স্মরণ
সোমেন চন্দের কথা

সোমেন চন্দের প্রায় ২২ বছরের জীবনে দুটো অধ্যায়। একটা রাজনৈতিক, অন্যটি সাহিত্যিক। এর মধ্যে কোনটা তাঁর জীবনে প্রধান সে বিষয় এখন অবান্তর। রাজনৈতিক বিষয়টি তাঁকে কতখানি প্রসারিত করেছিল তা তাঁর জীবন সম্বন্ধে পড়লেই জানা যায়। অবশ্যই তিনি সাম্যবাদের জন্য জীবনপাত করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সাফল্য তাঁর কতখানি আসত তা আজ আর বলা যায় না। তবে রাজনীতির পরিপূরক বিষয় হিসেবে তিনি যে সাহিত্য রচনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন সেটা এইটুকু বয়সেই তাঁর করায়ত্ত হয়েছিল।
রাজনীতি সমষ্টিগত কাজ। সাহিত্য একান্তই ব্যক্তিগত। যদিও রচিত হওয়ার বা বলা যায় প্রকাশ হওয়ার পর সেটা আর মোটেও ব্যক্তিগত থাকে না। নিশ্চয়ই সেটা কাঙ্ক্ষিতও নয়। এখানে সোমেন চন্দ যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করেছেন সেই একই আদর্শ তিনি লালন করেছেন গল্প উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। জীবনের অল্প পরিসরে তিনি যতটুকু সাহিত্য রচনা করতে পেরেছেন তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯২০ সালের ২৪ মে সোমেন চন্দ জন্মগ্রহণ করেন।
রবীন্দ্রনাথের তখন নোবেল পাওয়া হয়ে গেছে। তার মানে বাংলা সাহিত্য ইতিমধ্যে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে পোক্ত একটা আসন আদায় করে নিয়েছে। আর নোবেল প্রাপ্তি থেকে সোমেন চন্দের জন্মের সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে অনেকে পিছিয়ে পড়ার দলে ফেলতে চেয়েছেন। সজনীকান্ত তাঁর বিভিন্ন লেখাকে নিজের মতো করে সমালোচনার খোঁচায় বিদ্ধ করে চলেছেন। পঞ্চ কবিরাও আধুনিক সাহিত্য রচনার জন্য পুরানো হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে এক পাশে ফেলে দিতে চান প্রায়। যদিও পরবর্তীকালে প্রায় সবাই রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক বলেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। কথাগুলো বলার কারণ ঠিক এই সময়ে জন্ম নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের এরকম পক্ষ বিপক্ষ বলয়ের চর্চার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন সোমেন চন্দ। সময়টা সোমেন চন্দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে তাঁর জীবনের পরিধি প্রায় ঐটুকুই। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে তৈরি করা। নিজের শিক্ষার তরীকে সঠিক পথে পরিচলনা করা। এরপর আপন অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে সৃষ্টিকে বাংলা সাহিত্যের মতো সমৃদ্ধ মঞ্চে তা সাফল্যের সাথে উপস্থাপন করা।
সোমেন চন্দের প্রতিভা বিকাশে পরিবারের অবস্থান কম গুরুত্বপূর্ণ না। তাঁর সৎ মা সরযু বিশ্বাস সোমেনকে পেয়েছেন পাঁচ বছর বয়স থেকে। সরযুদেবীর পরিবার ছিল রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। সোমেন চন্দ মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন বেড়ে ওঠার রসদ। নতুন মা তাকে আপন পুত্রের মতোই বড় করে তুলেছেন। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল সোমেন্দ্রকুমার চন্দ। দুর্ভাগ্য তার জীবনের শুরুতেই। তিন চার বছর বয়সে মা হিরণবালা কলেরা রোগে মারা যান। বাবা নরেন্দ্রকুমার চন্দ পরে সরযুদেবীকে বিয়ে করেন। সরযু বিশ্বাসের বাবা ছিলেন টঙ্গীর বউর গ্রামের ডা. শরৎচন্দ্র বিশ্বাস। সরযু বিশ্বাসের মামারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আর এখান থেকেই সরযু বিশ্বাসের রাজনৈতিক সচেতনতা। আর এই মায়ের হাতেই সোমেন চন্দের রাজনৈতিক পাঠ এবং লেখাপড়ার পাঠ শুরু। বাবাও ছিলেন সমসাময়িক রাজনীতি সচেতন। বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন রাজনীতির আর সংস্কৃতির। মা সরযুদেবী ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। সে সময়ের প্রায় সব ধরনের বই তিনি সংগ্রহ করে পড়তেন। মায়ের এই বই পড়ার অভ্যাস সোমেন চন্দের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি মায়ের পড়া বইগুলো পড়তে থাকেন। এই সাথে চলছিল তাঁর রাজনৈতিক পাঠ।
একটা ক্রান্তিকালের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন সোমেন। তাঁর জীবন ভাবনা, সমাজ সচেতনতা অন্য একটা মাত্রা পায় সমসাময়িক জাতীয় রাজনীতি এবং বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে। কেবল ভারতের স্বাধীনতা না, নিগৃহীত মানুষের মুক্তির বিষয়টাও তাঁর মনে ঢুকে যেতে থাকে। আর এই সব সম্বন্ধে জানার জন্য তাঁর পাঠের অভ্যাসও পালটিয়ে যায়। এসব বিষয়ে আগ্রহ মেটাতে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত লেখকদের বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করেন। বাড়তে থাকে তাঁর জানার পরিধি এবং এইভাবে নিজেকে করে তোলেন আরো সমৃদ্ধ। একজন লেখক একক কোনো সত্ত্বা না, তাঁকে কাল পরিভ্রমণ করতে হয়। সমাজকে আত্মস্থ করতে হয়। তার সাথে ইতিহাসকে মস্তিষ্কে ধারণ করে যে নির্যাস তিনি রেখে যান সেটাই পরিপূর্ণ সাহিত্য। সোমেন চন্দকে ভাবলে অবাক হতে হয়। তিনি কেবলই একজন কিশোর। ওই বয়সে তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকুই বা হওয়ার কথা?
