নাসির আলী মামুনের স্মৃতিচারণ
সরব হুমায়ূন আহমেদ

ষাটের দশকের শুরুতে দৈনিক পত্রিকার খসখসে পাতায় চোখ রাখতাম ছবি দেখার জন্য। যদি কোনো বিখ্যাত কারো ফটোগ্রাফ ছাপা হতো, চোখ আটকে যেত সেই ছবির মানুষটির মুখে। ছবির আকর্ষণে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি অনেক। যা আমার সীমানায় আঁকা ছবিগুলো, স্বপ্নগুলোকে রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। পরে যখন ক্যামেরা ভিউ ফাইন্ডারে অনুসন্ধানী চোখ রেখে দেখলাম শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ের মানুষদের তখন কৌতূহলের অন্ত নেই। এরপর ক্যামেরা পাওয়ার পর পোর্ট্রেট ছবি তোলা শুরু। ১৯৭২ সালে খ্যাতিমানদের দিকে ক্যামেরা ফোকাস করি। আমি কি তাঁকে ৭২ সালে পেয়ে যাই? না, এর আগে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না।
তাঁর ওই সময়ে ক্যামেরা পাওয়া দুঃসাধ্য বিষয় ছিল। এই পথযাত্রার শুরুতে আমি একটি তালিকা তৈরি করি যাদের ছবি তুলব। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। যার কাছে যাই, তখন অনেককেই চিনি না। তাই আমি পাঁচজন বা দশজনের ছবি তোলার তালিকা করে ছবি তুলি। যাদের ছবি তুলি তারাই আমার তালিকায় নতুন নাম যুক্ত করে দেন। এরপর ১৯৭৭ সালে ১৬ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির প্রদর্শনী করি। সেই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের অনেক সৃজনশীল, মননশীল এবং বিখ্যাত লেখকের ছবি ছিল।
প্রদর্শনীতে স্থান পায় ৬৬ জন লেখকের ছবি। তাঁরা বেশির ভাগই প্রবীণ এবং তাঁদের অনেকের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে! ওই প্রদর্শনী দেখতে এসে একজন প্রতিষ্ঠিত কবি দর্শকদের মন্তব্য খাতায় লিখলেন ‘ছবি দেখে ভালো লাগল কিন্তু বেশির ভাগই মৃত ও মুমূর্ষু লেখক!’ এটা আমাকে গভীর পীড়া দিয়েছে। তাহলে আমি কি কোনো ভুল করলাম? তাহলে কি তালিকা আরো দীর্ঘ করা উচিত ছিল। ওই সময়ে তালিকা দীর্ঘ করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রথম প্রদর্শনী। তবে আমার উপকার হয়েছে মন্তব্যের কারণে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাদের অবদান আছে, নীরবে-নিভৃতে কারা কাজ করছেন, তাঁদের ছবি তোলা দরকার।
১৯৭৭ সালের পরে হুমায়ূন আহমেদ নামটিও আমার তালিকাভুক্ত হলো। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না। তখন এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তাঁদের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেন, জসীম উদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, মাহবুব উল্ আলম, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এবং আরো অনেকের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ আমার বয়স ও মেধার বিস্তর ব্যবধান থাকলেও কেমন করে যেন বন্ধু হয়ে গেছেন। আমার ক্যামেরার সামনে বসতে তাঁদের উৎসাহের কমতি নেই। ছবি তোলার সুবাদে এই বয়স্ক খ্যাতিমানদের অতীত দিনের কাহিনী শুনি। চাই খাই, আড্ডা হয়। কিন্তু আমার ছবি তোলার লেখকদের তালিকায় নতুনদের নাম যুক্ত করতে বললে তারা এমন সব নাম বলেন যারা আরো অধিক বয়স্ক। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী লেখকদের নাম করলে এঁদের কেউ কেউ তাঁদের বাতিল করে দিতেন।
এরাই তখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বড় লেখক। আমি তো সঙ্গত কারণে তাঁদের ছবি আগে তুলব।
কারণ তাঁরা মারাও যেতে পারেন। সেটাই আমি করেছি। এরপর হুমায়ূন আহমেদসহ আরো অনেক তরুণ লেখকের নাম আমার তালিকায় যুক্ত হলো। ওই সময়ে ইব্রাহীম খাঁর বাসায় যেতাম। সেই বাড়িটির নাম ছিল ‘দক্ষিণ হাওয়া’। ওই দক্ষিণ হাওয়াতে শেষতক হুমায়ূন আহমেদও থেকেছেন।
টাঙ্গাইলের প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ। বাড়িটির নাম দেওয়া তাঁরই। যদিও পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। সেখানে হুমায়ূন আহমেদ বসবাস করতেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটাই ছিল তাঁর আবাস। ইব্রাহীম খাঁ মারা যাওয়ার আগে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আমি ওই বাসায় নিয়মিত যেতাম। গল্প করতাম। টোস্ট বিস্কুট, মুড়ি খেতাম। নানান ধরনের গল্প। জাদুকর পিসি সরকার তাঁর ছাত্র ছিলেন। পিসি সরকার যখন জাদুবিদ্যা শিখছিলেন তখন একবার টাঙ্গাইলে এসে স্যারের পা ধরে সালাম করে গেছেন। সরকার তখন কলকাতায় থাকতেন। প্রিন্সিপাল বলেছিলেন, পিসি সরকার অমনোযোগী ছাত্র ছিল। কিন্তু পিসি সরকার ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত এক মানুষ। এ ছাড়া নানা গল্প হতো। সমাজ, দেশ, বাস্তবতা, লেখালেখি নিয়ে। ১৯৭৩ সালে ইব্রাহীম খাঁর পরিবারে একটা বিয়ে। ওনার নাতনির বিয়ে।
