সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

দুই.
তবে লক্ষ্মীপূজার দিনে আছিলো অন্য ব্যবস্থা। তখন সন্ধ্যাকালে জনে জনে আসো রে, পূজার পসসাদ-ভরা কলার ছোটো খোলখানা হাতে নিয়া বিদায় হও রে! লক্ষ্মীপূজার সময় এই-ই বিধান। পাত পেতে খাওয়া- সেইটা কেবল বচ্ছরে একবারই। আবার লক্ষ্মীপূজার সন্ধ্যায় অন্যসব যেমুন তেমুন, জমিদার-বৌরে আর কেউ চক্ষে দেখতো না। তারেও মা-বইনেরা দেখতে পাইতো – খালি ওই বছরে একবার।
লক্ষ্মীপূজার দিনটা হইলো জমিদার-বউয়ের ঠাকুরঘরে থাকোনের দিন। সেয় তখন পুরা দিন থাকে উপাসে। থাকে শুদ্ধ-কাপড়ে; কড়া ব্রতসাধন, পূজা-নিয়ম পালনের মধ্যে। কোন আন্ধার ভোর-রাত থেকে গহিন মধ্যরাত পর্যন্ত এইভাবেই এই পূজাখানা তার পালন করার বিধি। দেওভোগ গেরামের বৌ-ঝিরা জনে জনে পসসাদ হাতে নেয় ঠিক, কিন্তু সকলের অন্তরই একটু ছলবলায়—জমিদার-বউরে একনজর দেখা হইলো না!
তয়, তাগো দেখা হয় ঠাকুরনী দিদির লগে। সেয় হইলো পুরুত ঠাকুরের বউ। জমিদারবাড়ির যে ছোটো মন্দিরখানা – তার যে পুরুত আছে, সেই পুরুতের বউ। জামাই বউ দুইজনেই দুনিয়ার সিদা আর ঠান্ডা। পুরুতঠাকুরের বউরে তো লোকে কথাবার্তা কইতে দেখে, কিন্তু পুরুতঠাকুরের মোখে রাও উঠতে কেউই দেখে না। তার বউই হইলো দেওভোগ গেরামের প্রতিটা জনের ঠাকুরনী দিদি। সকল বৌ-ঝি-মায়ে তারে চিনে! চিনবো না কেন! প্রায় প্রায়ই তো সেয় এর বাড়ি তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। নিত্যি খোদার তিরিশ দিনই আনা-যানা করে না; তবে, যখন আসে তখন থাকে বহুত ক্ষণ। ঘর-গিরস্থালি, সুখ-দুঃখ, রোগবালাই, টোটকা-কবজ– দুনিয়ার জিনিস নিয়া কথা তার ফুরায়ই না! হিন্দু-মোসলমান ভেদখান নাই তার। সব বাড়িতে যায়, গিয়া উঠানে পিঁড়ি-পাতা দিয়া বসে। সকলরে সেয় আপনা মানে; সকলে তারে মান্যি করে, ইজ্জত দেয়।
আসে সে খালি হাতে, যাওয়ার সময় কোঁচড় আর হাতবোঝাই থাকে আনাজপাতিতে। অন্যদিন দিদি এমনেতেমনে কোনো একখান কাপড়ের বেড় দিয়ে রাখে খালি, আর এইদিনে তার পিন্ধনে থাকে তাঁতের একটা সাদা কাপড়! ডগডগা লাল তার পাড়। চিনাজানা দিদিরে কেমুন যে অচিন লাগে সেই সন্ধ্যাটার কালে! সেই লাল-পাড়ের সাদা খলবলা কাপড়খানা পিন্ধা জনে জনে পসসাদ বিলিবণ্টন করে সেয় অইদিন একা হাতে। কিন্তু দেখো গা- কী তার ব্যভার! পসসাদ বিলিবণ্টনের কর্মে খাবিজাবি খেতে খেতেও সে নরম মুখে হাসিখানা দিয়া রাখে। পসসাদ দেওনের সময় তার কিনা কথা কওয়া নিষেধ। কথা সেয় কয় না, তয় চোখ দিয়া মায়া ঝরতে থাকে তার।
তখনো কিন্তুক, জমিদার মায়ে সেই সর্বসময়ের মতনই তার জলপিঁড়ায় বসা থাকে। উঠান জোড়া আলপনা, তার এককিনারে জমিদার-মায়ের জলপিঁড়াখান পাতা। আলপনার গোলচক্করের ভিতরে থরেথরে পসসাদ-ভরা কলার খোল সাজানো। ঠাকুরনী দিদিয়ে একেকটা তোলে, আর আলগোচ্ছে একেকজনের হাতে দেয়। ওদিগে, জমিদার-মায়ে রায়ত মা-বইনগো ভালা-বুরা জিজ্ঞাস করে করে তাগো বিদায় দেয়।
তখন,এই দুই পার্বণ ছাড়া জমিদারবাড়িতে একটা পাও দেওয়ারও উপায় আছিলো না এইসব রায়তবাড়ির মা-বইন-বৌ পোলাপানের! রায়ত পুরুষপোলারা দরকারে যায় কাছাড়ি-বাড়িতে। সেইটা দরকারের যাওন! নানান কর্মে নানান সময়ে গেছে তারা। কিন্তু মাতারিরা বছরে খালি ওই দুইবার! এর বাইরে কোনোদিন না। নিষেধ আছিলো যে!
