হাসির গল্প
নাম বিভ্রাট

ঘরের দরজা খুলে আমি ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারলাম না। তার আগেই একটা দশাসই থাপ্পড় এসে পড়ল আমার গালে। সাঁই করে একটা আওয়াজ আমার কানের কাছ দিয়ে চলে যেতে শুনলাম। থাপ্পড়টা এত জোরে আমার বাঁ গালে এসে পড়ল যে আমি সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারলাম না। একটু টলে গেলাম। তারপর উঃ শব্দ করে, গাল ধরে বসে পড়লাম মাটিতে। আমি তখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি। চোখে-মুখে অন্ধকার অন্ধকার দেখলে কি মানুষ শর্ষে ফুল দেখে! হবে হয়তো।
বড়দা থাপ্পড় মেরে দরজার ওপাশে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গায়ে ঘিরে রঙা ফতুয়া। ঢিলেঢালা পায়জামা। মুখে কদিনের না কাটা দাড়ি-গোঁফ। নাকের ওপর ঝুলে আছে গোল চশমা। বড়দার চোখ-মুখ করমচার মতো লাল হয়ে আছে। আমি থাপ্পড় খেয়ে বসে পড়লে বড়দা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, খুব বেয়াদব হয়ে গেছিস? মনে করিস আমি কিছু বুঝি না, না?
বড়দার হাতে ছিন্নপত্র। আমরা অভিযাত্রিক ক্লাবের পক্ষ থেকে ছিন্নপত্র নামে একটা স্মরণিকা বের করছি। তাতে বড়দার ‘যখন আমি ঘুমায়ে ছিলাম’ শিরোনামে একটা গল্প আছে। ছিন্নপত্র প্রকাশের আগে নির্ধারিত মিটিংয়ে ক্লাবের সভাপতি সেলিম ভাই জোর-জবরদস্তি করে ছিন্নপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমগো মহল্লায় পোলাপাইনেগো মইদ্যে একমাত্র মন্টুর ছড়া-কবিতা পেপার-উপারে ছাপা হয়। হেল্লাইগা আমি সিদ্ধান্ত লিছি ছিন্নপত্রের সম্পাদনার দায়িত্ব অরেই দিমু। তোমরা কী কও?’ এতটুকু বলে সেলিম ভাই একটু থামলেন। দম নিলেন। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘খালি মন্টু ক্যালা অর চাচাতো বড় ভাই কী জানি নাম’, বলে সেলিম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে তাকালেন, ‘হ, হ, মনে পড়ছে খান মুহম্মদ দেলোয়ার হ্যায়ও তো গল্প-কবিতা লেখে। ছিন্নপত্রের লেখা-উখা লিয়া আমাগো আর চিন্তা করতে হইব না। লেখা জোগাড় করুম, ছাপার-ছুপার সব কাম করব মন্টু। বিজ্ঞাপন আনুম আমি।’
ক্লাবের সভাপতি সেলিম যখন এ রকম ঘোষণা দিলেন, তখন তার কথার ওপর কেউ কি আর কিছু বলে?
সেলিম ভাইয়ের কথায় আমার ওপর বিশাল গুরুদায়িত্ব এসে পড়ল। আমি একটু গাই-গুই করা শুরু করলে সেলিম ভাই বললেন, ‘আবে তর আর চিন্তার কী আছে? ছিন্নপত্রে তরে সাহাইয্য সহযোগিতা করনের লাইগা আমি তর লগে আরো দুই-চারজন জোগালি জোগাড় কইরা দিতাছি’, বলে সেলিম ভাই আনিস, ফজলু, শাহনেয়াজ আর তোতলা বাবুকে নির্বাহী সম্পাদক, সহযোগী সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমার জোগালি বানিয়ে দিলেন।
আমরা দায়িত্ব পেয়ে উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। বড়দাকে লেখা দেওয়ার জন্য বললাম। বড়দা আমাদের কয়েক দিন ভাব দেখাল। বলল, বললেই কী আর লেখা হয় রে? লেখা চাইতে গেলে বিনয়ের সঙ্গে চাইতে হয়।
