নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা : সরল-সুন্দর-গভীর মায়া

কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক
বুঝতে-বুঝতে
অন্ধকারে নিজের বাড়ি
খুঁজতে-খুঁজতে
চিহ্নগুলি চিনতে বেজায়
ভুল করেছি,
সবটা সময় রাস্তাঘাটেই
ফুরিয়ে ফেলে
শেষকালে এই ভুল ঠিকানায়
পৌঁছে গেছি।
(ঠিকানা)
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘অমলকান্তি’র মাধ্যমে। ‘অমলকান্তি সে-সব কিছুই হতে চায়নি।/ সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!’ ক্যাসেট প্লেয়ারে প্রথমবার শুনেই চমকে গিয়েছিলাম। মানুষ আবার রোদ্দুর হতে চায় নাকি? কেনোই বা চায়? কিন্তু কবিতাটির আবৃত্তি যখন শেষ হয়, আবার শুনেছিলাম আঙুল দিয়ে ক্যাসেটের ফিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। পরে আরো কতবার যে শুনেছি কবিতাটি! এবং মনে মনে নিজের ভেতরেও কেমন যেন রোদ্দুর হওয়ার বাসনার জন্ম দিয়েছি! একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, প্রথম শ্রবণের সময় পর্যন্ত জানতাম না যে, কবিতাটি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা। তখন বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত কবির কবিতার সঙ্গে কমবেশি পরিচিত হলেও নীরেন্দ্রনাথের নামটা প্রায় অচেনাই ছিল। ‘অমলকান্তি’র পরে এই কবির কিছু কিছু কবিতার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি বিচ্ছিন্নভাবে।
গ্রন্থাকারে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় কাব্য নয়, ‘কবিতার ক্লাস’ নামের গদ্যের বইটির মাধ্যমে। আমি তখন লেখক হওয়ার পূর্ববাসনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হয়েছি। কবিতা লেখার প্রথম বয়সের উন্মাদনা একটু ভাবনা-চিন্তার ভেতরে পড়ে থিতিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। কবিতা লিখতে গেলে ছোট ছোট লাইনে শুধু আবেগের সংক্ষিপ্ত ও ইঙ্গিতময় প্রকাশ করলেই চলবে না, ছন্দটাকেও জানতে হবে; এ রকম একটি প্রস্তুতির প্ররোচনা চলছে মাথার ভেতরে। এই বইয়ের সূচিপত্রে চোখ রাখতেই চমকিত ও আমোদিত হলাম সে-সময়, ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’! এ-দেখি জীবনানন্দ দাশের বিপরীত মেরুর অবস্থান! যাক, তাহলে আমারও কবি হওয়ার আশা আছে! বলা বাহুল্য, আমার তখন জীবনানন্দ দাশে মজে আছে মন। তুমুল আগ্রহ নিয়ে পাতার পর পাতা পড়ে যাই ‘কবিতার ক্লাস’ বইটি। পড়তে পড়তে মনে হয়, সত্যিই কেউ যেন ক্লাস নিচ্ছেন! কবিতা রচনা ও ছন্দ বিন্যাসের অতি সরল ও সুন্দর সমাধানের সূত্র দিচ্ছেন ছন্দরসিক শিক্ষকের মতোই। বাংলা কবিতার কবিতার তিন প্রধান ছন্দ—অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা জন্মে যায় আমার ভেতরে। আটপৌরে জীবনের পরতে পরতে যে ছন্দ থাকতে পারে, সেই ছন্দকে একটু পালিশ-টালিশ করলে যে কবিতা হতে পারে; এই ধারণা নীরেন্দ্রনাথই দিলেন আমাকে। এরপর হাতে নিই তাঁর ‘কবিতা কী এবং কেন’ বইখানি। প্রথম প্রবন্ধ ‘কবিতা কী’-তেই কবিতা চেনার একটা সহজ সূত্র ধরিয়ে দিতে গিয়ে গল্পের মতো করে বলেন :
“ধরা যাক, আমরা শিকার করতে বেরিয়েছি। ধরা যাক, আমরা একটি সিংহ শিকার করব। কিন্তু যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সিংহ সেখানে সত্যি-সত্যি আছে তো? কীভাবে বুঝব যে, সে আছে ? ধরা যাক, একটু আগেই আমরা তার গর্জন শুনেছি। কিংবা নরম মাটিতে দেখেছি তার পায়ের ছাপ। সেই শোনা কিংবা সেই দেখার উপরে নির্ভর করে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। দূরের একটা ঝোপ যেন একটু নড়ে উঠল। সিংহ? আমাদের প্রত্যেকেরই স্নায়ু একেবারে টান-টান হয়ে আছে। হৃৎপিণ্ড উঠে এসেছে মুখের মধ্যে। আমরা প্রত্যেকেই ভাবছি যে, আর দেরি নেই, এইবারে হয়তো যে-কোনও মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
“ধরা যাক, ঠিক এইভাবেই একটি কবিতার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। আমরা শুনেছি যে, কবিতা কিছু অসম্ভব শশবিষাণের ব্যাপার নয়, কবিতা বলে সত্যিই কিছু আছে, এবং আমাদের ধারেকাছেই আছে। তাই আমরা আশা করছি যে, আমাদের অন্বেষণ বিফলে যাবে না, যে-কোনও মুহূর্তে আমরা তার দেখা পাব।
“কিন্তু দেখা পাওয়াই যথেষ্ট নয়, দেখা যখন হবে, তখন তাকে চিনে নিতে পারব তো?”
