মানবতাবাদী কবি অক্টাভিও পাজ

মেক্সিকোর কবি, লেখক, ও কূটনীতিবিদ অক্টাভিও পাজ লোজানো। জন্ম ১৯১৪ সালের ৩১ মার্চ অক্টাভিও পাজ সলোরজানো ও জোসেফিনা লোজানো দম্পতির ঘরে। বাবা তৎকালীন ডায়াজ শাসনতন্ত্রের বিরোধী বিপ্লবের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। মিক্সিকোয়াক নামক গ্রামে মা জোসেফিনা, খালা এমেলিয়া পাজ ও দাদা ইরিনিও পাজের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন অক্টাভিও পাজ। তাঁর দাদা ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী, ঔপন্যাসিক ও প্রকাশক। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো তিনি এককালে প্রেসিডেন্ট পোরফিরিও ডায়াজের সমর্থক ছিলেন। পাজের পরিবার মেক্সিকান বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো জাপাতার ছিলেন প্রকাশ্য সমর্থক। জাপাতা নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয় পাজের পরিবার।
কলিগিও উইলিয়ামস নামের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেন পাজ । একই সঙ্গে অল্প বয়সেই তিনি তার পিতামহের মেক্সিকান ও ইউরোপীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ লাইব্রেরির মাধ্যমে পরিচয় ঘটে সাহিত্য জগতের সাথে।
১৯২০-এর দশকে এসে পাজ পরিচিতি লাভ করেন ইউরোপীয়ান কবি জেরারদো ডিয়োগো, রোয়ান রেমন জিমেনেজ এবং এন্তোনিও মাচোদা প্রমুখের কবিতার সাথে। পাজের শুরুর দিকের সাহিত্যে দেখা যায় স্প্যানিশ লেখক আন্তোনিও মাচোদার প্রভাব। ১৯৩১ সালে ডি এইচ লরেন্স অনুপ্রাণিত কিশোর পাজ ক্যাবেরেল্লাসহ তাঁর প্রথম জীবনের কিছু কবিতা প্রকাশ করেন। দুই বছর পরের কথা। ১৯ বছর বয়সে পাজ প্রকাশ করেন তাঁর কবিতা সংগ্রহ লুনা সিল্ভেস্টার (বুনো চাঁদ)। ১৯৩৯ সালে পাজ নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করেন প্রধানত কবি হিসেবে।
১৯৩৫ সালে পাজ আইন শিক্ষা ছেড়ে দেন। এর পর মেক্সিকোর অন্যতম প্রদেশ ইউকাতানের রাজধানী মেরিদায় চলে যান তিনি এবং সেখানে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময়ই তিনি তাঁর দীর্ঘ কবিতাগুলো, যেমন বিটুইন দি স্টোন অ্যান্ড দি ফ্লাওয়ার লিখতে শুরু করেন। ‘বিটুইন দি স্টোন অ্যান্ড দি ফ্লাওয়ার’ কবিতায় তিনি এক লোভী জোতদারের কবলে নিষ্পেষিত এক কৃষকের চিত্রকল্প এঁকেছেন শব্দের মায়াজালে। তাঁর এ সময়ের কবিতাগুলো ছিল টি এস এলিয়ট প্রভাবিত।
১৯৩৭ সালে মেক্সিকোতে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন পাজ স্পেনের আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে আমন্ত্রণ পান। সেই সম্মেলনে পাজ রিপাবলিকানদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন এবং বিরোধিতা করেন ফ্যাসিবাদের। স্পেন থেকে মেক্সিকোতে ফেরার পর ১৯৩৮ সালে টলার (প্রশিক্ষণশালা) নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেন তিনি। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি এই সাময়িকীতে লিখেছিলেন। ১৯৩৮ সালেই এলোনা গ্যারো নামে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং সে বছরই তাঁরা বিয়ে করেন। এলিনা গ্যারো হলেন মেক্সিকোর প্রথমসারির একজন লেখিকা। হেলেনা নামে তাদের একটি কন্যা সন্তান ছিল। ১৯৫৯ সালের দিকে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
