গল্প
দিয়াশলাই

চুলা জ্বালাতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে। দিয়াশলাই নেই। চরম বিরক্তিতে মাথা ভন ভন করে। সামনের ঘরে এসে চেয়ার টেনে বসে। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায় আদিলের। ফেরার পথে বাসার কাছের বাজার থেকে কিছু চাল, ডাল, দুটো ডিম আর দুটো হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে নিল। নতুন বাসা। বাসায় আসবাব বলতে কিছু নেই। এখনো আনা হয়নি।
একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে আদিল। কুমিল্লার চান্দিনা থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এসেছে। গত মাসের মাঝামাঝিতে একবার ঢাকা এসে এ বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে গিয়েছিল আদিল। অগ্রিম টাকাও দিয়ে গিয়েছিল বাড়িওয়ালাকে। দেড় রুমের সুন্দর বাসা। দেড় রুম বলতে একটি বড় শোবার ঘর, তার পাশেই বারান্দার মতো অংশটিতে বাড়িওয়ালা কিচেন আর বাথরুম করে আলাদা করেছে।
আদিল একাই থাকবে। একার জন্য ঘরটি বেশ মনের মতোই হয়েছে তার। ঘরে ঢুকতে কাঁচা রঙের গন্ধ নাকে ঝাপটা দেয়। বাড়িওয়ালা ঘরটিকে রং করিয়ে রেখেছে। হাতের হাঁড়ি-পাতিল আর সদাই-পাতি কিচেনের পাশে রেখে মেঝেতেই বসে পড়ে আদিল। বেশ ক্লান্ত। ভোরে কুমিল্লা থেকে রওনা দিয়েছে। সারাদিন অফিস করেছে। তারপর বাজার সেরে বাসায়। একবার ভেবেছিল বাইরেই খেয়ে ফিরবে। মন সায় দিল না। তাই বাজার করেই ফেরা।
বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়। আদিল আনমনা হয়ে বসে আছে। দেয়ালের দিকে তাকায়। ঘড়ি নেই। এখনো ঝোলানো হয়নি। পকেট থেকে মোবাইল ফোনসেট বের করে। আজকাল অনেকেই হাতে ঘড়ি পরে না। ঘড়ির বদলে হাতে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল ফোনসেট। রাত ১০টা বাজতে চলল। জামা না খুলেই রান্না বসাতে যায় আদিল।
এত রাতে পাঁচতলা থেকে নেমে দিয়াশলাই আনতে যাওয়া সত্যিই বিরক্তিকর। দিয়াশলাই ছাড়া তো চুলোয় আগুন জ্বলবে না। নিরুপায়, বেরোতেই হবে। দরজায় তালা লাগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মাথায় ভাবনা আসে। একটি দিয়াশলাইয়ের জন্য পাঁচতলা থেকে নামব? পাশের বাসা থেকেই তো একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি চেয়ে নেওয়া যায়। দোটানায় পড়ে আদিল।
শেষমেশ পাশের বাসার কলবেল টেপে একবার। দু-বার।
খটাস করে ছিটকিনি ছাড়িয়ে দরজা খোলে দিয়া।
এক্সকিউজ মি। আমি পাশের বাসায় নতুন এসেছি। একটু দিয়াশলাইটা দেওয়া যাবে? মাথা নিচু করেই বলল আদিল। দিয়া অপলক তাকিয়ে আছে।
এক্সকিউজ মি। বলল আদিল।
জ্বি।
দিয়াশলাইটা!
আনছি, বলল দিয়া।
কিন্তু দিয়া দাঁড়িয়েই আছে। আদিল অবাক হয়। মহিলাটিকে কেমন চেনা চেনা মনে হয়। খুব চেনা। যেন অনেক দিনের চেনা।
আমার মেমোরি যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আদিল সাহেব।
আদিল চমকে ওঠে। ঠিক ধরে নেয় ও নিশ্চয় দিয়া। বেশ মুটিয়ে গেছে। তাই প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি।
আপনি আদিল সাহেব তো? পুনরায় প্রশ্ন করে দিয়া।
জ্বি।
ভেতরে আসুন।
আদিল এদিক-ওদিক তাকায়।
কোনো সমস্যা নেই। আসুন। বলল দিয়া।
আদিল ভেতরে প্রবেশ করে। দাঁড়ায়।
ছিমছাম, সাজানো-গোছানো ড্রইং রুম। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে। এ কোথায় এসে পড়লাম! ভাবছে আদিল।
দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে ফিরে আসে দিয়া। দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
সম্বিত ফিরে পায় আদিল। কাঁপতে কাঁপতে সোফায় বসে। একাই থাকেন বুঝি? প্রশ্ন করে আদিল। একা থাকব কেন? স্বামী আছে। সংসার আছে। মেয়ে আছে। আর কি চাই!
আদিলের মুখ দিয়ে কোনো উত্তর বেরোয় না।
আপনি বসুন। আমি আসছি। এ কথা বলে ভেতর ঘরের দিকে যায় দিয়া।
আদিল চমকায়। ভাবে, দিয়া ওর স্বামী আর মেয়েকে ডেকে আনতে যাচ্ছে!
