নাট্য সমালোচনা
বাংলা নাটকে আবির্ভাব

বাংলা আবির্ভাব শব্দের সহিত তিরোধানের সম্পর্ক বিচ্ছেদের। শব্দশাস্ত্র মতে, আবির্ভাব সহজভাবে আনকোরা। সরলভাবে মানে নতুন। যাহা কখনো কখনো আপন হইতে চ্যুত। অপর যাহাতে শেষ আবির্ভাব তাহাতে শুরু। মানে বিচ্ছেদের মরা হইতে আবির্ভাবের জন্ম। কথাটা খানিক খটকার মতন লাগিতে পারে। না লাগিলে সই। কারণ, যাহা আমরা ভাব বিশেষে গ্রাহ্য করি, তাহা জগৎতুল্য। আর যাহা দিয়া অগ্রাহ্য করি তাহা আবির্ভাবরূপে ফলিত হয়। পরভাবে বলিলে, অপরের তিরোধানে আপনের আবির্ভাব। এই ভাব নাটুকে। এই ভাব দ্বান্দ্বিক। তাহা কেমন?
ইতালির নামজাদা দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের একখানা বহির নাম ‘The Coming Comunity’। তাহার সরল বাংলা করিলে খাড়ায় ‘ভবিষ্যতের সমাজ’। তাহার এক প্রস্থের নাম ‘Outside’ ওরফে ‘বাহিরানা’। আনা আনা ষোলোআনা গনিয়া তিনি কহিলেন, ‘বাহিরানা’ ভিতরের বাহিরে না। অন্তরের অশেষ। আর আমরা কহিলাম, ‘অশেষ কৃত্য’। যে কৃত্যের শেষ নাই, আছে শুধু শুরু। খানিক আনকোরা। নতুন সংলাপিকা। দার্শনিকগণ খানিক দর্শক হিসাবে ভাবিয়া লইতে পারেন। আমরা মঞ্চ টানিয়া আনিয়াছি মাত্র। শুদ্ধ তাহা নহে, ‘অশেষ কৃত্য’ দেখা হিসাবে পড়া। তাই বলিলাম, বাংলা নাটক ওরফে বাংলাদেশের নাটকে নব আবির্ভাব দেখিতে পাইতেছি। তাহা কি শাহমান মৈশান?
ইতিহাসের ফর্দ ঘাঁটিলে দেখা যাইবে, আদি আর অন্তে বাংলা নাটক কাহিনী ভর করিয়া পথ আগাইতেছে। পাত্র-পাত্রী সভা-সভাসদ সমাজ বাস্তবতার কাহিনীর বাহিরের বাংলা না। সংলাপিকা তৈয়ার হইতেছে কাহিনীর পরম্পরায়। বাংলা নাটকের প্রধান দুইখানা বৈশিষ্ট্য—মিলনাত্মক আর বিয়োগাত্মক। মিলনাত্মক নাটকে দেখিতে পায় বেজাতের সাথে কুলীনের সামাজিক সম্পর্ক তাহার দ্বন্দ্বমূলক উপসংহার। আর বিয়োগাত্মক নাটকে সামাজিক দ্বন্দ্বের ফলে বিচ্ছেদী রূপ। কখনো কখনো যে এই নাটক রাজনৈতিক বাস্তবতার কোশেশ করে নাই, তাহা নয়। তাহা করিয়াছে। সহজ কথায় তাহার গোড়াও সহজ কাহিনীনির্ভর। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে শাহমান মৈশানের ‘অশেষ কৃত্য’ কী?
মৈশানের নাটক পড়িলে পাঠিকা খানিক হোঁচট খাইবেন। প্রশ্ন উঠিবে ইহাতে কাহিনী কই? প্রথাগত নাটকের ধারায় মৈশান পা ফেলেন নাই। না ফেলিবার কারণ মৈশান নাটকে চলতি প্রথা হইতে নিজেকে আলাদা করিতে চাহেন। তাই তাহার নাটকে কাহিনী নাই। সংলাপিকার পারম্পর্য নাই। পারম্পর্য তাহায়, সংলাপিকা একই কাহিনীকে বর্ণনাত্মক রূপ দান করে। যাহা শেষ নাগাদ ঘটনার পরিণতির দিকেই যায়। পাঠিকা বলিতে পারেন, ইহা আবার কী? মৈশানের তর্ক ভিন্ন। নাটকও ভিন্ন। কেমন? তিনি কাহিনীকে মুক্ত করিলেন বৈঠকি সংলাপিকায়। গোছানো কাহিনী সংলাপিকার বিপরীতে পারম্পর্যহীনতায়। এই পারম্পর্যহীনতার পেছনে, কথার পিঠে কথা। দেখি, কথা কোন দিকে যায়। ইহাতে কোন ঘটনা শুরু হয়ত শেষ হয় না। এক ঘটনার পিছে অপর ঘটনা আসিয়া হাজির হয়। তাহা কী রূপ?
