আদিবাসী পুরাণ
ওয়ানগালা এলো কোথা থেকে

গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে গারোদের নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। দেব-দেবীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন করা হয় এ উৎসবটিতে। গারোরা ওয়ানগালা উৎসবের প্রথম দিনকে ‘রুগালা’, দ্বিতীয় দিনকে ‘সাসাত স’আ’ ও তৃতীয় দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’।
এ উৎসবটির পেছনের গদ্যগুলো সত্যি অনন্য। আজ জানাব গারোদের ওয়ানগালা উৎসব নিয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত কয়েকটি মিথের কথা। ওয়ানগালা নিয়ে বহুল প্রচলিত মিথ অনেকটা এ রকম :
আদিকালের কথা। মানুষ তখন বনের আলু, কচু, গাছের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করত। ধান, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। তখন পৃথিবীতে ধন-সম্পদ, মণি-মানিক্য, খাদ্যশস্য প্রভৃতির একটি বৃক্ষ ছিল। বৃক্ষের একটি ডালে ছিল ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের প্রচুর ফল। কিন্তু মানুষ তো নয়ই, দেবতারাও তা আহরণ করতে পারত না।
একবার বায়ু দেবতা ‘জারু মে আ জাবাল পান্থে অক্কুয়াংসি জাপাৎ চং সি’ পরিকল্পনা আঁটেন। ওই বৃক্ষ থেকে খাদ্যশস্যের বীজ পেতে তিনি বন্ধুত্ব গড়েন ঝড় ও শিলাবৃষ্টির দেবতা ‘মিক্কা টেম্মা স্টিল রংমা’র সঙ্গে। তিনি তাঁর সাহায্যে ওই বৃক্ষে জোরে নাড়া দেন। এতে ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ পড়ে যায় মাটিতে।
বায়ু দেবতা ওই ধানের বীজ না কুড়িয়েই বাড়ি চলে গেলে ‘আ’ নিং নসিকসক চিনিং নমিনদিল আ নিং দিপেরি চিনিং দিপেরা’ ধানের বীজগুলো কুড়িয়ে ক্ষেতে বপন করেন। পরবর্তীকালে সূর্য দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তাঁর কাছ থেকে ধানের বীজ নিয়ে নিজের ক্ষেতে লাগান এবং সর্বপ্রকার খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকারী হন।
সূর্য দেবতা একদিন বাজারে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এ জগতের এক লোক। তাঁর শরীর ছিল ময়লামাখা। পরনে নোংরা পোশাক। থলেতে খাবারের আলু। পেছনে সূর্য দেবতাদের মতো সুপুরুষদের পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখে সে লজ্জায় বড় এক পাথরের আড়ালে লুকাল। সূর্য দেবতা তা খেয়াল করলেন। কাছে গিয়ে তিনি তাঁকে বেরিয়ে আসতে বললেন। নাম জানতে চাইলে লজ্জায় ও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে লোকটি নাম জানালেন, ‘আনি আপিলপা চিনি গালাপাও।’
নামে নামে মিল দেখে সূর্যদেবতা তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লেন। গাছের ছায়ায় একসঙ্গে খাবার খেতে বসে তিনি দেখলেন, তাঁর বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। তাঁর খুব মায়া হলো। তাঁকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। অতঃপর ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কি না জানতে চাইলে বন্ধুটি উত্তরে বলেন, ‘ধান কী, তা তিনি জানেন না।’
শুনেই সূর্য দেবতার দয়া হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি ঝুম চাষ করে ঝুমক্ষেতে ধান বুনবে। যখন ধান পাকবে, ঘরে তুলবে। সে সময় আমাকে স্মরণ করবে। আমার আশীর্বাদে, আমার দানে আনন্দ করবে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাবে। তাহলে প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার-পরিজনকে আমি আশীর্বাদ করব। এ আমার প্রতিশ্রুতি।’
বাড়ি ফিরে সূর্য দেবতা প্রতিশ্রুতি মতো তাঁর দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’-কে দিয়ে বন্ধুর জন্য ভালো ধানের বীজ পাঠালেন।