মানে গুলতেকিনের বিয়ে। তিনি আমাকে বলেন, ছবি তুলে দিতে হবে। তখন ফিল্মের দাম কম ছিল। হিসাব করে দেখি মাত্র পঞ্চাশ টাকা লাগে। সম্মতি দিলাম তুলব এবং আমি চট করে বলে দিলাম পঞ্চাশ টাকা। ওই দিন কোনো টাকা তিনি আমাকে দেননি। পরে একদিন যেতে বললেন টাকা নেওয়ার জন্য। প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর পকেট থেকে এক টাকার কয়েন, পাঁচ টাকার নোট মিলিয়ে সর্বসাকল্যে পঁচিশ টাকা দিতে চাইলেন। বিয়ে তাঁর প্রিয় নাতনির। তখন আমি ছিলাম বিশিষ্ট বেকার। আমার আকাশে এখনকার মতো সোনা রোদ রং উদিত হয়নি। এরপরে বললেন, আজ যাও বাকি টাকা ছবি তোলার পরে দেব। আমার আত্মসম্মানে লাগল। টাকা মাত্র পঞ্চাশ টাকা, পঁচিশ টাকাই বাকি। আমাকে একটা বিয়ের কার্ড দেওয়ার কথা, তিনি দেন নাই। কষ্ট পেলাম। আমি আর যাইনি। বিয়ের কার্ড পাইনি ফলে দেখা হয়নি। নাতনির বিয়ে কার সঙ্গে হচ্ছে তাও জানলাম না।
ওই সময়ে হুমায়ূন আহমেদ নামে একজন লেখক আছে জানতাম না। লেখা প্রকাশ হচ্ছিল ওটাও আমার দেখা হয়নি। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বিয়েতে যেতে পারলে ভালোই হতো। আমার হাতে দুর্লভ কিছু ছবি থাকত। ১৯৮৩ সালে আমি প্রথম তাঁর বাসায় গেলাম। তখন তিনি থাকতেন আজিমপুরের কাছে নিউমার্কেটের পশ্চিম পাশে, সুফিয়া ভবনের চারতলায়। তাঁর নাটক ছিল অসাধারণ। নাটকগুলো আমাদের দেশে পরিবারের সবাই দেখছে। সে সময়ে নাটকে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেন। কেমন মানুষ তিনি ভেতরে একধরনের কৌতূহল কাজ করতে থাকে আমার। তাঁর নাটকের মধ্যে কথ্যভাষা, আঞ্চলিক ভাষা, ঢাকার ভাষা নাটকে নিয়ে আসেন যা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এত ডায়ালগধর্মী নাটক, নাটকের ভেতর এত গল্প এর আগে কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি বলে আমার বিশ্বাস। সে বিশ্বাস আরো সত্যি হতে থাকে তাঁকে দেখার পর। আমি বলি তিনি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য লেখক।
এরই মধ্যে তিনি আমজনতার নাট্যকার হয়ে পড়েন। যদিও সেলিম আল দ্বীন বাংলাদেশের আরেক বড় নাট্যকার। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত মনে হয়। যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে পরিবারের কারো না কারো সঙ্গে চরিত্রগুলো মিলে যায়। নাটক দেখে দেখে আমি অবাক হতাম। আমি একদিন তাঁকে ফোন করে বাসায় যাই। গিয়ে দেখি তিনি খালি গায়ে সোফার মধ্যে বসে আছেন, লুঙ্গি পরা। এরপর অন্য রুমে গিয়ে একটি গেঞ্জি পরে চলে এলেন। আমি ধাক্কা খেলাম। এত বড় মানুষ! সারা দেশব্যাপী যার সুনাম। গেঞ্জি গায়ে! শার্টও না। আমি একজন আগন্তুকের মতো। এত বড় লেখক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, পিএইচডিধারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। হতবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাঁর ভেতরে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। কথা বলতে বলতে অনেক প্রসঙ্গ চলে আসে। খানিক পর আমি বললাম যে ১৯৭৭ সালে লেখকদের নিয়ে আমার করা প্রদর্শনীর কথা। বললাম, জানেন লেখকরা স্টার? এ কথা শুনে উনি একটু নড়েচড়ে বসলেন।