বড়দার কাছে আমরা অধিকতর বিনয়ের সঙ্গে লেখা চাইলাম। দিন কয়েক ঘুরিয়ে আমাদের লেখা দিলেন। লেখা দেওয়ার আগে বড়দা বললেন, শুধু তোরা বলে আমি কনসিডার করলাম। জানিসই তো, এই খান মুহম্মদ দেলোয়ার আলতু-ফালতু পত্রিকায় লেখে না।
ছিন্নপত্র দু-একদিনের মধ্যে বের হবে। গত দশ-বারো দিন ছিন্নপত্রের লেখা জোগাড়, কম্পোজ, প্রুফ দেখা, আর্টিস্টের কাছ থেকে প্রচ্ছদ আর অলংকরণ আনা আর সময় নাই, অসময় নাই প্রেসে যাওয়া-আসা করতে করতে আমাদের অবস্থা কাহিল। জান পেরেশান। গত পরশু সবকিছু ফাইনাল করে প্রেসে প্রিন্ট অর্ডার দিয়ে আমরা যে যার বাসায় ফিরেছি। মাঝের একটা দিন একটু বিশ্রাম নিয়েছি। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ ছুটির সময়টাকে বেশ কাজে লাগিয়েছি।
বড়দা আমার সামনে দাঁড়িয়ে রাগে গজরাচ্ছেন, ‘লেখালেখি শুরু করছ শুক্কুরে শুক্কুরে আট দিন হইছে, আর এর মইদ্যে আঁতেল হয়া গেছ তুমি! সম্পাদকের দায়িত্ব পায়া তুমি সাগরময় ঘোষ হয়া গেছ? থাপড়ায়া তোমার দাঁতের মাড়ি খুইলা ফালামু।’
বলে কী? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত তো খুলবে খুলবে, তার সঙ্গে দাঁতের মাড়িও!
আমি ভড়কে যাই।
বড়দা আমি ঠিক বুঝতেছি না তোমার কী হইছে? তুমি খালি খালি আমারে…
আমার কথা শেষ হলো না। তার আগেই বড়দা খ্যাক-খ্যাক করে উঠলেন। ‘আমার গল্পের নিচে তোরা কার নাম ছেপেছিস’ বলে বড়দা হাতে ধরা ছিন্নপত্রটা আমার সামনে মেলে ধরলেন।
আমি ভালো করে চোখ মেলে দেখলাম, ‘যখন আমি ঘুমায়ে ছিলাম’ গল্পের নিচে খান মোহাম্মদ দেলোয়ারের নাম নেই। তার বদলে জ্বলজ্বল করে শোভা পাচ্ছে হরিদাশ পাল।
হরিদাশ পাল আমাদের পাশের মহল্লায় থাকেন। কবি-কবি ভাব নিয়ে গ্রীষ্মকালেও শাল পরে ঘুরে বেড়ান। কথা বলেন মেয়েদের মতো করে। হাঁটেন নেচে নেচে। ছিন্নপত্রের জন্য শাহনেওয়াজ আর আমি তার কাছ থেকে লেখা নিয়ে এসেছিলাম। হরিদাশ পাল কবিতা না দিয়ে ‘আমাদের অর্থনীতিতে কোয়েল পাখির ভূমিকা’ শীর্ষক একটা প্রবন্ধ দিয়েছে। লেখাটা দেওয়ার সময় হরিদাশ পাল আমাদের বলেছিল, ‘দেখো তোমাদের ছিন্নপত্রে এই লেখাটা ক্লিক করবে। ক্লিক করবে মানে হিট হবে।’
আমার সব মনে পড়ে গেল। বড়দার সামনে কিছু বলা যাচ্ছে না। এ নিশ্চয় কম্পিউটারের কোন ঘাপলা? আর না হলে প্রুফ সেকশনের কোনো ভুল? আর না হলে… আমি আর কিছু মনে করতে পারছি না।
বড়দা আমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছেন।
এত বছর ধরে লেখালেখি করলাম আর আজ আমি কী না হয়ে গেলাম হরিদাশ পাল! কোথা থেকে তোরা আমার নাম বদল করিয়েছিস বল? বলে বড়দা আমাকে আরো একটা দশাসই থাপ্পড় মারার জন্য বাতাসকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে ডান হাত তুললেন।
বিপদে পড়লে কোত্থেকে যে আমার মাথায় এত বুদ্ধি আসে কে জানে!
বড়দা ডান হাত তোলার আগে কে যেন আমার কানে ফিসফিস করে বলল, মন্টু বেটা, ভাগ যা... আর ঠিক তক্ষুণি আমি আমার গাল বাঁচিয়ে বড়দার সামনে থেকে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেলাম।