অকপট আত্মজৈবনিক গুণ

বাংলাদেশের সাহিত্যে, দেশবিভাগের পর থেকে অদ্যাবধি, যে কজন কবি-লেখক আত্মজীবনী রচনা করে বিশেষভাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছেন, তাঁদের ভেতর কবি নির্মলেন্দু গুণ নিঃসন্দেহে শীর্ষ একজন। তাঁর অকপট সত্য বলার ভঙ্গি, নিজের গোপনতম কথাটিও অবলীলায় বলে ফেলার ক্ষমতা এবং তথাকথিত শ্লীল-অশ্লীলের দেয়াল ভেঙে সত্যকে নিঃসংকোচে প্রকাশের সাহস আমাদের জীবিত লেখকদের মধ্যে সম্ভবত নির্মলেন্দু গুণেরই আছে। অন্যদিকে পুরো বাংলা আত্মজীবনী-সাহিত্যেই এ ধরনের দৃষ্টান্ত অতি অল্প। কবি এ জন্যই নিজেকে ‘সত্যসন্ধানী, স্বীকারোক্তিমূলক সাহিত্য-ধারার লেখক’ বলে দাবি করে তাঁর সব আত্মজীবনীর সংগ্রহ মহাজীবনের কাব্য বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আমার জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।’ অন্যদিকে তাঁর আত্মজীবনীর একটি বিশিষ্ট বই আমার কণ্ঠস্বর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ও-বাংলার কবি-প্রাবন্ধিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত দেশ [৪ নভেম্বর ১৯৯৫] পত্রিকায় বইটিকে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সত্য-আত্মজীবনী রুশোর কনফেশনস-এর সঙ্গে তুলনা করে লেখেন, ‘বহু দিক থেকেই নির্মলেন্দু গুণের আমার কণ্ঠস্বর অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর লেখা স্বীকারোক্তি নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়। স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত, কিন্তু প্রবৃত্তির নাগপাশে জর্জরিত। এ গ্রন্থ মানবিক অস্তিত্বের এমন এক বহুমাত্রিক প্রকাশ, যা একাধারে নাটকীয় ও মর্মস্পর্শী।’ [৪ নভেম্বর ১৯৯৫]
আত্মজীবনী নামে চিহ্নিত রচনা ছাড়াও নির্মলেন্দু গুণের তাবৎ সাহিত্য ও রচনা- কবিতা, প্রবন্ধ, জার্নাল, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদির বৃহৎ অংশই নানা অর্থে আত্মজৈবনিক। বিশেষভাবে তাঁর কবিতার ‘আমি’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ং তিনি; এবং বাস্তব, সশরীর, নিরেট তিনি।
যে পর্বে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং প্রকাশ ও বিকাশ, তা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল। তাঁর জন্মের দুই বছরের মাথায় দেশভাগ; তারপর বাঙালির স্বাধিকার-চেতনার প্রথম প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, উত্তাল ঊনসত্তর। তারপর বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ। এরপর জাতির সবচেয়ে মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়া এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড।
এই যে বিপুল ঘটনাবহুল কাল, এ যেন নির্মলেন্দু গুণেরই সমানবয়সী। এবং সব ঘটনাই তার ৩০ বছর বয়সের মধ্যে সংঘটিত। এই ঘটনাবহুল সময়ই উঠে এসেছে তাঁর চার পর্বের আত্মজীবনীতে। কবির জবানিতেই শোনা যাক :
‘আমার কবি হয়ে ওঠা, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা এবং শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা—পরস্পরের হাত ধরে অগ্রসর হওয়া এই তিনটি প্রতিপাদ্যই আমার আত্মজীবনীতে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। আমার আত্মজীবনী তাই আমাদের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলও বটে। একই সঙ্গে আমার হয়েও সে আমাদের। আমার আত্মজীবনী বাংলাদেশেরও জীবনী। বঙ্গবন্ধুরও জীবনকথা। সে একের ভেতরে তিন।