ওই দাস ছিল খুব ঈর্ষাপরায়ণ। বীজগুলোকে সে ভেজে নষ্ট করে পৌঁছে দিল।
সরল বিশ্বাসে বন্ধুটি ঝুমক্ষেতে তা বুনলেন। দখিনা বাতাস এলো। বৃষ্টিও হলো। কিন্তু বীজ থেকে কোনো চারা গজাল না। তা দেখে সে হতাশ হলেন। সূর্য দেবতা তাঁকে ঠকিয়েছেন ভেবে কষ্ট পেলেন। একদিন সূর্য দেবতার অন্য দাসদের পেয়ে তিনি ক্রোধে তাদের বেঁধে রাখলেন।
দাসদের কান্নায় আকাশ থেকে নেমে আসেন সূর্য দেবতা।
বন্ধুর মুখে সব শুনে তিনি অনুনয় করে বললেন, ‘আমার এ দাসদের কোনো দোষ নেই। অন্যায় করেছে আমার দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’। আমি তাকে শাস্তি দিচ্ছি। তুমি এদের ছেড়ে দাও। আমি পুনরায় তোমাকে সতেজ ধানের বীজ পাঠাব।’
সূর্য দেবতার অনুরোধে দাসগণ মুক্ত হলেন। তিনি তাঁর কথামতো বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’ কাছে নতুন বীজ পাঠালেন।
নব উদ্যমে পরিশ্রম করে বন্ধুটি ঝুমক্ষেতে ধানের সে বীজ বুনলেন। বীজ থেকে এবার ধানগাছ গজিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল। তা দেখে বন্ধুর মনে আনন্দের দোলা লাগে।
ধান পাকছে। কয়েক দিন পরেই কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেক ঘটনা! দেবতার কয়েকজন দাস গোপনে ক্ষেতের কিছু ধান কেটে চুরি করে নিল। অতঃপর সূর্য দেবতার কাছে তাঁরা অভিযোগ করে বলল, ‘দেখ, আগে তোমাকে না দিয়েই পাকা ধানগুলো তোমার বন্ধু কেটে খেয়েছে। তোমাকে সে উপেক্ষা করেছে, অসম্মান করেছে।’
দাসদের কথায় সূর্য দেবতা রাগান্বিত হলেন। অতঃপর বন্ধুর পুত্র ও দাসদের ধরে এনে তিনি বন্দি করে রাখলেন।
এ সংবাদ শুনে আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা সূর্য দেবতার কাছে ছুটে আসেন। অভিযোগ শুনে তিনি অনুনয় করে বলেন, ‘এখনো আমি ঝুমক্ষেতের ধান কাটিনি। তোমাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে নিজে আগে খাইনি। কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে কেটে নিয়েছে। আমি তোমাকে সম্মান করি ও করব।’
বন্ধুর কথায় সূর্য দেবতার মন গলে। ভুল শুধরে নতুন করে তাঁরা বন্ধুত্ব গড়েন।
এরপর ফসল ওঠে। আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা প্রথম মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে দেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন মদিরা ও ধূপ প্রভৃতি উৎসর্গ করেন। আকাশ, সূর্য ও উর্বরতার দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তখন খুশি হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘এ ব্যক্তি ও তার বংশধরগণের ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্য আশীর্বাদযুক্ত হোক। প্রতিবছর ফসল কাটার ঋতুতে আমি পৃথিবীতে ফিরব আশীর্বাদ করতে।’
ফলে দিন দিন তিনি আরো ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠলেন। তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও জুমচাষে উৎসাহ দিলেন। এভাবেই যুগ-যুগান্তরে বংশপরম্পরায় গারোদের ওয়ানগালা উৎসব পালন হয়ে আসছে।
কিছু কিছু এলাকার গারো সমাজে প্রচলিত আছে ওয়ানগালা নিয়ে আরেকটি পৌরাণিক কাহিনী। কাহিনীটি এমন :
দেবতা মিসি সালজংয়ের একবার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফলে তিনি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। ভাইয়ের সংসারে তখন অভাব চলছিল। স্ত্রীর মুখে বড় ভাই আসার খবর শুনেও তিনি ঘরের বাইরে এলেন না, বরং বিরক্ত হলেন। স্ত্রী বলে, ‘অতিথিকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করব?’
