স্মরণ
জীবনবাদী ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাক

মানবতাবাদী ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাক। পুরো নাম পার্ল সিডেনস্ট্রিকার বাক। ১৮৯২ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার হিলসবরোতে তাঁর জন্ম। পার্লের মিশনারি বাবা-মা দুজনই বিয়ের পর স্থায়ী হন চীনে।
তাঁর জন্মের সময় কিছুদিন আমেরিকায় ছিলেন পার্লের বাবা-মা। মায়ের কাছে ইংরেজি ও কিং নামের এক চীনা ব্যক্তির কাছে চীনা ভাষা শিখেন পার্ল। তবে চীনা ভাষায় তাঁর ব্যাপ্তি ঘটে বাড়ির আয়ার কাছে।
পড়াশোনার কারণে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত চীন-আমেরিকা যাতায়াতের মধ্যে ছিলেন পার্ল। ১৯১৪ সালে তিনি চীনে ফিরে জন লসিং বাক নামের একজন মিশনারিকে বিয়ে করেন। নিজেও মিশনারি হয়ে বসবাস শুরু করেন চীনের সজোতে। পরে তিনি মিশনারির কাজ ছেড়ে দেন। সেখানকার পটভূমিতে লেখেন ‘দ্য গুড আর্থ’।
১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা দুজন নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করেন। সেখানে একটি বাড়িও তৈরি করেন তাঁরা। পার্ল এস বাক পড়াতেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। মায়ের মৃত্যুর পর পার্ল বাক আমেরিকায় ফিরে যান। সেখানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষায় এমএ করেন।
নানজিং প্রদেশে থাকাকালে চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা আন্দোলনে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন পার্ল এস বাক দম্পতি। চিয়াং মাইশেকের দল, কমিউনিস্ট দল এবং কিছু যুদ্ধবাদী মানুষের সংঘর্ষে তাঁদের থাকা বেশ কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।
একপর্যায়ে চীনে বিদেশি কিছু ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে বিপন্ন হয়ে পড়েন তিনি। সে সময় স্থানীয় গরিব এক চাষির বাড়িতে লুকিয়ে থাকেন তাঁরা। পরে তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। প্রথমে সাংহাই ও পরে জাপানে পালিয়ে যান তাঁরা।
এক বছর জাপানে থাকার পর প্রাণের ভয় উড়িয়ে দিয়ে আবার তাঁরা নানজিংয়ে ফিরে যান। এরই মধ্যে ভেঙে যায় পার্লের প্রথম বিয়ে। এর পর তিনি বিয়ে করেন প্রকাশক রিচার্ড ওয়ালশকে।
চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পার্ল এস বাককে আখ্যায়িত করা হয় রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হিসেবে। সেই সঙ্গে চীন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেও তিনি চীন যেতে পারেননি। তখন বাধ্য হয়ে তিনি আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় বসবাস শুরু করেন।
পার্ল এস বাক লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অসংগতি নিয়ে লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন সমানতালে। নারী অধিকার, শিশু অধিকার, ভারতীয়দের চীনে থাকার দাবি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পরিচয়হীন সন্তানদের নানা বিষয়ে। তাঁর একটি সন্তান ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। এ দরদ থেকেই তিনি পালক সন্তান নেন। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কিছু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।
১৯৪৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সন্তান পালক সংস্থা বা আন্তর্জাতিক অ্যাডোপশন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। একইভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ওয়েলকাম হাউস। যেখানে পাঁচ হাজার নিঃস্ব, অভিভাবকহীন সন্তান স্থান পায়।
এশিয়ান দেশগুলোর অভাব ও সন্তান প্রতিপালনে বাধা দূরীকরণে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাড্রেস পোভার্টি অ্যান্ড ডিসক্রিমিনেশন ফেসড বাই চিলড্রেন ইন এশিয়ান কমিউনিটি’। বিশেষ করে যেখানে আমেরিকান সৈন্য গিয়ে অবাঞ্ছিত সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সেখানেই তাঁদের অধিকার আদায়ে চেষ্টা করেছেন পার্ল।
দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে এসব শিশুর জন্য এতিমখানা স্থাপন করেন। শিশুদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তিনি আমেরিকায় বর্ণবাদ প্রথা নিয়েও সোচ্চার ছিলেন। সে সময় বেশির ভাগ মানুষ এসব নিয়ে ভাবতেন না।
পার্লের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে চীনে। নিজের ভাষা শেখার আগেই তিনি শিখেছিলেন চীনা ভাষা। তাই তাঁর লেখায় চীন জীবন্ত ও জ্বলন্ত।
সব মিলিয়ে পার্ল এস বাক লিখেছেন ৪০টি উপন্যাস, ২১টি গল্প, ১২টি নন-ফিকশন, রান্নার বই ও চারটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।
তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘দ্য গুড আর্থ’, ‘দ্য সান’, ‘দ্য মাদার’, ‘কাম মাই বিলাভেড’, ‘সাটান নেভার স্লিপস’, ‘ইমপেরিয়াল ওম্যান’, ‘প্যাভিলিয়ন অব ওম্যান’, ‘গডসমেন’, ‘লেটার ফ্রম পিকিং’, ‘দ্য চিলড্রেন হু নেভার গ্রো’, ‘মাই সেভারেল ওয়ার্ল্ড’, ‘এ ব্রিজ ফর পাসিং’, ‘দ্য একজাইল অ্যান্ড ফাইটিং অ্যাঞ্জেল’।
বাকের লেখায় উঠে এসেছে চীনা জীবনযাত্রা, মিশনারিদের কাজ ও যুদ্ধের কথা। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ১৯৩২ সালে পুলিৎজার, ১৯৩৫ সালে উইলিয়াম ডিন হাওয়েলস মেডেল পান তিনি।
৮০ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালের ৬ মার্চ তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পার্ল এস বার্ক শুধু লেখকই নন, তিনি ছিলেন সম্পাদক, লেখক, প্রতিষ্ঠাতা এবং সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। পার্ল যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেটাকে বর্তমানে পরিণত করা হয়েছে জাদুঘর এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে।
নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পার্লের বাড়িটি এখন ‘পার্ল এস বাক হাউস’ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে চীন সফরে গিয়ে যেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, ‘পার্ল এস বাক না লিখলে চীনকে আমরা কি এত বেশি জানতাম?’