মেনে নিলেন আমাদের দেশের লেখকরা স্টার, আর না মানলে তাদেরকে অশ্রদ্ধা করার মতো মনে হয়, বললাম। তারা নানাভাবে বঞ্চিত। কোনো কোনো পরিবার তাঁদের পছন্দ করে না। রাষ্ট্র তাঁদের মর্যাদা দিতে জানে না, পুরস্কৃত করে না বরং অবমূল্যায়নের শিকার। আরো তাঁরা আর্থিক অনটনের শিকার। অবশেষে তাঁরা মারা যান না খেয়ে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই? আমি বললাম হ্যাঁ, প্রায় সবাই। তিনি চমকে গেলেন। বললেন, কী বলেন! ততদিনে আমি জেনে যাই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে গুলতেকিনের বিয়ের কথা। কিন্তু বলিনি যে, আপনার বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলাম। আমার যাওয়া হয়নি। মনে হলো তিনি আমার সব কথা শুনে প্রীত হলেন। আমি সবার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতাম। যাতে পরে তাঁকে আমার প্রয়োজনে লাগে ছবি তোলার সময় পাই। যে সোফায় তিনি বসে ছিলেন ওটি ছিল বড় সোফা যেন তিনি ঢুকে পড়লেন। অবাক হলাম প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর মতো একজন বিখ্যাত লোকের নাতনি বিয়ে করেছেন এই রকম একজন লোক! যে ইব্রাহীম খাঁর নামের আগে প্রিন্সিপাল না থাকলে অপূর্ণতা থেকে যেত! আমি তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, তখন আমি গুলতেকিনকে দেখি।
হুমায়ূন আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিলেন। বলেন যে, উনি (আমাকে) লেখকদের ছবি তোলেন। ওই দিন চলে আসার সময় হাতে লিখে তিনটি বই উপহার দিলেন তিনি। আমাকে বলেন, জানেন আমিও ছবি তুলি। ছবি তোলার প্রতি আমার শখ আছে। তবে আপনার মতো এত সিরিয়াস না। আমি আমার ছবি তুলি, আমার সন্তানদের ছবি তুলি, যা ভালেঅ লাগে তা তুলি। তখনো আমার কোনো নিজস্ব ক্যামেরা ছিল না। আমি প্রথম ক্যামেরাটি কিনি ১৯৭৩ সালে, ৬০০ টাকা দিয়ে। আবার কাওয়া কিনি ১৯৭৬ সালে ৮০০ টাকা দিয়ে। এরপর ১২০ ইয়াসিকা বক্স ক্যামেরা কিনি ১৯৭৬ সালে। যদিও ওটা পরে চুরি হয়ে যায়। শুনে তিনি বলেন, এটা নিয়ে যান। ক্যামেরা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন। আমার মনে হলো আমার কোনো প্রিয় খাবার আমি পেলাম। ওই দিনই তিনি আমাকে তাঁর প্রিয় ক্যামেরাটি দিয়ে দেন। আমার ঠিকানা না জেনেই! আমি বিস্মিত হই। এর মধ্যে ওনার এক ছোট্ট মেয়ে বের হয়ে আসেন। আমাকে বলেন মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলতে। মেয়েটি আমাকে বলে, গুখাবি! আমি হাসতে লাগলাম।
অনেক পরে আমি নাটক দেখে বুঝলাম যে, তাঁর মেজো মেয়ে শিলা। ছবি তুলতে কষ্ট হলো, কারণ উনি ছিলেন অস্থির প্রকৃতির। আমি তাঁকে যুতসই কোথাও বসাতে পারলাম না। একবার এখানে আরেকবার ওখানে, এই করতে থাকেন। প্রথম দিন নতুন পরিচয়, ছবি তুলছি, তাই আমি আর আমার মতো করে ছবি তুলতে পারলাম না। আমেরিকা থেকে যে ক্যামেরা নিয়ে আসেন তা দেখিয়ে নাইকন ৩৫ এমএম আমাকে বলেন, আমার এটা দিয়ে তো চমৎকার ছবি ওঠে। আমাকে বললেন ক্যামেরাটা নিয়ে যাওয়ার জন্য, প্রয়োজন হলে। ওই দিন আমি ইতস্তত হই। একবার ভাবি বলব, এত সুন্দর একটা ক্যামেরা ! দামি ক্যামেরা। জাপানি নাইকন ক্যামেরা। মন চাইলেও আত্মসম্মানবোধ আমাকে ‘না’ করে দিল। অন্য একদিন ফোন করে আমি তাঁর বাসায় যাই। প্রথম দিনের ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে যাই। বাসায় ছিলেন না। বাজারে গেছেন জেনে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি।
কিছুক্ষণ পর দেখি তাঁর হাতে বাজারের ব্যাগ। অন্য হাতে বিচিত্রা। গায়ে শার্ট ও পরনে লুঙ্গি। চারটা ছবি নিয়ে যাই। তার মধ্যে থেকে তিনি একটা ছবি পছন্দ করেন। বলেন, আপনি তো ভালো চশমায় রিফ্লেকশন করে ছবি তোলেন। আমি তখন চট করে বলে ফেলি, না আসলে আমি রিফ্লেকশন পছন্দ করি না। ছবিতে আলো-আঁধারের খেলার মাধ্যমে ছবি তুলি। যেমন সারা ঘরের সব দরজা-জানালা খোলা রেখে শুধু একটা জানালা খোলা রেখে প্রাকৃতিক আলোতে ছবি তুলি। এটা সুন্দর। চশমায় রিফ্লেকশন! এটা তো ছবির অলংকার। আমি খুশি করার জন্য কথাটা তাকে বললাম। কিন্তু আমি আবারও অবাক হলাম যে, তিনি ছবির নান্দনিকতা বোঝেন। আমাকে বললেন, ক্যামেরা লাগবে? আমি মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ানো আর কি। তিনি ভেতর থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এলেন। আমার হাতে দিলেন। মনে হলো আমার প্রিয় এবং মহামূল্যবান কোনো জিনিস এই মাত্র পেলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে একটা কাজ করার কথা বললেন। দুটি ফিল্ম দিলেন। গ্রিন রোডে স্টুডিও নেহারে আমি নিয়মিত যাই। ও কথা তাঁকে বলেছি। আমি ওই স্টুডিওতে তাঁর ফিল্ম দুটি দেই। ওই দিনই স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ সেরে নেই। কিন্তু পাওয়া গেল unexpose ফিল্ম, আমার ভেতর শঙ্কা কাজ করল, যদি উনি ক্যামেরাটা নিয়ে যান?