ভাবতে থাকে আদিল। প্রায় বারো কি চৌদ্দ বছর আগে দিয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল আদিলের। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে দুজনে পড়ত। আদিলের দুই বছরের জুনিয়র ছিল দিয়া।
পরিচয়ের পর দিয়াই একদিন বলেছিল ওদের ক্লাসের রিমা নাকি আদিলকে দেখিয়ে বলেছিল- দিয়া ওই দ্যাখ ভাইয়াটার হাসি কত সুন্দর।
হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিল দিয়া। তারপর আর আদিলের পিছু ছাড়েনি।
দিয়ার কোমল চলন-বলন মুগ্ধ করে আদিলকে। নিজেকে আবিষ্কার করে ভালোবাসায়। রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর জগতের উত্তম বাসিন্দারূপে।
দিন পেরিয়ে যায়। দিয়া তার সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ফেলে আদিলকে। বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়াও যে কোনো দিন হঠাৎ করে গিফট দিয়ে আদিলকে অবাক করে দিত দিয়া। আর ফিরতি গিফট দিতে ভুলত না আদিল।
এক রুমের একটি বাসা নিয়ে থাকত আদিল। সাবলেট। পাশের ঘরে আরো দুজন। এক রুমের ঘরটিতেই কিছু ছেলেমেয়ে পড়ত। বুয়া এসে রান্না করত। আর ওতেই চলে যেত আদিলের। দিয়াদের সংসারে সবে মাত্র চারজন। দিয়া, তানি আর মা-বাবা। তানি বয়সে চার-পাঁচ বছরের ছোট। সবে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করল।
ওই সময়েই দিয়ার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে আদিল। এ যেন ভরা জোয়ারে উপচে পড়া ঢেউ। আদিলের ব্যবহারে মুগ্ধ হন দিয়ার মা, তানি। কিন্তু বাবার চেহারায় সংশয় দেখেছিল দিয়া। মেয়ের ভালোলাগার কথা ভেবেই বাধা দেননি।
ঘড়ির কাঁটার নিয়মে প্রতিটি ক্ষণ কেটে যায়। দিয়া-আদিলের দ্বৈত জীবন কোনো রুটিনে বাঁধা পড়ে না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কত জানা-অজানা জায়গায় ঘুরতে যায়। সপ্তাহের বেশ কটা দিনই সন্ধ্যা পেরোলেই দিয়ার বাসায় যায় আদিল। মা রান্নাঘরে আর তানি পড়ার ঘরে ব্যস্ত। আদিল-দিয়া মেহমান ঘরে। কথার পিঠে কথা হয়। হাতের পরতে হাত ছোঁয়া থাকে। সোফায় দুজন পাশাপাশি। জানালার পর্দাগুলো আগেই মেলে দেয় দিয়া। নিচতলায় বাসা। পর্দার ফাঁক গলে কারো দৃষ্টি না আবার ঘরে ঢুকে যায়। দেয়ালের ঘড়িটা যেন খুব দ্রুতই মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা পাল্টায়। নাশতার ট্রে হাতে কখনো তানি আর কখনো মা এসে দাঁড়ান। গলার ভেতর থেকে খাক্রি দেয়। ডাকে— দিয়া। দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে। আদিলের হাত ছেড়ে দিয়া উঠে যায়।নাশতার ট্রে হাতে ফিরে আসে। হরেক পদের নাশতা। দিয়া খাইয়ে দেয় আদিলকে। আর আদিল দিয়াকে। একসময় দিয়ার বাবা বাসায় ফেরেন। আদিল চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ে। অথবা কখনো সামনাসামনি হয়ে গেলে সালাম দিয়েই সরে পড়ে। আর কখনো আদিল রাতের খাবারটা দিয়ার সাথে সেরেই বাসায় ফেরে।
সপ্তাহের কোনো ছুটির দিন অথবা সুযোগ বুঝে আদিলের সাবলেট বাসায় আসত দিয়া। তখন পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা পড়া শেষে বেরিয়ে যেত। তারপর আদিল-দিয়ার অফুরন্ত সময় নিমেষেই শেষ হয়ে যেত। কথা আর স্পর্শ পরস্পরকে অনেক বেশি আবেগি-আগ্রহী করে তুলত। কিন্তু দিয়া অবাক হতো আদিলের ধৈর্য দেখে। আদিল কখনোই উন্মুক্ত হতে চাইত না। বরং দিয়াকে বলত, স্বাধীনতা আছে বলেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা ঠিক নয়। গভীর প্রেমের পরিণতি কামে। আর যদি সেটাই শেষ হয়ে যায়, তাহলে ভালোবাসার আকর্ষণ থাকে না। কামই মুখ্য হয়ে ওঠে।
আদিলের এ মহৎ নীতিকে শ্রদ্ধা করত দিয়া। তারপরও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে আদিলকে জোর করেছিল। খুব করে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপরও আদিল সীমারেখা পেরিয়ে যায়নি। ওতেই আদিলের প্রতি ভরসা, ভালোবাসা, নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল হাজারগুণ। আর এভাবেই পারস্পরিক আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসার দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুতগতিতে।স্মৃতির পাতার প্রতিটি অঙ্ক, দৃশ্য এলোমেলোভাবে ভেসে উঠতে থাকে আদিলের মানসপটে। আদিল খুব কাছ থেকেই যেন হারানো অতীতকে ফিরে পায়। কিন্তু সেই সুখস্মৃতির ধারাবাহিকতা থমকে যায় দিয়ার ফিরে আসায়।
চলুন, টেবিলে খাবার দিয়েছি। দিয়া এসে বলল।
অস্বাভাবিক রকম অপ্রস্তুত হয় আদিল। বলে, মানে!