তাই তো, কবিতা কবিতা বলে যতই উদ্গ্রীব হই, কবিতা তো সিংহ নয় যে, পূর্ব-ধারণা থেকে সহজে চিনে নেওয়া যাবে। সুতরাং প্রকৃত কবিতা চেনার উপায় অনুসন্ধানের যে আগ্রহ, তাতে অসামান্য সহায়ক হয়ে উঠতে চাইলো ছোট্ট ও সরল-সুন্দর এই বইটি। এরপর যখন এই কবির কবিতারাজ্যে প্রবেশ করতে শুরু করলাম, এই সরল-সুন্দর রূপটি অক্ষতই থাকল। কিন্তু এই সরল-সুন্দরের মাঝে ধরা দিল অনন্য-গভীর এক মায়ার পৃথিবীও।
২.
সময়ের হিসেবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বিশ-শতকের পঞ্চাশের দশকের একেবারে প্রথম লগ্নে আবির্ভূত কবি। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে অক্টোবর জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অখণ্ড বাংলায়, তখনকার পূর্ববঙ্গ আর আজকের বাংলাদেশে। ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামের জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও প্রফুল্লনলিনী দেবীর সন্তান নীরেন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময়ই কেটেছিল পূর্ববঙ্গের শ্যামল পল্লীর জল-হাওয়াতেই। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ১৯৪২-এ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস শেষে ইতিহাসে অনার্স করেছিলেন সেন্ট পলস্ কলেজ থেকে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লিখলেও ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৬ বছর বয়সে, ‘শ্রীহর্ষ’ নামক একটি পত্রিকায়।
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘নীল নির্জন’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রথম কাব্য। এরপর একে একে ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘খোলা মুঠি’, ‘কবিতার বদলে কবিতা’, ‘আজ সকালে’, ‘পাগলা ঘণ্টি’, ‘ঘর দুয়ার’, ‘সময় বড় কম’, ‘যাবতীয় ভালবাসাবাসি’, ‘ঘুমিয়ে পড়ার আগে’, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’, ‘আয় রঙ্গ’, ‘চল্লিশের দিনগুলি’, ‘সত্য সেলুকাস’, ‘সন্ধ্যাকাশের কবিতা’, ‘অন্য গোপাল’, ‘জলের জেলখানা থেকে’, ‘কবি চেনে, সম্পূর্ণ চেনে না’, ‘ভালবাসা মন্দবাসা’, ‘মায়াবী বন্ধন’ প্রভৃতি ৩০টির মতো কাব্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। আছে ‘পিতৃপুরুষ’ নামে একটি উপন্যাস এবং ‘প্রথম নায়ক’ শিরোনামে একটি কাব্যনাট্য। বিখ্যাত ‘কবিতার ক্লাস’ এবং ‘কবিতা কী ও কেন’ ছাড়াও ‘কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা’, ‘সমাজ সংসার’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমরা এবং অন্যান্য রচনা’ এবং ‘বাংলা লিখবেন, কেন লিখবেন’ এগুলো কবির গদ্যের বই।
একাধিক ভ্রমণকাহিনী এবং বেশকিছু রহস্যকাহিনীর জনক তিনি। ছন্দে অসামান্য দক্ষতার অধিকারী এই কবির ১৫টির অধিক ছড়া-কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের পাকিস্তানি আমল ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন ‘আইয়ুবের সঙ্গে’ নামক গদ্যের বইটি। গদ্য-পদ্য-রহস্য মিলিয়ে বেশ কয়েকখণ্ডে বের হয়েছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর রচনাসমগ্র। ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যের জন্য ১৯৭৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন উল্টোরথ পুরস্কার, তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার প্রভৃতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক পেয়েছেন ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মাননা। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২৫শে ডিসেম্বর ২০১৮তে অনেকেই যখন যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনের উৎসবে চঞ্চল, তখন, দুপুর ১২টার দিকে কলকাতার যিশু নামে খ্যাত এই কবি ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
৩.