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি আত্মজীবনীই অসমাপ্ত। আমার ক্ষেত্রে ‘অসমাপ্ত’ কথাটা আরো অনেক বেশি সত্য। আমার বয়স এখন আটষট্টি। আমার জীবনবৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ সময়কাল—আপাতত আমার জীবনের প্রথম তিরিশ বছর, ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫। পুরোপুরি তিরিশ বছরও নয়। ১৯৭১-এর মে থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও তৎপরবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছুটা সময় আমার রচনায় অনুপস্থিত রয়ে গেছে। সময়ের ধারাবাহিকতা ডিঙিয়ে রচিত হয়েছে—রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫। এই গ্রন্থটিকে আমার আত্মজীবনীর চতুর্থ পর্ব হিসেবে গ্রন্থের অন্তে যুক্ত করেছি। যুক্ত করেছি গ্রন্থটিকে প্রকাণ্ড করার জন্য নয়, দলছুট সময়খণ্ডকে যতটা সম্ভব এক মলাটের ভিতরে, আমার জীবন-তরীতে তুলে নেবার জন্য। (‘প্রাককথন’, মহাজীবনের কাব্য )
কবির ওপরের উদ্ধৃতি থেকেই অনুমেয়, সেই তিরিশ বছরের আত্মজীবনীতেও অনেক ফাঁক থেকে গেছে। আমরা জানি না, আগামী দিনগুলোতে সেই ফাঁক তিনি পূরণ করবেন কি না। অন্যদিকে, সেই তিরিশ বছরের পরও আরো বিয়াল্লিশ বছরের ঘটনাবহুল জীবন তিনি যাপন করেছেন। এই সময়পর্বেই পরিবর্তন ঘটেছে একটি শতাব্দী ও সহস্রাব্দের। দেশ, মহাদেশ, বিশ্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাঁর জীবনেও ঘটেছে বিপুল ঘটনা। আমার মতো তাঁর বহু রসগ্রাহী পাঠক এই সময়খণ্ডের কথাও তাঁর কাছ থেকে শুনতে বিপুলভাবে আগ্রহী।
তবে আত্মজীবনীর সেই সব পর্ব রচনার আগ পর্যন্ত আমরা এই বইটিকে তাঁর অখণ্ড আত্মজীবনী বলে ধরে নিতে পারি, যদিও সত্যের খাতিরে বইটির নাম হওয়া উচিত ছিল (বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতোই) অসমাপ্ত অখণ্ড আত্মজীবনী।
একটু আগেই উল্লেখ করেছি, নির্মলেন্দু গুণের রচনার বৃহৎ অংশই নানা অর্থে আত্মজৈবনিক। কিন্তু কেবল আত্মজীবনী হিসেবেই তিনি লিখেছেন চারটি বই। এগুলো হলো আমার ছেলেবেলা, আমার কণ্ঠস্বর, আত্মকথা ১৯৭১ এবং রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫। এই চারটি বই-ই একসঙ্গে গ্রন্থিত হয়েছে মহাজীবনের কাব্য শিরোনামে। বিপুলায়তন এই বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
পুরো বইটিতে এত সব নির্দয় ও নির্লজ্জ সত্যভাষণ রয়েছে যে, আমাদের মধ্যবিত্ত মন তাতে বেশ বড় ধাক্কা খায়। রয়েছে এমন সব আনন্দ-বেদনা-শোক-শূন্যতার খণ্ড খণ্ড গল্প, যা আমাদের চিত্তকে হাস্য-কৌতুক-কান্নায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষত, শৈশবে মৃত্যুশয্যায় মাকে রেখে খেলতে গিয়ে ফিরে এসে তাঁর মৃত্যু দেখা, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার লোভে মাইকেলের কবিতা নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে সম্পাদকের কাছে ধরা খাওয়া, হোটেলে খেয়ে বিল না দিয়ে পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিচিত্র ঘটনায় লেখকের অকপট সত্যভাষণ, নিজের সম্পর্কে বিবৃতি এবং এগুলোকে বর্ণনা করার ভাষা পাঠক হিসেবে আমাদের একই সঙ্গে বিস্মিত, পুলকিত ও বেদনার্ত করে তোলে।
এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই আমার কণ্ঠস্বর থেকে দু-একটি ছোট্ট বিবরণ লেখকের কাছ থেকেই টুকে নিই :
১. ‘আমার কাছে আমার কবিতা আমার চোখের মতো। আমার কাছে আমার কবিতা আমার আত্মার মতো। আমার কাছে আমার কবিতা আমার রক্তের মতো প্রিয়। আর কবিতাও আমাকে ভালোবাসে বলেই হয়তো ষাট দশকের যেসব কবি পূর্ববঙ্গে জন্ম নিয়েছে, তাদের মধ্যে যদি পাঁচজনেরও নাম করতে হয় তবে আমার নাম অপরিহার্য।’ [১৯৬৮ সালে ভারতে বড়দার কাছে চলে আসা ছোট বোন সোনালিকে লেখা।]