১৯৪৩ সালে পাজ গাগেনহেইম নামক একটি ফেলোশিপ পান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে পড়াশোনা শুরু করেন। দুই বছর পর মেক্সিকোর কূটনৈতিক সংস্থায় চাকরি নেন এবং কিছুদিনের জন্য নিউইউর্কে কর্মরত থাকেন তিনি। ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সে বদলি হন পাজ। সেখানেই তিনি রচনা করেন মেক্সিকান আত্মপরিচয় ও চিন্তা নিয়ে ‘এল ল্যাবিরিন্তো দে লা সোলেদাদ’ (একাকিত্বের গোলকধাঁধা) নামে অনুসন্ধানমূলক নয়টি বৈপ্লবিক প্রবন্ধ। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো ভারত ভ্রমণে আসেন পাজ। একই বছর তিনি দাপ্তরিক কাজে টোকিওতে এবং পরে জেনেভায় ভ্রমণ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ফিরে আসেন মেক্সিকো সিটিতে। ওখানেই ১৯৫৭ সালে তিনি তার অমর কবিতা পিয়েরদা দি সল (সূর্যপাথর) রচনা করেন। একই বছর প্রকাশিত হয় তার কবিতা সংকলন লিবারতাদ বাজো প্যালাব্রা (মুক্তির শপথ)। ১৯৫৯ সালে দাপ্তরিক কাজে আবার প্যারিসে চলে যান পাজ। ১৯৬২ সালে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবার ফিরে আসেন ভারতে।
ভারতে থাকাকালে পাজ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। এর মধ্যে ‘এল মনো গ্রামাতিকো’ (বাঁদর ব্যাকরণবিদ) এবং ‘লাদেরা এস্তে’ (পূর্বের ঢাল) অন্যতম। ভারতে থাকার সময় পাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সেখানকার হাংরি জেনারেশনের (ক্ষুধার্ত প্রজন্ম) লেখকগোষ্ঠীর এবং তাদের ওপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেন। এমনকি ক্ষুধার্ত আন্দোলনের কবিগোষ্ঠীদের ৩৫ মাসের দীর্ঘ বিচার চলাকালে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তিনি।
‘ভিতরবাসী বিশ্ববাসী : অক্টাভিও পাজ’ শিরোনামে কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত পাজের ভারত-ভালোবাসা প্রসঙ্গে লিখেছেন- “মুম্বাই শহরে অক্টাভিও পাজ প্রথম যেদিন পা রাখেন, তাঁর পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে গিয়েছিল। এত ছন্নছাড়া জনতা কোনোদিনই তো কোথাও তিনি দেখেননি। ভিড় থেকে পালিয়ে এক রোববার দ্বৈপ অবকাশযাপনের পরিকল্পনায় এলিফ্যান্টাতে গিয়েও এতটুকু শান্তি পাননি। রাজ্যের লোকজন সেখানে পিকনিকের প্রমোদ প্রহর কাটিয়ে রাশিকৃত আবর্জনা ফেলে গেছে। যদি পাওলো পাসোলিনি বা গুন্টার গ্রাস হতেন, তাহলে তাঁর ভারতবীক্ষা প্রথম অভিজ্ঞতার সেই বিতৃষ্ণাতেই আবদ্ধ হয়ে থাকত। কিন্তু পাজ যে নাছোড় বিশ্বনাগরিক, ভারতবর্ষের কাছে তাই মাটি আঁকড়ে দীক্ষিত হওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে রইলেন। এবং আশ্চর্য, অত্যল্প সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক অস্বস্তি রূপান্তরিত হয়ে যায় প্রগাঢ় মুগ্ধবোধে। তাঁকে তখন দেখা যায় দিল্লিতে শ্রাবণের মধ্যরাত্রে একটা শাদা কাগজের ওপর ঝুঁকে আছেন। পাশের ঘরে তাঁর স্ত্রীর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে : বাগানের মহানিমগাছটা কবির কাছে নতুন কথা শুনবার অপেক্ষায় কান পেতে আছে। এ রকম বোধিকল্পময় আবহমণ্ডল শুধু বাইরের দিক থেকেই নয়, কবিস্বভাবের মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়ে উঠছে।
ভারতবর্ষের কথা উঠলেই পাজ তাই কেমন যেন সময়হীন হয়ে পড়েন। এই দিব্যদশার অভিঘাত এতই প্রবল যে তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায় তিনি তাঁর প্রথম সফরের (১৯৫২) বছরটা অন্তত বছরখানেক পিছিয়ে দেন। এর ১০ বছর পর ভারতে এসে তিনি ছয় বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। ১৯৮৪-৮৫ নাগাদ আরো দুবার তিনি মেক্সিকোর পরেই তাঁর এই প্রিয় মৃত্তিকাকে ছুঁয়ে যান। ভিতরবাসী এই মানুষটির কবিতায় কবিতায় তাই যে ভারতীয়তা-মথিত হয়ে থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে?”
