বইমেলা
তবুও থামেনি ‘জাগৃতি প্রকাশনী’

দুই-আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেছে, টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমিও হাজারো মানুষের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের সবার অপেক্ষার কারণ একটাই, কখন ঢুকতে পারব বইমেলায়। মনে মনে বলি, প্রধানমন্ত্রী একটু তাড়াতাড়ি বের হন না কেন? আশপাশের অনেকেই বলছেন, উদ্বোধনীর পর প্রধানমন্ত্রী বইমেলার স্টলগুলো ঘুরে দেখছেন, এ কারণে দেরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর আমাদের অপেক্ষা শেষে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আমরা হাজারো উচ্ছ্বসিত মানুষ বইমেলার দিকে হাঁটা দিলাম।
প্রথমেই বাংলা একাডেমি চত্বরে বিভিন্ন স্টল ঘুরে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে রঙিন সাজে সাজানো সব বইয়ের স্টল। দু-একটা প্যাভিলিয়ন দেখে মনে হলো যেন ছোটখাটো রাজপ্রাসাদ, যার তাকে তাকে সাজানো বই। যেসব স্টল এখনো সাজানো বাকি চলছে, সেসবের শেষ প্রস্তুতি। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল ‘জাগৃতি প্রকাশনী’ স্টল। চোখ আটকে গেল স্টলটির মূল ব্যানারে। বিশাল ডিজিটাল কালো ব্যানারে ‘জাগৃতি প্রকাশনী’র নিচে সাদা বর্ণে লেখা ‘সকলের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক’। সাদামাটাভাবে সাজানো স্টলটির ফ্রেমে ফ্রেমে ছেয়ে আছে শোকের ছায়া।
গত ২৩ বছর যে প্রকাশনী সৃজনশীল বই করছে অথচ বই প্রকাশের দায়েই গত বছর ৩১ অক্টোবর মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন, সেই প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা ফয়সল আরেফিন দীপন। যিনি সমাজে সুস্থধারার জ্ঞান চর্চার বিকাশের জন্য বেছে নিয়েছিলেন প্রকাশনা সংস্থাকে আর গড়ে তুলেছিলেন ‘জাগৃতি প্রকাশনী’। অথচ আজ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শোকের সপ্তভুজে মোড়ানো দীপনের প্রিয় সেই প্রকাশনী সংস্থা।
স্টলের সামনে গিয়ে দু-একটা বই নাড়াচাড়া করছিলাম, তখনো চলছিল টেবিলে বই সাজানো কাজ। স্টলের সামনে থেকেই বই সাজাচ্ছেন দীপনের সহধর্মিণী ডা. রাজিয়া রহমান। কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—আপা, জাগৃতি থেকে এবার কয়টি বই প্রকাশ হয়েছে? তিনি বললেন, ১৬/১৭টি। জিজ্ঞেস করলাম—আপা, গতবারের থেকে এবারে বইয়ের সংখ্যা বেশি না কম? তিনি বললেন, ‘এই তিন-চার মাসে সবকিছু কাটিয়ে উঠে...’, বলে কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাটা আর শেষ হয়নি। তাঁর অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে আমিও আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। কোনো কিছু না বলে একরকম পালিয়ে এলাম তাঁর সামনে থেকে। নিজের মতো করে আমিই তাঁর কথাটা শেষ করে নিলাম, তবুও থামেনি ‘জাগৃতি প্রকাশনী’।