জীবন যখন রৌদ্র-ঝলমল,
উচ্চকিত হাসির জের টেনে,
অনেক ভালবাসার কথা জেনে
সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছল
নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা
রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিয়ো,
অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিয়ো
আর কিছু নয়, আলোর ভালোবাসা।
১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ৯ই ভাদ্র লিখিত এই কবিতায় খুব সরলভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন জীবনের একটি অনিন্দ্য আকাঙ্ক্ষা ‘আলোর ভালোবাসা’র কথা। সমগ্র সাহিত্যজীবনেই আলোর ভালোবাসার প্রতি কবির এই আকাঙ্ক্ষা অটুট ছিল। এবং সমাজের সমস্ত মানুষকেও এই আলোর ভালোবাসার সন্ধান দিতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ফলে মারণাস্ত্র-হত্যা-ধ্বংস-মৃত্যু সবকিছুতে ব্যথিত হয়েও তিনি সত্যের অনুকূলে সাহসী থাকতে সমর্থ হয়েছিলেন। সক্ষম হয়েছিলেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে খুব সরল ভাষাতেও অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক করে পরিবেশন করতে। ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সবার জানা উলঙ্গ রাজার গল্পটিকে খুব সরলভাবেই যখন উপস্থাপন করতে শুরু করেন, তখন গল্পটা যারা আগের থেকেই জানেন, তাদের কাছে খুব একটা আগ্রহ থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন তিনি দ্যাখেন রাজা যে উলঙ্গ, এই সত্যটি জনসমক্ষে প্রকাশ করবার সেই সাহসী শিশুটি কোথাও নেই, তখন তিনি বলেন ওঠেন,
শিশুটি কোথায় গেল ? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায় ?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক :
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
সরল, কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের খুব গভীরের নগ্নতাকে এভাবে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করবার পাশাপাশি সমাজকর্তাদের শুধরে দেওয়ার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে যায়, এমন সত্যোচ্চারণের মানসিকতাসম্পন্ন শিশুর মতো কাউকে খুঁজেছেনও বৈকি। সমাজের অধিকাংশ মানুষই যখন ক্ষমতাবানদের অন্ধ অনুগামী, প্রবলভাবে তোষামোদকারী, অপরের কৃপাবঞ্চিত হওয়ার আতঙ্কে সত্যানুসরণে অনাগ্রহী, তখন স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চেয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শিশু চরিত্রকে খুব সাবলীল অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে উপস্থাপনের নজির এই কবির একাধিক কবিতাতেই বিদ্যমান। ‘কলকাতার যিশু’ নামের আরেক বিখ্যাত কবিতাটিতেও দেখি ভিখারি-মায়ের উলঙ্গ এক পথশিশুর নিরুদ্বেগ পথ চলার চিত্র। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় ঝড়ের বেগে ধাবমান গাড়িগুলোকে অতর্কিতে থামিয়ে দিয়ে রাস্তা ক্রস করতে থাকা শিশুটিকে শেষ পর্যন্ত অসীম এক ব্যঞ্জনার প্রতিনিধি বানিয়ে তুলেছেন :
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি কোন মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই ;
দু’দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টাল্মাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।
এ রকম সাধারণ দৃশ্য, কিংবা সাধারণের চোখে গুরুত্বহীন বা খুব সামান্য মানের দৃশ্যগুলোকে দেখতে দেখতে, দেখাতে দেখাতে অসামান্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যান নীরেন্দ্রনাথ। বিশেষ কোনো প্রয়াস ছাড়াই পাঠককেও পৌঁছে দেন সেই উচ্চতায়, বা তার কাছাকাছি। পাঠকও হয়ে ওঠেন দর্শক। কখনো কখনো দর্শকের চেয়ে বেশি কিছু, দার্শনিক স্বভাবের। বস্তুত, কবির দেখাটা সাধারণ নয়। ‘চলন্ত ট্রেন থেকে’ সবাই যখন ধুধু মাঠ, ঘরবাড়ি, গাছপালা, পুকুর-নালা দ্যাখেন, কবি তখন দ্যাখেন ‘সমস্ত পৃথিবী এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের জানালায়।’