দ্য গুড আর্থ প্রসঙ্গে
পার্ল এস বাকের অমর সাহিত্যকর্ম ‘দ্য গুড আর্থ’। উপন্যাসটি তাঁর চীনা জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। ‘দ্য গুড আর্থ’ লেখার সুবাদে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে একজন মহৎ শিল্পী যখন বিশেষ কিছু রচনার জন্য একটি জনপদ বা একটি সম্প্রদায়কে বেছে নেন, তখন তিনি তাঁর আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
পার্ল এস বাক ‘দ্য গুড আর্থ’ রচনার আগে দীর্ঘদিন চীনে গিয়ে বাস করেন। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলেও ধর্মপ্রচারক বাবা-মায়ের সুবাদে বাকের শৈশব ও কৈশোরের ১৭ বছর কাটে চীনে সে তো আগেই বলা হয়েছে। ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে তাঁর প্রথম ভাষা হয় চীনা ভাষা, তা-ও ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। মাঝের কিছু সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটালেও পরবর্তী সময়ে আবার ফিরে আসেন চীনে।
সিংকিয়াংয়ের চীনা পরিবেশে থেকেই তিনি নিবিড় হয়ে ওঠেন চীনের সনাতন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, প্রচলিত জীবনধারা আর হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা ভরা ঘাত-প্রতিঘাতের পারিবারিক জীবনের সঙ্গে।
পার্ল চৈনিক সমাজের এই জীবনপ্রবাহকে শিল্পীমনের গভীর ব্যঞ্জনা, অভিজ্ঞতা আর কল্পনার ছোঁয়ায় মূর্ত করে তোলেন ‘গুড আর্থ’-এ। মাটি যাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাদেরই একজনের জীবন-প্রবাহের আবর্তনে নির্মিত ‘গুড আর্থ’। সঙ্গে আছে আরো ঘটনাপ্রবাহ ও আরো মানুষের সমাগম। নগণ্য চাষি ওলাঙ লাঙ এই আবর্তের মধ্যিখানে সর্বসহা। করুণাময়ী মৃত্তিকা আর ওলাঙ লাঙের মাঝখানে সবসময় ছিল বহু বাধা—বন্যা, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব।
মোটকথা, পূর্বপ্রস্তুতি আর বিশেষ লক্ষ্য ছাড়া এই মহৎ সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়। আর সম্ভব হয়েছে বলেই জয় করেছেন পুলিৎজার ও নোবেল পুরস্কার। জয় করেছেন বিশ্ব।
পার্ল এস বাককে অনেকে নারীবাদী লেখক বলেন। আজকের দিনে নারীবাদের সংজ্ঞা যেভাবে, যত স্তরে আবর্তিত হয়েছে সেই বিবেচনায় তাকে ফার্স্ট ওয়েভের নারীবাদী লেখক হয়তো বলা যেতে পারে।
নারীবাদী ধারার বিভাজনের এই পদ্ধতি অনেক সময়ই সংকীর্ণ মনে হয়েছে অনেকের কাছে। তবুও বাকের লেখনীতে নারীর অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়ার একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা আছে এই সত্য সবিনয়ে স্বীকার করা যায়।
কিন্তু আজকের দিনের তরুণ নারীবাদীরা তাঁদের জীবনের সকল এলাকার নির্যাতনের প্রতিফলন দেখতে চান তাঁদের পূর্ব নারীদের কাজ থেকে, সেটা সাহিত্য কিংবা অন্য যেকোনো শিল্পমাধ্যমই হোক না কেন। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই, যে লেখকের অন্তরাত্মায় চীনা গরিব চাষিরা মিশে আছে, তাঁর লেখায় নানকিংয়ে নৃশংস নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষ কথা বলে ওঠে বারবার।