১৯৬৩ সালে ফরাসি বান্ধবী বোনার সাথে বিচ্ছেদ ঘটে তাঁর। একই বছর মেরি হোসে ত্রামিনি নামের আরেক ফরাসি নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের বাকি সময়টুকু মেরির সাথেই কাটিয়েছেন পাজ। ১৯৬৮ সালে ত্লাতেলোকোর ‘প্লাজা দি লাস ত্রেস কালতুরাস’ নামক চত্বরে সরকারি আদেশে প্রতিবাদী ছাত্রজনতা হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে কূটনীতিবিদের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন পাজ। এরপর কিছুদিনের জন্য প্যারিসে চলে যান এবং পরের বছরই মেক্সিকো ফিরে আসেন। এ সময় পাজ কিছু স্বাধীনচেতা মেক্সিকান লাতিন আমেরিকান লেখককে সাথে নিয়ে প্লুরাল (১৯৭০-১৯৭৫) নামে একটি পত্রিকা বের করেন।
১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস এলিয়ট নর্টন অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা করেন তিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ে সে সময়ে দেয়া লেকচার থেকেই জন্ম নেয় তার আরেকটি সাহিত্য-কীর্তি ‘লস ইহোস দেল লিমো’ (কর্দমার শিশু)। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকান সরকার প্লুরাল পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। সেবছরই ‘বুলেতা’ নামক আরেকটি প্রকাশনা বের করেন পাজ। বুলেতা’র ভাবাদর্শ ‘প্লুরাল’-এর অনুগামী থেকে যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই প্রকাশনার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার আবেদন উপজীব্য হবার কারণে ১৯৭৭ সালে পাজ লাভ করেন সাহিত্যে জেরুজালেম পুরস্কার । ১৯৮০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৮২ সালে তিনি পান নিউতস্তাদত পুরস্কার। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত লিখিত তাঁর কবিতাগুলোর একটি সংকলন বের হয় ১৯৯০ সালে। ওই সালেই পাজ ভূষিত হন নোবেল পুরস্কারে।
অক্টাভিও পাজের সৃষ্টিকর্মগুলোর অধিকাংশই অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। উদাহরণস্বরূপ, তার কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন স্যামুয়েল ব্যাকেট, চার্লস টমলিসন, এলিজাবেথ বিশপ, মুরিএল রুকেসার ও মার্ক স্ট্র্যান্ড। তাঁর কবিতা মার্ক্সবাদ, পরাবাস্তবতা ও অস্বিত্ববাদী দর্শনের প্রভাব রয়েছে। কিছু কিছু ধর্ম, যেমন হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনও তার প্রথম দিকের কবিতায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁর লেখা ‘সূর্যপাথর’ কবিতাটিকে পরাবাস্তবতাবাদী কবিতার একটি উল্ল্যেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে প্রশংসিত হয়। পরবর্তী সময়ের কবিতার প্রধান উপজীব্য ছিল ভালবাসা ও কাম, সময়ের প্রকৃতি ও বৌদ্ধিক দর্শন। আধুনিক চিত্রকলার প্রতি পাজের অনুরাগ ছিল, যা নিয়ে তার কিছু কবিতা দেখা যায়। তিনি তার বেশকিছু কবিতা বালথুস, জ়োয়ান মাইরো, মার্সেল ডাচহ্যাম্প, এন্টোনি টাপিএস, রবার্ট রাশ্চেনবার্গ এবং রবার্টো মারিও প্রমুখের সৃষ্টিকর্মের প্রতি উৎসর্গ করেন।
একজন প্রবন্ধকার হিসেবে পাজ লিখেছেন মেক্সিক্যান রাজনীতি ও অর্থনীতি, আজটেক শিল্প, নৃতত্ত্ববিদ্যা ও যৌনতা বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ । তার সুদীর্ঘ প্রবন্ধসংগ্রহ ‘একাকীত্বের গোলকধাঁধা’ তে তিনি অনুসন্ধান চালিয়েছেন তার দেশের জনগণের মনের গভীরে এবং সেই সব মনকে একাকিত্বের মুখোশের পেছনে হারিয়া যাওয়া মন বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। ঐতিহাসিক বাস্তবতায় হয় মেক্সিকানদের আত্মপরিচয় প্রাক কলম্বিয়ান ও স্প্যানিশ সংস্কৃতির মাঝামাঝি জায়গায় হারিয়ে গেছে, না হয় সেটা ক্ষয়িষ্ণু। ‘একাকিত্বের গোলকধাঁধা’, মেক্সিকান সংস্কৃতি অনুধাবনের প্রধান উৎস, যা আরো কিছু মেক্সিকান লেখক যেমন কার্লোস ফুয়েন্তেসকে প্রভাবিত করেছে। ইলান স্ট্যাভান্সের মতে পাজ হলেন- একজন আত্মপ্রতিমূর্তির জরিপকারী, একজন দান্তের ভার্জিল, একজন রেনেসাঁ-পুরুষ ।