সবাই সবকিছু দেখেন না। নীরেন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা দেখি না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ একদিন/ পূর্বাকাশে সেই শুদ্ধ উদ্ভাস দেখেছে,/ যাকে দেখে মনে হত, নিহত সিংহের পিঠে গর্বিত পা রেখে/ স্বর্গের শিকারী দাঁড়িয়েছে।/ আমরা এখন সেই উদ্ভাস দেখি না।’ (নীরক্ত করবী) সবাই না দেখলেও কবি যে অনেক কিছুই দ্যাখেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। অন্যেরা অন্ধ হলেও, তিনি তো চক্ষুষ্মান, তাই যা দেখবার নয়, তা-ও এড়িয়ে যেতে পারে না তার চোখ। ‘অন্ধের সমাজে একা’ কবিতায় কবিকে বলতে শুনি :
রাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়কে। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
যে-কোনো মুহূর্তে ঘোর মারামারি হতে পারে, তবু
অস্ত্রগুলি উল্টানো রয়েছে আপাতত।
পরস্পরের দিকে পিঠ দিয়ে সকলে এখন
সম্মান রচনা করে। আমি দেখি,
অযুত নিযুত অন্ধ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপরে।
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই।
যুদ্ধের আয়োজনে অন্ধ, অসূয়বৃত্তির এই সমাজের চক্ষুষ্মান শান্তিপ্রিয় কবি খুব আহত হয়ে, আফশোস করে একসময় বলেন, ‘নিজের চক্ষুকে হয়তো নিজেরই নখরাঘাতে উপড়ে ফেলে দিয়ে/ অন্ধের সমাজে আজ মিশে যেতে হবে।’ কিন্তু কবি কি তা পারেন? পারেন না। তা যদি পারতেন, তাহলে তিনি আর কবি হতে পারতেন না। পারতেন না নান্দনিক পৃথিবীর স্রষ্টা হতে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী খুব ভালোভাবেই জানতেন শিল্পীর ভূমিকা কী। মূর্খের অট্টহাসি, নিন্দুকের ক্ষিপ্র জিহ্বা, কোনো কিছুই শিল্পীকে তাঁর ভূমিকা থেকে টলাতে পারে না। রাজা কিংবা সম্রাট, সকলের চাইতে যে শিল্পীর ভূমিকা ভিন্ন, শিল্পীকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে ‘শিল্পীর ভূমিকা’য় কবি লিখেছেন :
আপনি তো জানেন, শুধু আপনিই জানেন, মায়ামঞ্চে
কেউ বা সম্রাট হয়, কেউ মন্ত্রী কেউ মহামাত্য ;
শিল্পীর ভূমিকা তার, সাময়িক সমস্ত দৌরাত্ম্য
দেখার ভূমিকা। তাতে দুঃখ নেই। কেননা, অনন্ত
কালের মৃদঙ্গ ওই বাজে তার মনের মালঞ্চে।
ত্রিকালী আনন্দ তার ; নেই তার আদি, নেই অন্ত।
যথার্থ শিল্পী, ত্রিকালদর্শী হন। অতীত বর্তমনাকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দার্শনিক সত্য প্রকাশ করেন। বর্তমানের ভেতরে অনুভব করেন অনন্তকে। অন্তহীন আনন্দ-বেদনার গান গেয়ে চলেনা সারাজীবন ধরে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও তাই করেছেন। সাধারণ দৃশ্যগুলোর যেমন অসাধারণ তাৎপর্য তৈরি করেছেন, তেমনি অন্যকেও পরামর্শ দিয়েছেন প্রথাগত ভাবনার গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে দিয়ে ভিন্নভাবনার উজানে নিজেকে চালিত করার প্রয়াস করতে। বলেছেন, ‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।/ বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।/ বরং বুদ্ধির নখে শাণ দাও, প্রতিবাদ করো।/ অন্তত আর যা-ই করো, সমস্ত কথায়/ অনায়াসে সম্মতি দিয়ো না।’ (মিলিত মৃত্যু)। সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দেওয়া যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের কাজ নয়; কবির তো নয়ই। নীরেন্দ্রনাথেরও ছিলো না। বরং নিজস্ব যুক্তি ও বুদ্ধিতেই তিনি অনায়াসে তৈরি করে নিয়েছিলেন শিল্পীর এক স্বতন্ত্র পৃথিবী।
৪.