‘অশেষ কৃত্য’ নাটকে পাত্র দুই। দুইজনই পুরুষ। নাম বোস্তামী আর কাদেরী। চরিত্র হিসাবে নারী নাই। আলোচ্য সভায় কি নাই তাহা বাহ্য। নারী তবে উপাদান হিসাবে আছে। মৈশান বৈঠকি সংলাপিকার অন্তরের স্বাধীনতা লইয়াছে। এই অপরের অধীন স্বাধীনতা। স্বাধীনত নিকট বৈ, অন্য কিছু নয়। তাই তাহার বচনের শুরু আচমকা। কারণ বোস্তামীর প্রশ্ন দিয়া নাটকের শুরু। শুরুর প্রশ্ন এইভাবে :
বোস্তামী : ‘পেয়েছো? পেয়েছো? পেয়েছো? পেয়েছো?’
কাদেরী : ওহ যাহ... আমার চাদর কোথায়। বিরতি কোথায়?
বোস্তামী বচন মোতাবেক মনে হইতে পারে, সংলাপিকা শুরুর আগে আরো ঘটনা ঘটিয়াছে। যাহাতে শুরুর ঘটনা উহ্য। নাটকের বিসমিল্লাহ, একটা ঘটনার পরের ঘটনা ইহা। কালকে যুগে বর্তাইলে সংলাপিকা মধ্যযুগেই। বোস্তামী কিছু একটা কাদেরীকে খুঁজিতে দিয়াছেন কিংবা কিছু একটা কাদেরীকে আদিতে দিয়াছেন। যাহা কাদেরী খুঁজিতেছেন। মজার ব্যাপার হইতেছে, কাদেরী উত্তর না দিয়া বলিতেছেন, ‘আমার চাদর কোথায়।’ সংলাপিকা যদিও প্রশ্নবোধক বাক্য। দেওয়া হইয়াছে দাড়ি। কাদেরীর পরের উত্তর ওরফে বাক্য আরো মজার। বলিতেছেন, ‘বিরতি কোথায়?’ ইহা প্রশ্নবোধক। কিন্তু প্রশ্নের অধিক উত্তর রহিয়াছে। সংলাপিকার গঠনতন্ত্র বুঝিতে আমরা তিন পদ ধার লইব। পহেলা : পেয়েছো; দোসরা : চাদর; তেসরা : বিরতি। তিন পদের উত্তর কোথায়?
তিন পদ পরখ করিলে দেখা মিলিবে, বোস্তামীর প্রশ্নের জবাব কাদেরী সরাসরি দেন না। বোস্তামীর ‘পেয়েছো’ জবাবে কাদেরীর লব্জ, ‘আমার চাদর কোথায়।’ উত্তর যেন, ‘ওহ যাহ্’! ওহ বাহ্য! আহা আমরি বাংলা ভাষা। কাদেরী আরেক লব্জ, ‘বিরতি কোথায়?’ ভাষাশাস্ত্র কহে, প্রশ্নের সহিত উত্তরের আত্মীয়তা। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর যদি প্রশ্ন হয় তাহাতে কি উত্তর মেলে? দর্শনের মজাই এইখানে। ভাষামাত্রই কর্মপ্রধান। আগাইয়া বলিলে ইহার অন্তর রতিতে। কেননা যাহাই কর্ম তাহাই রতি। আর রতির গঠন বিরতিতেই। বিরতি মাত্রই রতির শেষ। আর শুরুটা প্রশ্নের। প্রশ্ন তো একক ব্যক্তির ব্যাপার না। একের অপর। অপরের জবাব ওরফে রতি। মানে মধ্যযুগে বিরতির পরের উত্তর। ফলে ভাষার গঠন বিরতিতেই নিহিত। কথাখানা ভাষাশাস্ত্রে আনকোরা তো বটেই, বোস্তামীর ভাষায় কম্বলে ঢাকা চাদর। যাহার ফারাক বিরতির লাহান।