কিন্তু আমি ওনাকে না জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অফিসে চলে যাই। তিনি শুনে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না। অথচ বললেন, আমার ছবি তো উঠে নাই তাহলে তো বালোই। বাহ! ভুতুড়ে কাণ্ড। আপনার কোনো দোষ নেই। সম্পর্ক গড়ে উঠতে তাঁর ক্যামেরা আনি আর ব্যবহার করে দিয়ে আসি। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে কবি সম্মেলনে গিয়েছি কলকাতায়। যদিও দলে আমি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন কবি। আমার সঙ্গে যান কবি শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ, রুবি রহমান, বন্ধু আবু হাসান শাহরিয়ার, ফরিদ কবির এবং আরো কয়েকজন।
তাঁকে না জানিয়ে নাইকন ক্যামেরা নিয়ে কলকাতা চলে যাই। সঙ্গে আমার পুরোনো ক্যামেরাও ছিল। আমাদের শিয়ালদা রেলস্টেশনে স্বাগত জানান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রথম আমি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দেখি। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় ক্লিক করি। শামসুর রাহমান ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। অসাধারণ সে মুহূর্ত। আমি সাক্ষী হয়ে গেলাম। সত্যজিৎ রায়, অমিয় চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সমরেশ বসুর ছবিও তুলে ফেলি। আমার সামনে ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সব মানুষ। আমি ভাবতে থাকি এটা আমার ক্যামেরা। আবার রাতে যখন ঘুমাই মনে হয় না এটা হুমায়ূন আহমেদের ক্যামেরা। এরপর আমি প্রায় চার মাস দেখা করিনি। একদিন ওই নেহার স্টুডিওর ঠিকানায় হুমায়ূন আহমেদের একটি চিঠি আসে, ‘প্রিয়বরেষু, আমার ক্যামেরাটি একটু প্রয়োজন। তুমি কি এসে দিয়ে যাবে’। সম্ভবত প্যাডে লেখা। মনে হলো তাঁর কোনো ছাত্রের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। চিঠি পাওয়া মাত্র আমি চলে যাই। ভয়ে ভয়ে গিয়ে আমি বলি অসাবধানবশত ক্যামেরার লেন্সকভারটি খুলে গেছে।
তিনি বলেন ভালোই তো যাক এতদিন পর আমার ক্যামেরাটা একটা ভালো কাজে লাগল। সমরেশ বসুর ছবি তুলেছি শুনে তিনি খুশি হলেন। তিনি বলেন, কবে আপনি আমাকে ছবিগুলো দেখাবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ দেখাব। আবার ক্যামেরার সামনের লেন্সক্যাপটা সুতা থেকে ছিঁড়ে যাওয়ার কথা বলি। তিনি বলেন, আরে ক্যামেরা চললেই হলো। আমি ওই দিন চলে আসি ক্যামেরা দিয়ে। এরপর আস্তে আস্তে ছবিগুলো প্রিন্ট করি। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে গিয়ে ছবিগুলো দেখাই। তিনি আনন্দে আত্মহারা। আমাকে বললেন, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ছবি তুলেছেন? আমি হ্যাঁ বললাম। জানেন তিনি হলেন রবীন্দ্র জীবনীকার। রবীন্দ্রনাথ কোনদিন কী করতেন খুঁটে খুঁটে তিনি লিখতেন। তখন টাইপ মেশিন ছিল না তাঁর। রবীন্দ্রনাথ কী করতেন, কার সঙ্গে দেখা করতেন, কখন কোথায় যেতেন। এক কথায় প্রত্যেক দিনকার দিনলিপি তিনি লিখেছেন। নির্মোহভাবে। কত নিষ্ঠা এবং ত্যাগ থাকলে একজন মানুষ এটা করতে পারে। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া ! আপনি জানেন কি? আমাকে প্রশ্ন করলেন হুমায়ূন আহমেদ। বললাম, হ্যাঁ। আবার দেখা করতে ইচ্ছা হলো। তাঁর চেহারাটা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। আপনি রবীন্দ্রনাথের ছবি বলে চালিয়ে দিতে পারেন! হুমায়ূন আহমেদ ঠাট্টা করলেন। কথায় কথায় সমরেশ বসুর কথা চলে আসে। সমরেশ বসুর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘জানেন উনি ঢাকায় আসতেন। সুন্দরী মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলে প্রেম করতে চাইতেন।’ আলাপ শেষে ওই দিন চলে আসি।