কিন্তু কালে কালে দেখো কিয়ের থেইক্কা কি হয়! জমিদারে গত হয়, তার মায়েও মরে; আর এদিগে জমিদার-বউয়ে এতো বড়ো পুরীতে একা একজনা! ঠাকুরনী দিদিয়ে নিজের সংসারই দেখে, না জমিদার-বউয়েরেই সর্বক্ষণ আগলানি দেয়! শোনা যায়, তিনকুলে আর এখন জমিদার বংশের কেউ বাইচ্চা নাই। কেউ নাই। একজনও রক্তের কেউ নাই, যে আইসা জমিদার-বউয়ের তত্ত্ব-তালাশিটা করে! জমিদারে থাকতে জমিদার-সংসারে দাসিবান্দির কমতি আছিলো না ঠিক, কিন্তু শেষে জমিদার-বউয়ের হাতের কাছে থাকে খালি ওই এক ঠাকুরনী দিদি।
তার সোয়ামী– পুরুত মশাই - য্যান মাটি কামড়াইয়া পইড়া থাকে জমিদারবাড়িতে। কোনোমতে টেমটেমাইয়া ঠাকুর-দালানে ত্রিসন্ধ্যা বাত্তি দেয়, পূজাপার্বণগুলা সামলায়, বিধি কর্ম করে কোনোমতে। কেমনে তার সংসার চলে, কেমনে জমিদার-বউয়ের দিন গোজরান হয়—গেরামের কেউ কইতে পারে না! পাড়ার ময়মুরুব্বিরা ডাকখোঁজ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু জমিদার-বউয়ে নেয় নাই কিছু। ক্যান নেয় নাই! সেয় সগলরে কইয়া দিছে যে, কপালের দুক্ষু তারে ভোগ করতে হইবোই। এই-ই যুদি বিধির বিধান না হইবো, তাইলে তার কপাল পুড়ত নি! এই লিখন সেয় খণ্ডাইবো কেমনে! তার ভোগ তারে ভুগতে তো হইবো!
বস্তু-জিনিস কিছুই যারে নেওয়ানো যায় নাই, সেয় দেখো কোন বিষম ঠেকায় পড়ে! ঠেকা বলে ঠেকা! কঠিন ঠেকা। এমন ঠেকা-ঝামেলার কথা - এই গেরামের বেটা-মাতারিগো কেউই শোনে নাই কোনোদিন! পরথম যেদিন সেইকথা সকলে শোনে, একেবারে বাক্যিহারা হয়ে যায় তারা। তাদের জীবনে কোনোদিন এমন ঠেকা তো আসে নাই কখনো! কিংবা এমন ঠেকাও কারো জীবনে আসতে পারে, তাও তো তাদের জানা ছিলো না! তাইলে বাক্যিহারা না হয়ে তারা পারে! তবে বেতালা রকম তাজ্জব তারা হলেও কিন্তু কর্তব্য কর্মখান করার হুঁশটা হারায় না। সেই দিনের বিপদের সঙ্গী হইতে কেউ কারপিন্নি করে নাই। ঠেকার দিনে লগে থাকতে বেজার হয় নাই। কি সেই ঠেকা? না- জমিদার-বউয়ের বোলে একলা থাকলে বেদিশা লাগে! তুফান বেদিশা!
একদিন হইছে কি- তখন ঠা ঠা দোপোর। সেই দুপুরের সময় আঁতকা ঠাকুরনী দিদিয়ে আইসা হাজির। এমন হঠাৎ সেয় আসলো ক্যান! অহন তো আর এমুন বেড়ান্তি দিতে আসার অবস্থা না তাগো! বিষয় কি! ঠাকুরনী দিদি কয়, ‘পাড়ার মা-বইনেরাগো, আইলাম তোমাগো কাছে। এমুন নিদানের কালে আর কই যামু!’
কী! কী হইছে গো দিদি?
‘না, কই কি- তোমাগো যহন যার হাত খালি থাকে, সেয় আইসা জমিদার-বৌদিদির লগে এট্টু কথাবার্তা কইয়া যাইতা যুদি!’