নাটক হিসাবে ‘অশেষ কৃত্য’ উপাদান বাচ্য। না-বোধক সমাজ বাস্তবতার রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক উপাদান। উপাদান কখনো কখনো নামজাদা চরিত্রের। কখনো কখনো অচিন পুরের মানুষ। কখনো কখনো রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গ। আবার কখনো নাগরিক অথবা নারী সমাজ। বাংলার প্রকৃতিক উপাদানও তাহাতে বাদ যায় নাই। দুয়েক বাক্য না বলিলে পাঠিকা মজা পাইবেন না। পারম্পর্যহীন সংলাপিকায় যেমন ‘লালমিয়ার জ্যাকেটের পকেটে খেজুর কাঁটা থাকত’, ‘ছফা ভাই রাতে ঘুমাতেন না’, ‘ফেনিল সমুদ্র হবে ঠোঁট ভিজবে না’, ‘একজন নাগরিক হয়ে তুমি নিজের ইচ্ছেমতো, যখন তখন কফি বানাতে পারো না। এর মধ্যে ল অ্যান্ড অর্ডার আছে, গভর্নমেন্ট আছে, বুরোক্র্যাসি, ঘুমানোরও শিডিউল আছে’। আমরা কয় বাক্য বলিলাম মাত্র। পাঠিকা পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
মৈশানের ‘অশেষ কৃত্য’ কী? বলিতে পারেন ‘কিম্ভূতকিমাকার’ কিংবা ‘অ্যাবসার্ড’। বৈঠকি ঢঙের সংলাপিকায় তিনি ঘটনাকে বাক্যে আর বাক্যকে ঘটনার প্রতীকে পরিণত করেন। তিনি কাহিনীতে স্থিত নন। কেননা বাক্যের ইশারা কাহিনীর স্মৃতি নির্ভরতায় পৌঁছে দেয়। ফলে ‘কম্বল মোড়ানো’ উপাদান হতে ঘটনাকে রাষ্ট্র করেন। কেননা ‘পারম্পর্যহীন’ পরস্পরের বাইরের পদার্থ না। কারণ পর ও অপরের সম্পর্ক শুদ্ধ সদর্থক নয়, নয় অর্থকও বটে। তাই আমরা বলিলাম, বৈঠকির পারম্পর্যহীন সংলাপিকা। তত্ত্ব করিয়া বলা যায়, পারম্পর্যের ‘হীন’ পরিস্থিতিই ‘বিরতি’। যেইখানে মৈশানের বৈঠকি সংলাপিকার গঠন। ভাষার গঠনও বলিলে মন্দ হইবে না। আলবৎ।
‘অশেষ কৃত্য’ নাটকে সময় একটা গুরুত্ব ব্যাপার। কেননা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, সময় মাত্রই অধরা। সময়হীন থাকা। মুহূর্তেও পার মুহূর্ত পার করা। কথার যেমন শেষ নাই, সময়ও তাই। তবে কাহিনী নির্ভর নাটক সময়কে যেইভাবে বৃত্তের ঘেরাটোপে রাখে, মৈশান তাহা হইতে একর একর দূরে। মৈশানের কাছে সময় মানে মুহূর্তযাপন। ধ্বনি ওরফে রবও বলা যাইতে পারে। তাই কি মৈশান ‘ঘেউ’ পদ দিয়া নাটক শেষ করিয়াছেন? ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপের রাজনীতিই তো উপরিতলের রাজনীতি। না হলে মৈশান কীভাবে বলেন, ‘বুঝতে পেরেছো রাষ্ট্র কী?’ পাঠিকা, সেই প্রশ্ন তোলা থাকিল।
শেষনাগাদ বলিব, বাংলা নাটকে শাহমান মৈশানের আবির্ভাব তিরোধানের নহে। শুরুর বাসনা বটেন। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপিকায় তাহার নাটক ভরপুর। বাংলা নাটকে মৈশান ‘কৃত্য’ শুরু করিয়াছেন মাত্র। তাহার ‘অশেষ’ এখনো রহিয়া গেল। হয়ত ভবিষ্যতে তাহা ফলিবে। এহেন ভরসা রাখিতে দোষ কোথায়?
এলাহি ভরসা। জয়তু বাংলা নাটক।
তালাশ
1. The Coming Community: Giorgio Agamben, University of Minnesota Press, USA. 2007
2. The theatre of Absurd: Martin Esslin, A & C Black Publishers Ltd, London, 2001