সোমেন চন্দের ডাক নাম ছিল শম্ভু। আর তাই বোধহয় তাঁরো ছিল ত্রিনয়ন। সাধারণ দৃষ্টিতে যতটুকু গোচর হয় তিন দেখতে পেতেন আরো বেশি। আর সেই কারণে সোমেন চন্দ পাঠ করলে আজও এত আধুনিক মনে হয়। তার গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় সমসাময়িক সমাজ। ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে চলছে সংগ্রাম। আর সোমেন চন্দের মন সেই সাথে বিক্ষিপ্ত চারদিকের অসহায় মানুষের দুর্দশা দেখে। মধ্যবিত্ত সমাজের অবক্ষয় তাকে নাড়া দেয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য তার মনে প্রশ্ন জাগায়। অল্পকিছু কালের মধ্যেই মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাভাবে মানুষ পাগল প্রায়। এই সব বিষয়ই উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। আশ্চর্যের বিষয় তিনি যখন তাঁর কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্লাটফর্মটি খুঁজে পান তখন বোঝেন কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক পদচালনার সাথে সাহিত্য রচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোনদিনও তার গল্পে তিনি কোনো দিনই রাজনৈতিক বুলি কপচাননি। তবে তাঁর গল্পে দেখা যায় সাম্যবাদের শিল্পিত প্রকাশ। একটা বিষয় বলতে হয় সেই সময় বাংলার মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ থাকত শহর বা শহরতলীতে। বাকি সবাই তখন গ্রামবাসী। সেই তুলনায় তাঁর গ্রাম প্রেক্ষাপটের গল্প কম। হতে পারে সেটা এই জন্য যে তিনি যে আন্দোলনে জড়িত যা তাকে সব সময় তাড়া করে ফিরত তা সাধারণত নগর কেন্দ্রিক।
সাহিত্য পাঠের সাথে সাথে তাঁর রাজনৈতিক পাঠও চলতে থাকে। দক্ষিণ মৈশুণ্ডির ৪৭ নম্বর লালমোহন স্ট্রিটের বাসায় থাকার সময় সোমেনের বয়স ছিল ১৭। সালটা ছিল ১৯৩৭। তখন জোড়পুল লেনে ‘প্রগতি পাঠাগার’ নামে কমিউনিস্ট নেতাদের স্থাপিত একটা পাঠাগার ছিল। এই পাঠাগারে অন্তরালে চলত ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্র’। আর এই পাঠচক্রের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের মার্কসবাদ - লেনিনবাদের শিক্ষা দেওয়া হতো। সোমেন চন্দ এখানে এসে পেয়ে যান সাম্যবাদের মানুষজনদের। যারা লড়াই করছে নিপিড়ীত মানুষের মুক্তির জন্য। শ্রেণিবৈষম্য দূর করার জন্য। সোমেন চন্দ তাঁর এত দিনের জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পান। পেয়ে যান মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের দিশা। আরো পান সমাজের বৈষম্য দূর করার পথ। তিনি এঁদের দ্বারা বাম রাজনীতিতে দীক্ষিত হন। আর তাঁর রাজনীতিতে আগ্রহ, একাগ্রতার কারণে ১৭ বছর বয়সে পার্টির সদস্য হওয়ার সুযোগও পেয়ে যান। বাম রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর পড়াশোনা এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তাঁকে পার্টির একজন একনিষ্ঠ দক্ষ কর্মী হিসেবে প্রমাণ করে। আর সেই জন্য মাত্র ২০ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের পরিচালনার ভার দেওয়া হয় সোমেন চন্দকে।
সোমেন ছিলেন যেমন মেধাবী তেমনি পরিশ্রমী। শ্রমিকদের সচেতন করে গড়ে তুলতে দিনের পরের দিন তাদের সাথে আলোচনা করা। তাদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। তারপর আবার তাদের ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসা। সবই তিনি করেছেন নিজের পড়াশোনা ও লেখালিখির পাশাপাশি। তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনার সময়। রেল কর্তৃপক্ষের জাঁদরেল সব কর্মকর্তার সাথে শ্রমিকদের দাবি আদায়ে টক্কর দেওয়া যেনতেন কাজ নয়। সোমেন চন্দ প্রায় কিশোর বয়সে সেই কাজ করেছেন। সোমেন চন্দ তাঁর প্রতিভার আরো কী কী স্বাক্ষর রাখতে পারতেন তা আমরা বলতে পারি না। কিন্তু তাঁর ব্যাপক সম্ভাবনা যে ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে নেমে আসে সেই ঘোর অমানিশাময় দিনটি। শ্রমিকদের একটা মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ দিনটি চিরদিনের জন্য আমাদের কাছে শোকের হয়ে রইল।