হুমায়ূন আহমেদ যেমন জীবনযাপন করতেন, তা আমাকে তখন থেকেই অবাক করত। আমাদের দেশে শিল্পী এস এম সুলতানের মতো তিনি একাই শুরু একাই শেষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অফিসের টেবিলে ফুলদানিতে রাখা পাতাসহ কাঁচা তেঁতুল দেখে লোকটির দৈর্ঘ-প্রস্থ মাপতে হয় আমাকে। এমন অদ্ভুত মানুষের দেখা পাইনি আগে। এই ঘরানার, এই ধরনের জীবনযাপনের অধিকারী আর কেউ ছিল না বলে আমার বিশ্বাস। এই চিন্তাচেতনায় মানুষ আমি আর পানি, যখন যেমন তখন তেমন। শুধু দুজনকে পেয়েছি। এক শিল্পী এস এম সুলতান আর হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অহংকারী। আবার অন্যের কাজের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল, ওয়াকিবহাল। তাঁর জীবন ছিল নাটকের মতো, উপন্যাসের মতো উথাল পাথাল। এটা শিল্পী এস এম সুলতানের ক্ষেত্রেও ছিল। তিনি আর অন্য দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করেননি। অথবা বাংলাদেশের অন্য কোনো লেখকের মতো জীবন-যাপন করেননি। যেটা মাত্র একজন ব্যক্তি করেছেন, তিনি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ধ্রুব সত্য এই যে তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা করে ছাড়তেন। আমি মনে করি উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারী চরিত্র সেরা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বাঙালির সকল চরিত্র হজম করে ফেলেছেন এবং এরপরই লিখতে বসেছেন। বাংলা ভাষায় হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে, একসঙ্গে অনেকগুলো মাধ্যম মানুষের মধ্যে সাড়া জাগাতে পেরেছে।
বাংলাদেশে আর কোনো লেখক তা পারে নাই। বাঙালির চরিত্র কী রকম, সে কী চায়, সব রসায়নই দিতে পেরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ জীবনচর্চা করতেন। শুধু বই পড়ে না। এই জন্যই আমি কালজয়ী লেখক বলব। এটা আমার ধারণা নয়, আমার বিশ্বাস। হুমায়ূন আহমেদ জাদু জানতেন। প্রথম দিকে তিনি স্যাটায়ার ম্যাগাজিন উন্মাদে নিয়মিত লিখেছেন। আমার মনে হয় তাঁর মধ্যে রসবোধ ও হাস্যরস দুই ধরনের বোধ ছিল। এই রকম লেখক সাধারণত হয় না। আশির দশকে উনি বিচিত্রা ও দৈনিক বাংলায় নিয়মিত যেতেন। ওই সময়ে বিচিত্রা সম্পাদনা করতেন শাহাদত চৌধুরী। কবি শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলা ছেড়ে দেওয়ার পর তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক হলেন আহমেদ হুমায়ূন। ১৯৮৬ সালে তিন হুমায়ূন- আহমেদ হুমায়ূন, হুমায়ূন আহমেদ ও হুমায়ূন আজাদ। আমি একসাথে এই তিন জনের ছবি তুললাম। তাদের সম্পর্ক তখন অটুট ছিল। পরে অবশ্য হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনা শুরু করেন। হুমায়ূন আজাদ বলেন হুমায়ূন আহমেদ নাকি অপন্যাসিক। আমাদের দেশে সৃজনশীল মানুষের মধ্যে যেমন সহনশীলতা থাকা দরকার তা তাদের মধ্যে নেই। হুমায়ূন আহমেদ শেষের দিকে স্বেচ্ছায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত পাশের মানুষদের উপেক্ষার কারণে। শামসুর রাহমান জীবিত থাকতে দুঃখ করে বলছেন-জীবিত থাকতেও আমার বন্ধুরা মৃত। এটা রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও ব্যাপকভাবে ঘটেছে। অনেকেই বলে হুমায়ূন আহমেদ নাকি জনপ্রিয় লেখক।
আর জনপ্রিয় কথার জন্ম হয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদের ওপর তো অনেক বই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয় নাই। ফরিদপুরের আলতাফ হোসেনকে ওই সময়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার দেওয়া, আমাকে ক্যামেরা এবং এ রকম আরো অসংখ্য ঘটনা উনি ঘটিয়েছেন। কিন্তু এটা মনে হতো, না বুঝে। আসলে বুঝেই করতেন। এরপর দৈবক্রমে ১৯৮৭ সনে আবার দেখা হয় বিটিভিতে। আমার তোলা ছবি নিয়ে গেছি। একটা ইন্টারভিউ হবে আমার। অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করেছেন কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। বের হয়ে আসতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর ছবি আছে কি না। আমি বললাম না, বেশির ভাগ বয়স্ক কবি ও লেখকদের ছবি। এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখেন তো ইব্রাহীম খাঁর ছবি আছে কি না? আমি ভয় পেয়ে গেলাম। না থাকলে বিপদ। আমি খুঁজতে লাগলাম, অবশেষে পেলাম। হ্যাঁ আছে। উনি দেখলেন। যাও সাত খুন মাফ, হাসতে হাসতে বললেন। ছবি দেখে বললেন আরে বুড়া তো বেশ ভালোই অভিনয় করেছে।
বাহ্! আমি বললাম, হুমায়ূন ভাই ওটা অভিনয় না!