বাইরের আনন্দ যেমন ভেতরের বিষাদের খবর দেয় না, তেমনি আলোর উৎসবও পারে না গভীর অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিতে। দীপাবলীর আলো আর বাজির ধুমে যখন ঘুমশূন্য পাড়ায় ছেলে-বুড়ো সকলেই উৎসবে মাতোয়ারা তখন সেই উৎসবের দৃশ্য দেখতে দেখতে কবির চোখ চলে যায় গভীর অন্ধকারের ভেতরে, যেখানে উৎসবের আলো প্রবেশ করতে পারে না। ‘দেওয়ালি’ নামক কবিতাটিতে সে রকম একটি দৃশ্য আমাদেরকে দেখাতে চেয়েছেন কবি :
লাহিড়িবাড়ির বউ বীণা,
জানি না সে হয়েছিল কি না
মধ্যরাতে এভাবেই খুন।
ভালো আকাশের দিকে চেয়ে
ভাবছি যে, সেও ছিল কালো মেয়ে
তারও গায়ে জ্বলছিল আগুন।
হাজার আলোর উৎসবের ভেতরে যেমন লাহিড়িবাড়ির বউয়ের পুড়ে মরার কথা বলেছেন, তেমনি যে উদ্যানে মানুষ বেড়াতে যায়, আনন্দ-উদ্যাপন করতে যায়, সেখানেও খুঁজে পেয়েছেন ‘মল্লিকার মৃতদেহ’। কোমল ফুলের বাগানে হন্তারকের এই দড় কবিকে স্বস্তি দেয়নি। দেয়নি বলেই তিনি এরকম স্বাভাবিক দৃশ্যগুলোকে আর সাধারণের চোখে দেখতে পারেননি, সকল কিছুর ভেতরেই খুঁজে ফিরেছেন অসাধারণ সব চিত্রমালা। সেই চিত্রমালা খুঁজতে খুঁজতে কবি যে সবসময় কোমল-সুন্দর ভাষাই ব্যবহার করেছেন, তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে কঠোর কিংবা রূঢ় শব্দ ব্যবহারেও দ্বিধা করেননি। যেমন, ‘গুরু যা বলেন’ কবিতায় দেখি চারদিকের চাতুর্য, খুন-খারাবি কিংবা অনৈতিক সব অনাচার সত্ত্বেও সবকিছুই যখন স্বাভাবিকভাবে চলে, কেউ কিছুই মনে করে না, তখন গোষ্ঠবাবু নামক এক ব্যক্তির মুখে গুরুর বাণী শ্রবণেচ্ছুক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন :
কাউকে আবার কিছুই বোলো না যেন,
এমনিতে তো এ-সব কথা কাউকে বলতে নেই,
নেহাত তোমরা জানতে চাও তাই বলছি।
আমার গুরু বলেন যে,
শুয়োরের বাচ্চারা কেউ কিসসু জানে না।
চলমান সময়ের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে সবসময় কোমল-সুন্দর শব্দের ভেতরে সমাধান খোঁজা যে কবির পক্ষেও সম্ভব নয়, সেকথা আরো কোনো কোনো কবির ন্যায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও অনুভব করেছিলেন।
৫.
কবি, তুমি গদ্যের সভায় যেতে চাও?
যাও।
পা যেন টলে না, চোখে সবকিছুকে-তুচ্ছ-করে-দেওয়া
কিছুটা ঔদাস্য যেন থাকে।
যেন লোকে বলে,
সভাস্থলে
আসবার ছিলা না কথা, তবুও সম্রাট এসেছেন।
‘কবি’ শিরোনামে লিখিত এই কবিতাটিতে কবিকে এক অনন্য উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত দেখিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজেও কিছু গদ্য যে লিখেছেন, সে-কথা আগেই বলেছি। বলা বাহুল্য, সেখানে তিনি উপরিউক্ত সম্রাটের মতোই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গদ্য লিখেছেন কি না জানি না, কিন্তু সেই গদ্যভাষায় মোহনীয় কুসুম ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া তিনি নিজেও কোথায় যেন বলেছেন, কবিতার কাছ থেকে কদাচিৎ ছুটি চেয়ে নিয়েই তিনি গদ্য লিখেছেন মাঝে মাঝে। এবং সেই গদ্যেও যে তিনি মোহিত করেছেন পাঠককে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
শিরোনামে যে-কথা বলতে চেয়েছিলাম—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা এক সরল-সুন্দর কিন্তু গভীর মায়াময় প্রাণের জগৎ। বোধ করি খুব নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিইনি সেটা বলে। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পথে সে-বলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। সে-চেষ্টা না করে বরং কবির কবিতাপাঠের মোহন আহ্বান জানিয়ে আপাত-যবনিকা টানা যাক।