উত্তরে ছোট ভাই বলে, ‘একটি পাত্রে কিছু ঘুঁটে নিয়ে পুড়িয়ে দাও। সে তার ঘ্রাণ নিক।’
ভাইয়ের ব্যবহারে মিসি সালজং অপমানিত ও রাগান্বিত হন। অতঃপর তিনি চলে আসেন পৃথিবীতে। যে স্থানে তিনি আবির্ভূত হন, সেখানে থাকতেন এক বিধবা। নাম ‘আইসেগ্রির মিসালি সিংসালি টোটমারি কিংমারি’। বিধবা খুবই গরিব ছিলেন। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে তিনি থাকতেন শুকনো লতাপাতার ছাউনি দেওয়া ছোট্ট কুঁড়েঘরে। ঘরের চারপাশ ছিল জংলি পাতার ঘের দেওয়া। তাদের খাবার জুটত না ঠিকমতো। গরিব হলেও তারা ছিল খুবই সহজ-সরল। মনটা ছিল উদার।
মা-মেয়ে মিলে তখন পাহাড়ি শাক রান্না করে খাচ্ছিল। এমন সময় দেবতা মিসি সালজং সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে তারা চিনতে পারল না। রাগ ও বিরক্তও হলো না। তিনি তাদের বললেন, ‘আমি আজ তোমাদের বাড়িতে থাকব।’
আইসেগ্রি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আমি এক দুঃখী বিধবা নারী। শুকনা কলাপাতার ছাউনি ও বুনো লতাপাতার বেড়া দেওয়া ঘরে কোনোরকমে থাকছি। এ ঘর আপনার মতো সম্মানীয় অতিথির থাকার যোগ্য নয়।’
মিসি সালজং তাঁর সরলতায় মুগ্ধ হলেন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু গনগাজা ডিল ও রিসিম গাছের কষ সংগ্রহ করে গাছের গুঁড়া দিয়ে পুড়িয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ধূপের সুগন্ধি আমার জন্য দিও।’
তাঁরা মিসি সালজংকে ঘরে থাকতে দিলেন এবং পরামর্শমতো ধূপ-সুগন্ধি উৎসর্গ করলেন। এতে তিনি খুশি হলেন। পরদিন পাহাড়ে হয় এমন ধানের বীজ বিধবার হাতে তুলে দিয়ে মিসি সালজং বললেন, ‘প্রতিবছর এ সময়ে এভাবেই আমি আসব। তখন তোমরা আমার জন্য ধূপ-ধুনা পুড়িয়ে সুগন্ধি উৎসর্গ করবে। আনন্দ-ফুর্তি করবে, খাওয়া-দাওয়া করবে।’ গারোদের বিশ্বাস, সেই দিন থেকেই প্রতিবছর ফসল তোলার পর ধূপ জ্বালিয়ে পানাহার করে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে তারা ‘ওয়ানগালা’ উৎসব পালন করে আসছে।
সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে আদিবাসীদের উৎসবগুলো। এখনকার ওয়ানগালা উৎসব কেবল নাচ-গান আর কিছু আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ধর্মান্তরের ফলে গারোরাও আজ হারিয়ে ফেলছে এ উৎসবের আদি রূপটিকে। কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি ও সাহিত্যে তাঁদের বিশ্বাসের মিথগুলো আজও জীবন্ত হয়ে আছে।