এরপর দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে। উনি অপরাজেয় বাংলার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, চলো, যাবে নীলক্ষেতে? বই কিনতে যাব। আমি তখন আহমেদ ছফা ভাইয়ের হোস্টেলে যাচ্ছি। শুনে তখন তিনি আর জোর করলেন না। তাঁর প্রথম লেখা বই আহমদ ছফা ছাপেন। উনি চলে গেলেন। আমিও ছফা ভাইয়ের হোস্টেলের দিকে চলে যাই। আগেই বলে গেছি আমি যে যাব। ওখানে গিয়ে দেখি আহমেদ ছফা দুপুরের খাওয়া খাচ্ছেন। আমাকে খেতে বলছেন না। আমার ক্ষুধা পেয়েছিল। আমি বিরক্ত ও বিষণ্ণ। আমি বললাম, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। চট করে ছফা ভাই বলে বসলেন-‘মনে হয় ওখানে এক ব্যাগ টাকা আছে ও ওখানেই যাচ্ছে।’ আমি এস এম সুলতানের কাজে গিয়েছিলাম। ওনার ঢাকায় থাকার অসুবিধা হচ্ছিল। ছফা ভাই বললেন, ঠিক আছে তাঁকে ধরে নিয়ে আস। রাজ্জাক সাহেব বলেছেন সমস্যা হবে না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে চলে এলাম।
আহমেদ ছফা বলেন,‘হুমায়ূনের জন্য ঘাম ঝরিয়েছি অনেক। সে এখন আমার বুকের ওপর দিয়ে চলে গেল।’ খান ব্রাদার্সকে দিয়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বইটি ছাপেন। ওই বইটি হলো ‘নন্দিত নরকে’। যদিও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আগে লিখেছেন। আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদের বই ছাপবার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘একদিন আমি যাইয়ে ওরে ধরব; সে কেন এখন সস্তা দরের লেখা লিখতে যায়। ওর হাত তো অনেক ঝরঝরে। দরকার হয় আমি ভিক্ষা করে টাকা জোগাড় করে দেব। কেন সে ওসব লিখে? এরপর সপ্তাহ দুই পরে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ক্যামেরা আছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ আছে। ফিল্ম আছে? কিনে দেব? আছে, লাগবে না, আমি উত্তর দিলাম। তাঁর সঙ্গে হেঁটে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত এলাম। কোনো রিকশা পাচ্ছি না। তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হলো। বাম হাতে সিগারেট ধরালেন, আর ডান হাতে কতক্ষণ পরপর টানছেন। এরপরও রিকশা না পেয়ে হাঁটা শুরু করি। বাংলা একাডেমি পার হতেই তিনি বলেন, চলো ভিক্ষুক দেখতে যাই। হাইকোর্টের মাজারে। নূরা পাগলারে দেখেছো? হ্যাঁ, দেখেছি। নূরা পাগলা উলঙ্গ অবস্থায় নাঁচছে। ওকে দেখার ও কথা বলার খুব ইচ্ছা করছে। দালাল আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওখানে যে বিকলাঙ্গদের এনে ব্যবসা করছে তা জানতে হবে। আমি বললাম, ওদের নিয়ে অনেক চাঁদাবাজি হয়। এতক্ষণে আমরা হাঁটতে হাঁটতে মাজারের সামনে চলে আসি। যদিও হাইকোর্টের ওই জায়গা অনেক পরিচিত। আমরা পঞ্চাশের দশকের শেষে হাইকোর্ট এলাকায় থাকতাম।
আব্বা হাইকোর্টে চাকরি করতেন। পাশে ছিল রেসকোর্স ময়দান, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। অতীতে প্রতি রোববারে ঘোড়দৌড় হতো। আর দেখেছি অনেক পাখি। সবচেয়ে অবাক করেছে টিয়া পাখি, যা অনেক বড় পাখি। এরপরে আমি এরকম টিয়া পাখি দেখিনি। পরে বিদেশে গিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখেছি। আমি বললাম, ওদের ওখানে যারা দালাল তাঁদের কাছে অস্ত্র থাকে। তিনি বলেন, কী হয়েছে আমরাও অস্ত্র নিয়ে যাব। আমরা পরে দৈনিক বাংলায় পৌঁছালাম। আমি কবি আহসান হাবিবের সঙ্গে গিয়ে বসি। আহসান হাবিব খুব গম্ভীর মানুষ। হঠাৎ করে উদভ্রান্তের মতো শিল্পী অলকেশ ঘোষ এসে পড়েন।
তিনি বলতে বলতে এলেন, এবার যদি না হয় তা হলে সব ফেলে দেব। আহসান হাবিব দেখে বলে, ভালো হয়েছে। আমি অলকেশ ঘোষের সঙ্গে বের হয়ে তাঁর ছবি তুলতে চাইলাম। তিনি ‘না না’ করলেন। তারপরও আমি দু-দুটি ছবি তুললাম। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কাছে বিচিত্রা অফিসে যাই। তিনি আমাকে না জানিয়ে চলে গেলেন। আমি মনে মনে স্থির করি আর আমি হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে যাব না। অতঃপর আমি আহমদ ছফা ভাইয়ের কাছে যাই। তিনি আমাকে দেখে রেগেমেগে আগুন। হুমায়ূনের সঙ্গে থাকতে থাকতে তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে! এস এম সুলতান কই?
এমন ভঙ্গিতে কথা বললেন মনে হলো আমি এস এম সুলতানকে পকেটে করে নিয়ে আসতে পারি। আরো মনে হলো আমি তাঁর চাকরি করি। আমিও এস এম সুলতানকে ভালোবাসি। জানালাম, বাসভাড়া নেই আমার পকেটে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তখন বিশাল ব্যাপার। আমাকে নির্দেশের মতো বলা হলো রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে জরুরি দেখা করতে। সব ব্যবস্থা করা আছে।
তিনি আমাকে ১০০ টাকা দেন। অপ্রকাশিত একজন মানুষ এস এম সুলতান। আল্লাহর ওপর ভরসা করে নড়াইল গেলাম। ওখান থেকে এসে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করি।
হুমায়ূন আহমেদের কাছে এস এম সুলতানের কথা বলি। তিনি বলেন, আরে তিনি সাপ, বিড়াল এসব নিয়ে থাকেন। তাঁর তুলি নাকি হাতুড়ির মতো, দাঁত নাকি একেকটা তিন ইঞ্চি লম্বা! আমি বলি, আরে না। ওসব কিছু না। একদিন বড় বেকাদায় পড়ে যান শিল্পী এস এম সুলতান। তাঁর প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই তাঁকে চিকিৎসা করাই, তাঁর কাছে তো টাকা থাকার কথাই নেই। আমার মনে পড়ে ডা. আবু হায়দার সাজেদুর রহমান সাহেবের কথা। তিনি পিজিতে বসেন। দাঁতের ডাক্তার। একদিন গিয়ে তাঁর ছবি তুলে আনলাম। ছবি তোলার পর বললাম, সুলতান নামে একজন শিল্পী আছে চিনেন?