মানে টেবিলে খাবার দিয়েছি। আসুন।
দিয়ার চোখে চোখ রাখে আদিল। কয়েক সেকেন্ড বেশি স্থায়ী হয় না। চোখ নামিয়ে রাখে। দিয়ার সেই চাহনি আদিলকে নার্ভাস করে দেয়। সুবোধ বালকের মতো দিয়ার পিছু নেয় আদিল।
টেবিলে কয়েক পদের তরকারি আর ভাত। দাঁড়িয়ে থাকে আদিল।
ওই যে বেসিন। হাত ধুয়ে বসুন। বলল দিয়া।
আদিল তাই করল।
খাবার টেবিল থেকে দিয়ার শোবার ঘর দেখা যাচ্ছে।
বিছানায় একটি মেয়ে শোয়া। বয়স পাঁচ-ছয় হবে।
তোমার মেয়ের নাম কী রেখেছ? বলল আদিল।
এতক্ষণ পর তুমি সম্বোধন করাতে চমকায় দিয়া। পুনরায় দুজনের চোখাচোখি হয়। এবার চোখ নামায় দিয়া।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় অজান্তেই। অস্পষ্ট স্বরে বলে, প্রিয়া।
কী! চমকে প্রশ্ন করে আদিল।
হঠাৎ মনে পড়ে যায় ব্লোজম গার্ডেনের কথা।
আদিলের জন্মদিনে পার্টি দিয়েছিল দিয়া। দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামিয়েছিল দুজনে। হাসির ছলেই আদিল বলেছিল তাদের একটি মেয়ে হলে ওর নাম রাখবে প্রিয়া।
দিয়া কথা রেখেছে। জড়সড় হয়ে বসে আছে আদিল।
কী ব্যাপার হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? বলল দিয়া। আদিল তাকিয়ে থাকে।
পাতে ভাত তুলে দিতে দিতে প্রশ্ন করে দিয়া, জেল থেকে কবে বেরুলেন?
চোখ তুলে তাকায় আদিল। দিয়ার মুখে আপনি সম্বোধন খুব অসহ্য লাগছে আদিলের। এই দিয়াই আপনি থেকে তুমিতে নামিয়েছিল আদিলকে।
বছর দুয়েক হলো। পাতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় আদিল।
তুমি সত্যি খুন করেছিলে? গলা ধরে আসা কণ্ঠে প্রশ্ন করে দিয়া।
দিয়ার মুখে ‘তুমি’ শব্দটি শুনে আদিলের বুকের ওপর থেকে পৃথিবীসম পাথর সরে যায়। দিয়ার চোখে জল। তোমার কি মনে হয় আমি খুন করতে পারি। বলল আদিল।
না, কিন্তু দায় নিয়েই আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। পাতের ভাতগুলো আঙুলেই নড়াচড়া করে আদিল। মুখে ওঠে না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল আদিল, জেলে বসেই আমি তোমার সব খবর পেয়েছিলাম। তোমাকেই বা দোষ দেই কী করে। একজন খুনির সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য তো কোনো মা-বাবাই তাঁর মেয়েকে আইবুড়ো করে রাখবেন না। বাই দা ওয়ে, তোমার হাজব্যান্ড বাসায় নেই!
না।
কোথায়?
ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর গেছে।
ও...। জেল থেকে বেরুনোর সময়ই আমি ঠিক করেছিলাম এ জনমে যেন তোমার মুখোমুখি হতে না হয়। কিন্তু...। কিছুটা দম নেয় আদিল। কিন্তু পৃথিবীটা খুব ছোট।
খাবার টেবিল ছেড়ে সোফায় এসে বসে আদিল।
এবার দিয়াশলাই হবে?
কেন? তুমি কি সিগারেট খাও? বলল দিয়া।
জেলে গিয়ে শিখেছি।
না, দিয়াশলাই হবে না। আমি তোমাকে সিগারেট খেতে দেব না।
দিয়ার কথা শুনে আদিলের ভেতরের মানুষটা হেসে ওঠে।
পাশের ঘর থেকে প্রিয়ার ডাক শোনা যায়- মা, মা। বসো। এ কথা বলে দিয়া পাশের ঘরে যায়। আদিল উঠে পড়ে। মনে মনে বলে, প্রিয়া আর স্বামীকে নিয়ে ভালো থেক দিয়া। ভালো থেক।বেরিয়ে যায় আদিল।