২. ‘অমিতব্যয়িতা আমার স্বভাব, ব্যক্তিগত জীবনে এবং স্বভাবতই কবিতাতেও। কবিতা কী? বুঝিনে। কাব্যবিচারের মানদণ্ড কী? জানিনে। ছন্দ কাকে বলে—ভালো করে বুঝিনে। আমি শুধু উড়নচণ্ডী প্রেমিকের মতো অবিবেচক, যুক্তিহীন এবং ব্যক্তিগত। আমার কবিতা তাই আমি যা লিখি। অন্যের কাছে সেটা গল্প হলেও—গতি নেই, এলজাব্রা হলেও না।’
৩. ‘...রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ শেষে নবীন উল্লাসে জেগে উঠি। মদ্য-পদ্য-সিদ্ধি-গণিকা-জুয়া এই পঞ্চভূতের পাদপদ্মে উৎসর্গ করি আমাকে।’
৪. ‘পূর্ব বাংলার কাদামাটির দেশে জন্মগ্রহণ করলেও, কী কারণে জানি না, আমার রক্তের মধ্যে লুকানো ছিল পশ্চিমের বিট বংশের বীজ। জীবনের বিধ্বংসী প্রবণতাকে প্রকাশ করার জন্য যেরূপ প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন, আমার চারপাশের বিবেচিত বড় কবিদের মধ্যে ছিল তার প্রচণ্ড অভাব। আমাদের অধিকাংশ কবির বেলাতেই কণ্ঠস্বর বর্ণিত ‘গৃহপালিত’ অভিধাটি প্রযোজ্য ছিল। এমতাবস্থায়, মার্কিন বিট কবিদের কাছে মুক্ত, স্বাধীন ও বিধ্বংসী জীবনযাপনের পক্ষে সমর্থন লাভ করে আমি খুবই উপকৃত বোধ করেছিলাম।’
শেষ করার আগে আবারও সুরজিৎ দাশগুপ্তের কাছেই যাওয়া যাক। আলোচনার শেষ পর্বে তিনি লিখেছেন, ‘নির্মলেন্দু যতই নিজেকে উড়নচণ্ডী ও বিধ্বংসীরূপে উপস্থাপনের চেষ্টা করুন না কেন, তিনি যে বাংলা ভাষাগোষ্ঠীর বিগত অর্ধশতাব্দীর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্বের প্রত্যক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে ইতিহাস ও এক অসাধারণ মানবিক দলিল হিসেবে এমন একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, এটাই প্রমাণ করে দেয় তাঁর নির্মাণ ও সংরক্ষণপ্রবণতা। অবশ্যই বিদ্যা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি প্রশংসনীয় মেধার অধিকারী, কিন্তু পাশাপাশি জুয়ার নেশা ইত্যাদির অধীনতা তিনি যেভাবে সানন্দে স্বীকার করেছেন, তা তাঁর স্বাধীনতার জন্য দুর্বার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কী করে মেলে বোঝা কঠিন। কবিতা তাঁর চোখের মতো, আত্মার মতো, রক্তের মতো প্রিয় আবার তেমনই তাঁর রাজনীতি ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, আবার ওই দায়বদ্ধতার পাশাপাশি গুণগ্রাহী গ্রন্থবিক্রেতার দোকান থেকে নির্দ্বিধায় পাশ্চাত্য কাব্যসংকলন চুরি করা, উদ্দাম বোহেমিয়ানার গভীরে অন্তর্লীন আত্মীয়স্বজন ও স্বগ্রামের প্রতি মমতা প্রভৃতি পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যের সহাবস্থান নির্মলেন্দু চরিত্রকে বিশেষ আকর্ষণীয়, কৌতূহলোদ্দীপক, জটিল ও বর্ণাঢ্য করেছে। পড়তে পড়তে বারবার প্রশ্ন জাগে যে, একজন মানুষের মধ্যে এ রকম অসংগতির ধারণাগুলো এমন ঘোর অসামঞ্জস্য হয় কী করে! কোনো কোনো প্রতিভার আচরণগুলো কেন ব্যাখ্যার অতীত হয়, এটা বলা খুবই কঠিন। প্রকৃতপক্ষে সব মিলিয়ে ‘আমার কণ্ঠস্বর’ যুগ ও দেশের সম্বন্ধে এক মূল্যবান মানবিক দলিল পাঠের অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত কিছু দেয়—ওই কিছুটা হলো মানব মনের গহন জটিল রহস্যময় অরণ্যে প্রবেশের ও পর্যটনের রোমাঞ্চ।’
এই সত্যভাষী, নির্ভীক, নিষ্কম্প কবিকে, তাঁর জন্মদিনে, উত্তর-প্রজন্মের পক্ষ থেকে জানাই লাল সালাম এবং প্রার্থনা করি তাঁর অন্তত সবল-শতায়ু...