তিনি যদি আপনার রোগী হতে চান তাহলে! তিনি শুনে বলেন, নিয়ে আসেন, আমি দাঁত তুলে দেব আর দাঁত তোলার পর কিছু টাকাও দিয়ে দেব। আমি এস এম সুলতানকে নিয়ে যাই। তিনি গান গাইতে গাইতে দাঁত তোলা শুরু করেন। আমার দিলটারে চাক্কু মেরে হাইজাক করে…। ওই গানটা ওই ডাক্তারেরই লেখা। এর মধ্যে এস এম সুলতানের দাঁত তুললেন। আমি ওই দাঁত এখনো রেখে দিয়েছি। ওই দাঁত আমি জাদুঘরে রাখব। দাঁত তোলার ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ বেশ আয়েশের সঙ্গে উপভোগ করলেন।
১৯৮৬ সালে বিতর্কিত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর কাছে কেউ ভিড়তে পারেনি। আমি ও কবি বেলাল চৌধুরী ছিলাম তাঁর সঙ্গে সাতদিন। তখন হুমায়ূন ভাইয়ের ছবি তোলার কথা তাঁর বইয়ের জন্য। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য যেতে পারিনি। এর জন্য তিনি আমার প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ হন। তাঁকে সে সময় গুন্টার গ্রাস সম্পর্কে বললাম। তিনি কোনো পাত্তাই দিলেন না। গুন্টার গ্রাস পার্থক্য খুঁজেছেন দুই দেশের মধ্যে। তিনি বলেন, কলকাতার সঙ্গে তোমাদের শহরের পার্থক্য হলো তারা চাঁদ দেখতে পায় না, তোমরা চাঁদ দেখতে পাও। ওই সময়ে বিচিত্রায় ঈদ সংখ্যায় নিয়মিত লেখা ছাপা হতো হুমায়ূন আহমেদের। তখন রোববারে নিয়মিত লিখতেন ইমদাদুল হক মিলন। প্রকাশক ছিল কম। বইমেলা তেমন জমত না। মির্জা আব্দুল হাই, আবু ইসহাক, হাসান আজিজুল হক ওঁরাও লিখতেন। এরপরে যদিও হুমায়ূন আহমেদ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন বাংলা সাহিত্যে। সেই সময়ের মধ্যে তিনি আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তারও আরো আগে ১৯৮৩ সঙ্গে তাঁকে দেখি। বাংলাবাজারে। ওখানে মাসুক হেলাল আমার বন্ধু ও যেত।
নওরোজ কিতাব স্থান জর্জ সাহেব সেই কিতাব স্থানের মালিক। ওখানে সাহিত্য আড্ডা হতো। এখন আর ওসব দেখা যায় না বাংলাবাজারে। ওই সময়ে শওকত ওসমান স্যারকে যেতে দেখেছি। হুমায়ূন আজাদকে একবার দেখেছি। ইমদাদুল হক মিলন, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকেও দেখেছি। একদিন আমি বাংলাবাজারের নওরোজ কিতাব স্থান জর্জ ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম। ওই রুমে ইঁদুর ঢোকার যায়গাও নেই। কিন্তু দেখলাম হুমায়ূন আহমেদ খাচ্ছেন আর কিছু টেবিলের নিচে দিয়ে ফেলছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন বিড়াল আছে খেয়ে নেবে। আমি ভালো করে টেবিলের নিচে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি কিছু নেই। তিনি বলেন, তাহলে ইঁদুর আছে খেয়ে নেবে।
নওরোজ থেকে জীবনানন্দের বনলতা সেন বইটির বের হয় কয়েক বছর আগে। বইয়ের প্রচ্ছদে ছিল আমার তোলা ছবি। সে ছবি ছিল জর্জ সাহেবের স্ত্রীর। প্রত্যেক বছর বইটি পাওয়া যেত। সে সময়ে হুমায়ূন আহমেদ এটা জানতেন না। আমি ওই সময়ে বলার পরে জানলেন। দেখে বলে বাহ! সত্যি তো বনলতা সেন! জর্জসাহেব বলেন, আরে এটা আমার বৌয়ের ছবি। আরো কয়েকদিন আমি তাঁকে দেখি বাংলা বাজারে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য কোনো ছবি তুলিনি। তিনি খুব দ্রুত হাঁটতেন। তাঁর সঙ্গে প্রায়ই লোকজন থাকত। তাঁর পোশাক আশাক এমন ছিল যে, তিনি সব সময় খুব ঢিলেঢালা জামা পরতেন। পোশাক-আশাকে তিনি আধুনিক ছিলেন না। তিনি মনে হয় পোশাকের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। ওই সময়ে ঢাকাতে দর্শনীয় বিনিময়ে শুরু হয় কবিতা পাঠ। ৮১ সালে পদাবলি নামে ওই অনুষ্ঠান শুরু হয়।
