গল্প
কালোদাগ

কখনো কখনো খুব অসহ্য লাগছে। তবুও কিছু বলতে পারি না। বলিও না।
কয়েক দিন ধরে মায়ের মুখ থেকে এমন সব চরম অশ্লীল ও কদর্য কথা হর-হামেশাই বের হচ্ছে, যা শুনতে আমাদের কানে লাগলেও কখনো কানে নিই না। আমি বুঝতে পারছি, ক্ষোভে রাগে কিংবা দুঃখে ফুসফুসিয়ে মায়ের এই অশ্লীল-কদর্য কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ করেই বলছে।
আমি কোনো প্রতিবাদ করি না। আমি জানি, প্রতিবাদ করতে গেলে মায়ের মাথায় আরো রাগ উঠে যাবে, সে তখন আমাদের আরো যা যা মনে আসবে, সেগুলো মুখ দিয়ে গলগল করে বের করে গালি দিতে থাকবে। তার চেয়ে আমি বরং চুপ করে থাকি, সেটাই সবচেয়ে ভালো কাজ।
আমার মা। গত এক বছর ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে মায়ের মেজাজটা এখন আর ঠিক নেই। যখন যা মনে আসে, বলতে থাকে। আমার কাছে মনে হয়, মা তার মনের মধ্যে যেসব কথা জমা আছে, তা গলগল করে বের করলে একটু ভালো লাগে। আমিও তাই মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে যাই, ‘তুমি ভাত খাইছো, মা?’
‘না। খাইতে পারি না।’
‘হ, মা। তোমার কী খাইতে মন চায়, বলো। আমি তাই আইন্না তোমারে খাওয়ামু।’
‘তোরাই খা। তোগো মুহে যা ভাল্লা গে তোরা তাই রাইন্দা খা, আমার খাওয়ার কাম কী?’
মরণ অসুখ মায়ের শরীরে বাসা বুনছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কম তো চেষ্টা করলাম না। মাদারীপুর থেকে চেন্নাই। চেন্নাই থেকে ঢাকা। ফের ঢাকা থেকে মাদারীপুর। মাদারীপুর থেকে চাঁদপুর। কোথায় যাইনি। যেখানেই শুনেছি, চিকিৎসায় মরণের মুখ থেকে ফিরে আসে মানুষ, সেখানেই আমি ছুটে গেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বিছানাই এখন আমার মায়ের চিরসঙ্গী। সারা দিন শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে তার পুরো শরীরটা খিটখিটে হয়ে গেছে। মেজাজ রুক্ষ থেকে আরো বেশি রুক্ষ হয়ে উঠেছে।
দুই মাস হয়ে এলো, মায়ের গলা বেয়ে বেয়ে কোনো খাবারই খাদ্যথলিতে পৌঁছে যেতে পারে না। শুকিয়ে যেতে যেতে সে এখন হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে। তবুও তার সাধ, আরো যদি কিছুদিন বেঁচে থাকি। দুই মুঠো ভাতের চেয়ে বেশি কিছু কত দিন ধরে যে মা খেতে পারে না। আমি তো সেই দিনের হিসাব ভুলেই যাচ্ছি। কয়দিন ধরে মা শুধুই বলে, ‘ইলিশ মাছের ঘ্রাণ তার নাকে আসে।’
এই শীতে আমাদের আশপাশে কারো বাসায় তো ইলিশ নেই। আজ রাত্রে যখন আমি বাড়ি ফিরে আসি মা আমাকে ডেকে বলে, ‘বাবা, আমি খালি ইলিশ মাছের ঘ্রাণ শুঁকতে পাই। তুই বাজারতোন এট্টা বড় দেইক্কা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ আমার জন্য কিন্না আনিস, খামু। কয় দিন ধইরা খালি নাকের মধ্যে ইলিশ মাছের ঘ্রাণ পাই।’
‘মা, তুমি ইলিশ মাছের ঘ্রাণ কোথায় পাচ্ছ? এই শীতের মধ্যে তো ইলিশ মাছ বাজারেই পাওয়া যায় না।’ আমার কথা শুনে মা আর কোনো কথা বলে না। তবুও আমি গলগল করে বলে যাচ্ছি ঠিক আছে মা, এই মাসের টিউশুনির টাকাটা হাতে পেলেই তোমার জন্য বড় দেখে একটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ কিনব। তুমি খাবে।’
‘হ। যা এট্টা মাছ কিন্না নিয়া আয়। তুই কবে টিউশুনির টাকা পাবি?’