কী কন! কী কন এইটা ঠাকুরনী দিদি! এত বড়-মাইনষের বউয়ের লগে কতা কইতে যাইবো এই গ্রামের বৌঝি! খোদা খোদা! তার লগে কথা কওয়ার যুগ্যি তারা! ঠাকুরনী দিদিয়ে দেখো তামশা করে!
‘না গো মা-সগল! তামশা না! কপালের ফের! ব্রতনিয়ম, পূজা-উপাস করেও জমিদারবৌ-দিদির দিন যায় না, রাত শেষ হয় না। তয়, পূজা-ব্রত-জপ—এই সবও তো, দিনে একটা সময় শেষ হয়। তখনই বিপদ। তখন এট্টু একলা থাকলেই তার ফাঁপর ফাঁপর লাগে! শ্বাস বন্ধ হইয়া আসতে থাকে! বেদিশা হইয়া যায় পরান। মাথা তালাগারা দেয় তার। রাইতে চক্ষে নিদ্রা নাই, দিনে অন্তরে শান্তি নাই। রাইতে না হয় ঠাকুরনী দিদিয়ে তারে সেবাযত্ন করলো, তাতে অসুবিধা নাই। হাতে তো আর তখন কামকাইজ থাকে না। কিন্তু দিনে কী উপায়! দিনে ঠাকুরনী দিদিয়ে তারে আগলানি দেয়, না রান্ধেবাড়ে, না নিজের নিত্যিকর্ম, পূজা-আন্নিকটা করে! তিন তিনটা মোখে তো আহার দেওনও আছে! আয় হায় রে বিধি! আর কতো দুষ্কু রাখছো পোড়া কপালে!’
মা-বইনেরা সেই মিন্নতি শোনার পর যে যেমনে পারে, জমিদার-বউয়ের তত্ত্বতালাশিটা করতে যায়। না-না! সেইটা হইতাছে জমিদারবাড়ি! জমিদারে নাই – তাতে কি! দুনিয়ার তেনে মান্যগন্যি কি নাই হয়ে গেছে! যায় নাই। রায়ত হয়ে তুমি ভিতরের উঠানে যাও-ঠিক আছে। উঠানে বসো, তাও ঠিক আছে। তার বেশি করতে যাইও না। গজবের তলে পড়বা!
মা-বৌয়েরা সেইটা ভোলে নাই। ঠেকা সারাইতে গিয়া তারা কোনোরকম বেয়াদ্দবি কিছু করে নাই। কেউ কেউ কোনো কোনোদিন গিয়ে দেখেছে যে, জমিদার-বউয়ে কোঠাবাড়ির বারিন্দার জলচৌকিতে বসা। হাতে জপমালা। বারান্দা থেকে কয়ধাপ নামলে পরে মস্ত বাঁধানো উঠান। জমিদার-বউ বারিন্দায় বসা! তাইলে তো বারিন্দার সামনের উঠানে লেট দিয়া বসলেই চলে! সেয় সেইখানে বইসাই কথাবার্তা কইছে, শুনছে। ভাবে-সাবে সেয় একফোঁটা বুজতে দেয় নাই যে, সে জমিদার-বউয়ের ঠেকা সারতে আসছে! বুঝাইছে যে সেয়-ই আসছে নিজের ঠেকায়!
কেউ কেউ দেখেছে যে, জমিদার-বউয়ে শোওয়া। শোওয়া আছে কিন্তু চক্ষে নিদ্রা নাই। সেয় কি ফিরা যাবে? না-না। সে তখন হুকুমমাফিক উঠছে বারান্দায়। কী শীতল সেই বারিন্দার মেঝেখানা! কী থমথমা ঠাণ্ডা লাল- সেই মেঝের বরনখানা! পাও দিতেই ডর লাগে রায়ত মা-বইনের! পরানের কাঁপাকাঁপি পরানে লইয়া সেইজন গিয়া বসছে দরজা বরাবর বারিন্দার মেঝেতে। কথা সে কইছে ঠিকই, জমিদার-বউয়ের কথাও সেয় শোনছে ঠিকই, কিন্তু খোনে খোনে তারে ঝাটকা দিছে ডরে! বড়ো আন্ধাগোন্ধা লাগছে তার! মারে মা! জমিদারবাড়ির ভিতর দেখতাছে যে সেয়! অই যে শয়নের ঘরখান! কী বাহারের পালঙ্কখান! সেইদিগে ক্ষণে ক্ষণে চোখ যায়, আর শরীর তার খামাখা খামাখাই কাঁটামাটা দিয়া শেষ!
তার ওপর আরো একটা আশ্চিয্যি বিষয় আছিলো! জমিদারে মারা গেছে ঠিক, জমিদার বউয়ে বিধবাও হইছে ঠিক; কিন্তু দেওভোগ গেরামের মা-বইনেরা দেখে যে, বিধবা বউয়ে একটা দিনের জন্যও সাদা কাপোড় পিনলো না!
(চলবে)