তখন কবি ও লেখকদের ভেতর দলবাজি শুরু হয়। সবাই গেলেও কবি নির্মলেন্দু গুণ দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠ করতে রাজি হননি। হুমায়ূন ওসব শুনে বলেন, আরে দর্শকদের এখন এত ধৈর্য আছে নাকি! তাঁরা কিনা উপন্যাস বা গল্প শুনবে? আবার লেখকদেরও মাত্রাজ্ঞান নেই। দেখা গেল তাঁর পাশের দর্শক সব চলে গেল, ও তখনো উপন্যাস পড়ছে। আমি ওসবে নাই। বিভিন্ন ধরনের গল্প করতেন। টিকটিকি সম্পর্কে একটা গল্প যে, মাছের চেয়ে বড় টিকটিকি। বললেন, একবার খুলনাতে যাই, ওরা রান্না করেছে। পাতিলের ভেতর দেখি টিকটিকি। আমি ওদেরকে না জানিয়ে পালিয়ে চলে আসি। তখন লেখকদের আড্ডা হতো। কিন্তু ওই সময়ের দলবাজিতে জড়ালেন না। তিনি কোনো গ্রুপে থাকলেন না। তবে সব মত ও দলের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। ওই সময়ে একটা বইমেলার কথা এখনো মনে পড়ে। কলকাতার বিখ্যাত কবি গৌরকিশোর ঘোষ শামসুর রাহমানের ছবি তুলছেন। ওই সময়ে ভিড় হতো। এখনকার মতো এত ভিড় ছিল না। ওই মেলায় সৈয়দ শামসুল হকের একটি বই বের হয়। নাম ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান।’ প্রচ্ছদে ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ন্যাড়া মাথার ছবি। সম্ভবত তখন বিচিত্রায় একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয় দুজনের একসঙ্গে।
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার লেখা নিয়ে আমার কোনো আপসোস নেই আর সৈয়দ শামসুল হক বলেন, আমার লেখা নিয়ে আমার সংশয় রয়ে যায়। এটি ১৯৮৫ সালের কথা বলছি। ওই সময়ে হুমায়ূন আহমেদ ছফার সঙ্গে ছবি তোলার কথা বলেন। আমি তখন ছবি তুলতে পারিনি। আহমেদ ছফার কাছে অন্য একদিন গিয়ে বললাম বিষয়টি। তিনি বলেন আরে হুমায়ূন তো এখন অনেক বড় লেখক। ও আসলে আমি ওকে কোথায় বসতে দেব। ঠিক আছে নিয়ে এসো। আমি ১৯৮৬ সালে খুব ব্যস্ত। তাই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তেমন দেখা হয়নি। তিনি একদিন শিল্পকলায় কবি আল মাহমুদের রুমে নিয়ে গেলেন। আল মাহমুদ গল্প শুরু করেন। তিনি হুমায়ূনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি লিখেছি আব্বাস উদ্দিন কত বড় শিল্পী, কত দিগন্ত বিস্তৃত শিল্পী। বাংলাদেশে আর কেউ লিখতে পারবে না। এই বলে দুই জনে সিগারেট ধরালেন। তাঁরা গল্প করতে লাগলেন, আল মাহমুদ বলেন, আমি আরব দেশে গেলাম, তখন মরুভূমি দিয়ে যাচ্ছি, ড্রাইভার একটা গান ছাড়লেন। ওই গান আমাকে মুগ্ধ করে। গানটি আরবের বিখ্যাত গায়িকা আলিফ লায়লার। তখন আমার আব্বাস উদ্দীনের কথা মনে পড়ে গেল। শুনে হুমায়ূন ভাই বললেন, আপনি আব্বাস উদ্দীনকে নিয়ে একটা বই লেখেন না কেন। মাহমুদ বলেন, সব আছে আমার দর্পণে। লিখে দিতে পারি। আর কেউ পারবে না কসম করে বলতে পারি। আব্বাসউদ্দীন নিয়ে দশ লাইন লেখার যোগ্যতা কারো নেই।
এমন কথা শোনার পর হুমায়ূন ভাই বলে ওঠেন, তাহলে আমি আর আপনার সামনে থাকতে পারছি না। উঠে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমার গল্প শুনতে ভালো লাগছিল না। আমি হুমায়ূন আহমেদকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে আসি। কিন্তু আমি ওই সময়ের ছবি তুলে রাখিনি। ইত্তেফাকে গিয়ে রাহাত ভাইয়ের রুমে বসি। খানিক পর দেখি কবি সুরাইয়া খানম আসছেন। তখনো আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদের আড্ডার আমেজ কাটেনি। তখন আমাদের দেশের যত নারী লেখিকা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর। তাঁর সঙ্গে প্রেম করার জন্য সবাই ব্যস্ত ছিলেন। রাহাত ভাই বলছেন, হুমায়ূন আহমেদ অঝোরে লিখছেন। ইত্তেফাক থেকে বের হতে দেখি কবি ত্রিবিদ দস্তিদার, আমি তাঁর ছবি তুলেছি। একান্ত উদার ও মুক্তমনা লোক ছিলেন। ওই সময়ে প্রকাশনা শিল্প এতটা উন্নত ছিল না। এখনকার মতো আধুনিকও ছিল না। তাই বইয়ের বাজার এতটা বিস্তৃত ছিল না।
কিন্তু আমার নাম-ডাক ছিল। নাম-ডাক থাকলে কী হবে? আমি লেখা অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদের ছবি তুলতে পারিনি। পারব কী করে, তিনি তুলতে না দিলে? তিনি বলেন, এ রকম ভণ্ডামি করে আমি ছবি তুলব না। যে আমি অনেক বড় লেখক! তাই তিনি ওই মূহূর্তের ছবি আমাকে তুলতে দিলেন না। আমারও আর ওই রকম ছবি তোলার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু আমি অবাক হই যে, অনেক বিশিষ্টজনের ছবি তুলেছি। ছবি তোলার সময় ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখতেই মনে হয় যেন প্রত্যেককে একেকজন একেবারে শিশুর মতো। এমন কিছু সময়কে ধারণ করতে পেরেছি যা আমাকে আলোড়িত করে। মনে হয় প্রত্যেকে আমাকে অনন্য সব মুহূর্ত দান করেছে। ঠিক হুমায়ূন আহমেদও তাই।