‘জানি না, মা। তবে পাবো।’
আমার মাথায় ইলিশ কেনার ভাবনা ঢুকে গেছে। মাসের শেষে দিকে পকেট একদমই খালি। টিউশুনির টাকা পেতে কখনো কখনো মাসের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। পরের দিন সকালেই ঘুম থেকে উঠি। কিন্তু মাথা থেকে সরেই না, ইলিশ মাছের ঘ্রাণ। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসা থেকে এক ক্রোশ মাইল দূরের বাজারে যাই। কিন্তু শীতের সময়ে ইলিশ মাছ পাওয়া গেলেও আমাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। তবুও আমি ইলিশের খোঁজে মাছ বাজারে যাই। এক-দুই দোকানে ইলিশ পাওয়া গেলেও কেজিদরে তা এক হাজার টাকার কম হবে না। আমার পকেটে এক/দুইশ টাকা। আমি মাছের দোকানির সঙ্গে দরদাম করতে কোনোভাবেই সাহস পাচ্ছি না।
ইলিশের দোকানির কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, কেউ যদি ইলিশের দরদাম করে তবেই আমি নিশ্চিত হতে পারব, এখন বাজারে ইলিশের কত টাকা দাম উঠেছে। আমাদের শহরের কিছু মানুষ দামের দিকে খেয়াল করে না। তাদের খেতে ইচ্ছে হলে, খাবে। তা যত দামিই হোক। শহরজুড়ে এখন বিদেশি রেমিট্যান্সের ছড়াছড়ি। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। কেউ গিয়েছে ইউরোপ আবার কেউ গিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। তাই বাজার ভর্তি মাছ থাকলেও আমাদের মানে, যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের পকেটভর্তি টাকা না থাকায় কেনা যায় না। আমার তো পকেট পুরোটাই ফাঁকা। তাই আমি দোকানির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রমহিলার ইলিশ কেনার দরদাম করার কথা শুনছি।
ভদ্রমহিলা : ‘ভাই, কত টাকা করে ইলিশ মাছের কেজি?’
মাছ বিক্রেতা : ‘আফা, লইয়া যান। আপনে রে কেনা দামের থেকে ৫০ টাকা লাভে মাছ ছাইড়া দিমু।’
ভদ্রমহিলা : ‘তা বুঝলাম। কিন্তু আপনার মাছের দামের কেজি কত টাকা করে, সেটা বলেন?’
মাছ বিক্রেতা : ‘আফা, আপনে আমারে কেজি এক হাজার দুইশ পঞ্চাশ টাকা দিয়েন।’
ভদ্রমহিলা : ‘ইশ। এত টাকা দাম হইলে, ইলিশ মাছ খামু ক্যামনে?’
মাছ বিক্রেতা : ‘কী যে কন, আফা। আপনেরা যদি বাজারে আইসা মাছ না কিনেন, তাহলে আমরা বেচমু কী?’
ভদ্রমহিলা : ‘আচ্ছা, আপনার থালা থেকে বড় বড় সাইজের কয়েকটা ইলিশ মাছ ওজন দেন। দেখেন, কেজি দরে কত টাকা আসে।’
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, মাছ বিক্রেতা তার সামনে সাজানো মাছের ভেতর থেকে কয়েকটা মাছ নাড়িয়ে-চাড়িয়ে বড় বড় তিনটি মাছ ওজন করতে লাগল। শীতের সময়ে অনেক বেশি বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। থালায় সাজানো মাছগুলোকে মাঝারি সাইজের মাছই বলা যায়। দেখতে দেখতে মাছগুলো সে ওজন করে ফেলে ভদ্রমহিলা দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, ‘বুঝলেন আফা, এই মাছ আমি সব চাঁদপুরের বড় নদীর মোহনা থেকে কিনে এনেছি।’
ভদ্রমহিলা : ‘আপনি চাঁদপুরে গিয়ে কিনে আনেন কখন, আর বেচেন কখন?’
মাছ বিক্রেতা : ‘না, আফা। আমার লোক আছে। সে প্রতিদিনই মাছ পাঠিয়ে দেয়।’
কথা বলতে বলতে, মাছ বিক্রেতা জানাল, ‘আফা, মাছ তিনডার ওজন দুই কেজি হইছে। দাম পঁচিশশ টাকা।’
ভদ্রমহিলা : ‘না, না। এত টাকা আমি দিতে পারব না।’
মাছ বিক্রেতা : ‘আরে আফা, আমি তো আপনার কাছে বেশি দাম চাইনি। আপনি একেবারেই কেনা দাম দিলেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে দুজনেই একটু একটু করে মুচকি হাসছে। মনে হচ্ছিল যেন, এই মাছ ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই জিতে গেছে। ভদ্রমহিলা মাছগুলো নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে আমিও মাছ বাজার থেকে ফিরে আসতে থাকি। ইলিশ মাছ কেনার টাকা আমার পকেটে নেই। কারো কাছে যে হাত পেতে ধার নেবে, সেই অভ্যাস কখনো হয়নি। তাই কারো কাছে টাকা-পয়সা ধার-দেনা চাইতে আমার বড় লজ্জা লাগে। আমি বাসায় ফিরে আসলে মা বলেন, ‘মাছ আনছোস বাবা।’
‘না, মা। এখন তো শীতের কাল। ইলিশ মাছ তো বাজারে পাওয়া যায় না।’
