌরভ দিয়ে কেবল কবি নয়, সমগ্র মানবসমাজকেই প্রমুগ্ধ করে রাখতে সক্ষম। ভারতবর্ষের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক—সকল সাহিত্যেই ফুলের বিপুল ও বিচিত্র নন্দনরাজ্য পরিদৃশ্যমান। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ফুল আভিজাত্যময়; অধিকাংশই সেখানে গৃহ ও কাননবাসী, মানুষের সযত্নলব্ধ কুসুমরাজি। জীবনানন্দই বাংলা কবিতাকে অনভিজাত এবং ভদ্র সমাজের দৃষ্টির প্রায় অগোচরে থাকা মেঠো ফুলের অজানারাজ্যে স্থাপন করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় অভিজাত-অনভিজাত নির্বিশেষে নিজস্ব আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত দৃষ্টি দিয়েই দেখেছেন ফুলকে। ‘কেউ নেই’ নামক কবিতার প্রথম দুটো স্তবকে ফুলগুলি তার নিজস্ব প্রতিভাতেই প্রস্ফুটিত :
কে আছে ওখানে, কে হে
হয়তো আমার চেয়ে ছোটো—
গাছের ফুলগুলি ফুটে ওঠো।
মৃত্যু ও মানুষে কিছু পেয়ে
কে আছো ওখানে? তুমি কে হে?
হয়তো আমার চেয়ে ছোটো—
গাছের ফুলগুলি ফুটে ওঠো।
এই ফুল শক্তিকে নিসর্গের প্রতি আকৃষ্ট করে, ফিরে যেতে বলে পাহাড়ের কাছে, ঝর্ণার ধারে। আবার গ্রাম্য আকন্দ ফুল কবিকে এনে দেয় স্মৃতিময় বেদনা। সন্ধেবেলা ইস্টিশনের কোমরের আকন্দ ফুল দেখে প্রিয় মানুষের নাকছাবির কথা মনে পড়ে, জেগে ওঠে বিরহ। আর ‘বিরহ তার পাত্র থেকে আগুন ঢালছে’ কবিতায় ফুল হয়ে উঠেছে প্রেম ও বিরহের স্মৃতিপ্রবাহের অনিবার্য অনুষঙ্গ :
এই এখানে, থাকতো যখন, এক বাগানে থাকতো একা—
সঙ্গে ছিলো পুষ্প বকুল, কৃষ্ণচূড়া আমার দেখা।
আর ছিলো যুঁই কনকচাঁপা, পোড়াকপাল থলকমলা,
সমগ্রে তার চক্ষু প’ড়ে থমকে যেতো আমার চলা।
নিসর্গময়তা কেবল মৃত্তিকা ও বৃক্ষপ্রসূত নয়, আকাশেও বিরাজমান। আকাশের আছে অতুল্য এক চাঁদ। চাঁদকে বলা যেতে পারে প্রকৃতির সবচাইতে প্রভাবশালী নান্দনিক অনুষঙ্গাদির অন্যতম। চাঁদের আলোর উদ্ভাসিত মোহময় রাত মুগ্ধ করেনি, উদ্বেলিত করেনি, সৌন্দর্য ও সুরমূর্ছিত করেনি—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আবহমান কালের বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত—কবিতায় চাঁদের অস্তিত্ব অদ্বিতীয়রকমের উজ্জ্বল। নারী সৌন্দর্যের বর্ণনায় এককালে চাঁদের আগমন ছিল অনিবার্য। বিশশতকের বাংলা কবিতা চাঁদকে প্রথম ব্যতিক্রমী দিগন্ত দিয়েছিল। চিরকালের নৈসর্গিকতা হারিয়ে চাঁদ হয়ে উঠেছিল ‘কাস্তে’ কিংবা ‘ঝলসানো রুটি’র মতো রুক্ষ ও প্রখর। অন্যভাবে বলা যায়, তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতা চাঁদকে নিসর্গের নান্দনিক গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ের কবিতারাজ্যে চাঁদ তাই উভয় রূপই পরিগ্রহ করেছে। সাতচল্লিশের দেশবিভাগোত্তর বাংলা কবিতা; দুই বাংলাতেই, চাঁদ ও চাঁদের আলো নিসর্গের সৌন্দর্য এবং বাস্তবের মালিন্য উভয়কেই পঙক্তিভুক্ত করেছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়ও চাঁদ তার জ্যোৎস্নাসহ অনন্য উপমায় উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো’র ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’ কবিতায় জীবনানন্দীয় আবেশ অতিক্রম করে চাঁদ হয়ে উঠেছে সীমার মাঝে অসীমের এক অভূতপূর্ব উৎসারণ :
ভুলে যেয়ো নাকো তুমি আমাদের উঠোনের কাছে
অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে।
এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু’র সেই বিন্দুতে সৌন্দর্যের সিন্ধুরূপ দর্শন! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আরো অনেক কবিতায় অনবদ্য উপমা-চিত্রকল্পের পসরা সাজিয়ে হাজির হয়েছে চাঁদ। চাঁদ কখনো ধানক্ষেতে নেমে এসেছে, কখনো স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুৎচমকের মতো জাগিয়ে রেখেছে মানুষকে। সৌন্দর্যপিপাসু কবি সুন্দরের সামনে নতজানু হয়েছেন, সৌন্দর্যের সন্ধানে ভিখারির মতো হাত পেতেছেন; আবার বিজয়াদশমীর বিষণ্ণতায় চাঁদকে দেখেছেন পোড়া চেহারায়। যে চাঁদকে টাকার মতন মাথার ওপরে ভাসতে দেখেছেন, সেই চাঁদকে বিচিত্ররূপে উপলব্ধি করেছেন ‘কক্সবাজারে সন্ধ্যা’ কবিতায়। চাকমার পাহাড়ি বস্তি, বুদ্ধমন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে ডাকহরকরা চাঁদ শুভেচ্ছা জানাতে চায় মেঘপল্লীর ঘরে ঘরে। বাঁশের ঘরের ফাঁকা দিয়ে ‘ফালা ফালা দোচোয়ানি চাঁদ’ একই সঙ্গে বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও চাকমার মুখশ্রীকে ধারণ করেছে। ‘মাথার উপর অ্যালুমিনিয়াম চাঁদ’ কবিতায় চাঁদের রূপের ফাঁদে সাপের মতো আটকা পড়ার ইঙ্গিত আছে। তবে চাঁদ যে কবির বেঁচে থাকবার অনুপম প্রেরণা ও অনুষঙ্গ, সেটা বোঝা যায় ‘বেঁচে আছি’ কবিতায়। কবি বলেন,
কিছু না থাক শ্মশানের জন্য দরজাটাই খোলা
ধানের গোলা
ছাই
দিগন্তে বাজখাঁই
চাঁদের আলো
ভালো-
না বাসার অর্থ- কাঠিন্য
সবার জন্য
শ্মশানের দরজাটাই খোলা
ধানের গোলা
ছাই
দিগন্তে বাজখাঁই
চাঁদের আলো
ভালো
ওটুকুর জন্যেই বেঁচে আছি।
চাঁদ কিংবা সূর্য মানেই স্বচ্ছ আকাশ; কিন্তু আকাশ সব সময় স্বচ্ছ থাকে না সম্পূর্ণ, মেঘেও ভরে যায়। চাঁদ-সূর্যের চাইতে অধিক প্রতিপত্তিশালী নয় মেঘ, তবু ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে সময়কে ভিন্নদৃশ্যে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়। মেঘেঢাকা এরকম একটি সময়চিত্রের সন্ধান মেলে শক্তির ‘বাঘ’ কবিতায় :
মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে
চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুলো বনে...
এই মেঘ যতটা তার নিজস্ব স্বভাবের, তার চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসার অনুকূল আবহে প্রতীয়মান। অন্যদিকে ‘নামছে মেঘ’ কবিতাটিতে ‘কার্নিশের গা থেকে গুঁড়ি মেরে’ যে মেঘ নামে, তা সময়ের রুক্ষতা ও নেতিবাচক বাস্তবতাকে ধারণ করেছে। আবার ‘চাঁদের দেশে’ কবিতায় দেখি দিনের স্মৃতিতে সূর্যের আর রাতের আঁচড়ে চাঁদের দেশের গতি থেমে যায়—
এখন যেতে সর্ষে ক্ষেতে উল্টে পড়ে মেঘ—
হট্রাপেটা চাঁদের দেশে থামে হাওয়ার বেগ।
মেঘের উপস্থিতি বৃষ্টির আগমনকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। মেঘযুক্ত কবিতাগুলিতে তাই বৃষ্টির আবির্ভাববার্তা ধ্বনিত হতে পারে। বাংলা কবিতায় বৃষ্টির প্রভাব এমনই যে, কেবল রবীন্দ্রনাথই বৃষ্টিকে দৃশ্যপটে রেখে রচনা করেছেন শতাধিত গান! রবিঠাকুরের বৃষ্টিপর্বের যে অভিজাত ঐশ্বর্য, পরবর্তী বাংলা কবিতায় সে আভিজাত্যে প্রচুর বৈচিত্র্য এসেছে। বৃষ্টি যে কেবল প্রণয় ও রোমান্সের নয়, সবুজের প্রেরণার নয়; বেদনা ও বিহ্বলতারও বটে, তা আধুনিক কবিরা যথার্থই উপলব্ধি করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় বৃষ্টি হয়ে উঠেছে বেদনার; যতটা বাইরের, তার চেয়ে অধিক ভেতরের। হ্দয়ের অশ্রুক্ষরণ সেখানে বড় হয়ে উঠেছে। এমনকি মৃত্যুচেতনাও জেগে উঠেছে অন্তরে। বহুল আবৃত্তিধন্য কবিতা ‘যখন বৃষ্টি নামলো’তে বৃষ্টিস্নাত প্রণয়িণীকে খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় সে আজানুলম্বিত কেশ ভিজিয়ে শিউলি গাছের তলায় নয়, বুকের ভেতরেই ঝরাচ্ছে তুমুল বৃষ্টিপাত। কবির ভাষায়—
হয়তো মেঘে বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাইরে—অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে !
অপর এক বিখ্যাত কবিতা ‘অবনী বাড়ি আছো’তে মৃত্যুচেতনাই ব্যক্ত হয়েছে গভীর ব্যঞ্জনায়। নিশীথের নৈসর্গিক চিত্রকে এক শিহরণযোগ্য ভীতিসঞ্চারী রূপ দিয়েছেন তিনি এ-কবিতায় :
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাক্সমুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে—
‘অবনী বাড়ি আছো?’
প্রকৃতি এখানে বিরূপ। সবুজ ঘাসও ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ। ‘অবনী’ এখানে ব্যক্তিমাত্র নয়, পৃথিবী; পৃথিবীর জীবিতের সার্বিক রূপ হয়ে উঠেছে। জেগে উঠেছে মরণের অশরীরী আহ্বান। কবিতাটির বহুবিধ ব্যঞ্জনাবহুল এই কবিতাটি শক্তির নামের সাথে সেঁটে আছে অবিচ্ছেদ্য আঠায়।
গাছ-পাতা, ফুল-পাখি, মেঘ-চাঁদ ইত্যাদির বাইরেও রয়েছে নিসর্গসুন্দরীকে অনুভবের অজস্র অনুষঙ্গ। দিন-রাতের প্রত্যেকটি সময়ই এক-একটি আলাদা আলাদা নিসর্গদৃশ্য তৈরি করে স্থান-পাত্র ভেদে। নদীতীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য বরাবরই মনোহর, কিন্তু সেই মনোহর বা নান্দনিক দৃশ্যের বাইরে এক ভিন্ন অনুভবে উঠে এসেছে শক্তির কবিতায় : সন্ধ্যায় নদীর গান মন্থর লেগেছে /দীর্ঘদিন পর /আলুথালু জেগে ওঠে চর /বালি /জঙ্গলের থেকে নীল কালি /মিশেছে নদীতে /সন্ধ্যায় /নদীর গান মন্থর লেগেছে। /নদী তো দুপুরেও ছিল সকালেও ছিল /বেগবান গতি ছিল জলে /এখন কুয়াশামাখা সন্ধ্যার কম্বলে /মন্থরতা আসে’ (সন্ধ্যায়)। সন্ধ্যা শেষে আসে রাত। রাতের গভীরতায় নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার আহ্বান পেয়ে কবি লেখেন, ‘এখন নিথর রাত্রিবেলা /জলের ধারে কেবলি হয় জলের খেলা /অবর্তমান তোমার হাসি ঝাউয়ের ফাঁকে /আমায় গভীর রাত্রে ডাকে’ (ঝাউয়ের ডাক)।
এভাবে একের পরে এক প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গকে সাবলিল ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতাকে নান্দনিক করে তুলেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। নিবিড় নিসর্গসংযোগে স্থাপন করেছেন আপন আনুভূতিক সমঝোতা। প্রণয়ে-বিরহে, মিলনে-বিচ্ছেদে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে মানবহৃদয়ানুভূতির অনিন্দ্য সহযোগী। হৃদয়ে প্রেম জাগলে প্রকৃতি হয়ে ওঠে প্রণয়স্পর্শী; বিরহ হানা দিলে প্রকৃতির গায়ে লাগে বেদনার দাগ। প্রকৃতি তার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো নিষ্ঠুরতা নিয়ে কখনও কখনও মানুষের জন্য ভয়ংকর বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে তবুও প্রকৃতি বা নিসর্গের প্রতি মানুষের ভেতরের যে টান; আনন্দ-বেদনার অনুভূতিকে নৈসর্গিক উপমায় বিশ্লিষ্ট করবার যে মানসতা; সাহিত্যকে, বিশেষত, কবিতাকে নিসর্গগামী করেত বাধ্য করে চলেছে।
এমনকি শহুরে জীবনের বিলাস-ব্যবচ্ছিন্ন স্বার্থঘেরা জীবনে দীর্ঘবাস কাটিয়েও আমরা ফিরে যেতে চাই অপু বয়সের নিসর্গস্মৃতিতে। সেই পুরানো গাছের নিচে বিশ্রাম, ঝড়-বৃষ্টিতে রৌদ্রে-শিশিরে স্নাত বাল্যকাল, কাগজের নৌকা ভাসানো যে শ্রাবণ-আঙিনা কিংবা জ্যোৎস্নারাতে ঝরাপাতার যে অরূপ কথকতা—কোনোদিনই কি ফিরে পাবো আমরা? হয়তো না। না বলেই কবিতার হাত ধরে আমাদেরকেও যেতে হবে নিসর্গসুন্দরের কাছে। সময় উপযুক্ত হলে নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসের কাছে গেলে শক্তির মতোই মনে হবে—‘সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়’।