এ প্রসঙ্গে রবার্ট ফ্রস্টের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। রবার্ট ফ্রস্ট তখন জনকোলাহল থেকে বিযুক্ত, বাস করতেন অনেক উঁচুতে পাহাড়ের একটি কেবিনে। ১৯৪৫ সালের জুনের এক খরতপ্ত দুপুরে ভারমন্টের (যুক্তরাষ্ট্র) নির্জন গ্রামে ফ্রস্টের সঙ্গে দেখা করতে এলে অক্টভিও পাজ। পাজকে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্য পোয়েট ক্রিয়েটস হিজ ওউন ল্যাঙ্গুয়েজ। ...হোয়েন আই স্টারটেড রাইটিং আই ফাউন্ড দ্যাট দ্য ওয়ার্ডস অব ওল্ড রাইটার্স ওয়েয়ার নো ইউজ টু মি; ইট ওয়াজ নেসেসারি ফর মি টু ক্রিয়েট মাই ওউন ল্যাঙ্গুয়েজ। অ্যান্ড দ্যাট ল্যাঙ্গুয়েজ- হুইচ সারপ্রাইজড অ্যান্ড ট্রাবলড সাম পিপল- ওয়াজ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব মাই ওউন কমিউনিটি, দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ দ্যাট সারাউন্ডেড মাই চাইল্ডহুড অ্যান্ড এডোলেসেন্স। আই হ্যাড টু ওয়েট এ লং টাইম বিফোর আই ফাউন্ড মাই ওয়ার্ডস।’ (অন পোয়েটস অ্যান্ড আদার্স/ অক্টভিও পাজ/ পৃষ্ঠা-৫)।
১৯৫৬ সালে ‘লা ইহা দে রাপ্পাচিনো’ নামে একটি নাটক লিখেন পাজ। নাটকটির আঙ্গিক গড়ে উঠেছে অধ্যাপক রাপ্পাচিনোর মনোরম বাগানের প্রতি একজন ইতালীয় ছাত্রের ঘোরাঘুরিকে কেন্দ্র করে, যেখানে ছাত্রটি গোপনে আধ্যাপকের অসাধারণ সুন্দরী কন্যা বিট্রেসের প্রতি গোপনে চোখ রাখতো। একসময় ছাত্রটি বাগানের সৌন্দর্যের বিষাক্ত প্রকৃতি জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পাজের অন্যান্য সৃষ্টিকর্মগুলো হলো- এগুলিয়া ও সোল (১৯৫১), লা এস্তাসিয়োন বিওলেন্তা (১৯৫৬), পিয়েদ্রা দে সল (১৯৫৭)। ইংরেজি ভাষায় অনূদিত তাঁর কবিতা সংকলনগুলো হলো- আর্লি পোয়েমস (১৯৩৫-১৯৫৫) ও (১৯৭৪) এবং কালক্টেড পোয়েমস (১৯৫৭-১৯৮৭) ও (১৯৮৭)।
স্প্যানের গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকানদের সঙ্গে নিজের সংহতি প্রকাশ করেন পাজ। কিন্তু রিপাবলিকানের দ্বারা তাঁর এক সহযোদ্ধার খুনের ঘটনা জানার পরে তাদের প্রতি তার ক্রমশ মোহভঙ্গ হয়। ১৯৫০ দশকের শুরুর দিকে ডেভিড রোসেট, আদ্রে ব্রিটন এবং আলবেয়ার কামু প্রমুখের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি, বিশেষ করে জোসেফ স্তালিনের বিরুদ্ধে তাঁর সমালোচনামুখর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হতে থাকে। প্লুরাল ও বুলেতা ম্যাগাজিনে সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানবাধিকার লংঘনের চিত্র তুলে ধরেন তিনি। এর ফলে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী রাজনৈতিক অংশের কাছে তিনি গন্য হন শত্রু বলে। কমিউনিস্ট মতবাদ পরিত্যাগ করার পর বহু মেক্সিকান বুদ্ধিজীবী তার সাথে তীব্র ও প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করেন। তবে পাজ সবসময়ই নিজেকে বামপন্থী চেতনার ধারক বলেই মনে করতেন। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক বামপন্থী ভাবধারক, গোড়া মতবাদধারী; আধিপত্যবাদী ভাবধারার বাম নন। তার ‘দি বো এন্ড লায়ার’ কবিতায় কবিতা ও সমাজের তথা রাজনীতির যৌথবাস ফুটে উঠেছে এভাবেই- “কবিতা ছাড়া কোনো সমাজ থাকতে পারে না। কিন্তু সমাজকে কবিতা হিসেবে বোঝা যাবে না। সমাজ কাব্যিক নয়। কখনো কখনো ‘সমাজ’ ও ‘কবিতা’ -এ দুটি পদ এক অপরকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা পারে না।”
১৯৯০ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর পাজ ও তাঁর বুলেতা ম্যাগাজিনের সহকর্মীরা কমিউনিজমের পতনের ওপর আলোচনার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের আমন্ত্রণ জানান মেক্সিকো সিটিতে। সেই সম্মেলন ২৭ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সম্প্রচার করা হয় মেক্সিকোর টেলিভিশনে।
১৯৯৮ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রতিবাদী এই মহান লেখক।