‘কেডা কইছে, পাওয়া যায় না? কত ব্যাডারাই তো মাছ কিন্না আনতেছে। আমি তো ইলিশ মাছের ঘ্রাণ পাই। তুই খালি পাস না।’
আমি কোনো কথা বলি না। চুপচাপ থাকি। এ সময়ে আমি কথা না বললেই ভালো। কথা বললেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। মনে মনে ভাবতে থাকি, দেখি আজকেই বিকেলে টিউশুনির বাসায় পড়াতে গেলে, দেখি অগ্রিম বেতনটা চাইব। কিন্তু কীভাবে অগ্রিম টিউশুনির বেতন চাইব, তাই ভাবতেছি। আমার মা ইলিশ খেতে চায়, এই কথা নিশ্চয় বলাটা আমার খুব লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। না থাক। ছাত্রীর মাকে মুখ ফুটে বলব যে, ‘আমার কিছু টাকা খুব জরুরি একটি কাজে দরকার। যদি বেতনটা অগ্রিম দেন, তাহলে আমার খুব উপকার হয়।’ আমি জানি আমাদের এই অভাবের দিনে কেউ দুই টাকা ধার দেবে না। বিপদের সময়ে আশপাশে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমিও কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই নিজের সাধ্যের মধ্যেই যা করা যায়, সেই চেষ্টা করাই শ্রেয়।
আমি ভেবেছিলাম, আমার ছাত্রীর মাকে হয়তো কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারব না। কারণ, আমি আমার নিজের সমস্যার কথা কোনোদিনই কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু আজ আমি ঠিকই বলতে পারলাম। তবে বলে যে তাৎক্ষণিক খুব একটা লাভ হলো, ঘটনাটি তেমন ঘটল না। তবে হ্যাঁ, একটা কিছু হবে। বাংলা অভিযানে প্রতিশ্রুতি নামের যে শব্দটি পড়ে আছে, সেটিই এখন অভিধান থেকে আমার কাছে উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ছাত্রী মা আমাকে বলল, ‘আজ রাতে ছাত্রীর বাবাকে বলব, টাকা রেখে গেলে কাল দিয়ে দেব।’ তবুও আমি কিছুটা খুশি হয়েছি, এই ভেবে যে, একদিন দেরি হলেও আমি মায়ের আফসোসটা মিটিয়ে ফেলতে পারব। আমি পরের দিনের প্রতীক্ষায় আছি।
অবসরে আমার পাখি দেখার খুব শখ। পাখিদের জীবনযাপন দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। আমি যখন একাকী থাকি, তখন চড়াই পাখির জীবনযাপন দেখি। আমার ঘরের জানালার ওপাশে দীর্ঘদিনের পুরোনো স্যাঁতসেঁতে যে মঠটি এখনো আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ফোকরেই দুটি চড়ুই পাখি বাসা পেতেছে।
যখনই জানালার কাছে আসি, তখনই চড়ুইয়ের বাসায় আমার চোখ চলে যায়। আমি চেয়ে চেয়ে চড়ুইদের ভালো বাসাবাসি দেখি। কখনো কখনো দেখি খুনসুটি। মাঝে মাঝে ভাবি, ইশ, আমি যদি চড়ুইয়ের ভাষা বুঝতে পারতাম, তবে ওদের কথাগুলো শুনে শুনে পাখিদের মতো সুখে ভেসে যেতাম। গত কয়েক বছর ধরে দেখছি, এখানে এই চড়ুই দম্পতি বাসা পেতেছে। ধীরে ধীরে তাদের বাসাভর্তি সন্তান-সন্ততি আসল। তারাও ধীরে ধীরে বড় হয়ে একদিন উড়ে গেল। পড়ে রইল শুধুই চড়ুই দম্পতি। সব সময় দেখতাম, বাসার সামনেই চড়ুই দম্পতির ওড়াউড়ি, নাচানাচি আর ডাকাডাকি। আমার কাছে কী যে ভালো লাগত। বেশ কিছুদিন ধরে স্ত্রী চড়ুই পাখিটিকে, আগের মতো করে কখনো আর ফুড়–ত ফাড়–ত করে বের হতে দেখি না।
এদিকে মা দিন দিন আরো ভীষণ রকমভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কখনো কখনো আমাদের কাউকেই সে চিনতে পারছে না। সারা দিন কাজে-কর্মে থাকলেও বাসায় আমার মন পড়ে থাকে। আমার মা, যে মানুষটি আমাদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবনের সব সুখ উৎসর্গ করেছে। যে মানুষটি একসময় নিজে না খেয়ে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। অভাব-অনটনের মাঝে যখন সে খেতে পারত, তখন সে নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে। আজ সে কিছুই খেতে পারে না। আমাদের কষ্ট হবে ভেবে তখনো সে খেত না। আমি রাতে বাসায় এলে আগে মায়ের মুখ দেখি। কথা বলি। সারা দিন বাসায় না থাকায়, মায়ের বুকে অনেক কথা জমা হয়ে থাকে। আমাকে দেখলেই সে গলগল করে বলতে শুরু করে
‘আমি কি তোদের কাছে বেশি হয়ে গেছি, বাবা?’
‘তোমাকে এ কথা কে বলছে, মা?’
‘তাইলে সারা দিন আমার কোনো খোঁজ নেস না ক্যান?’
‘কী কও মা। আজকে তো অনেকবার তোমাকে ফোন দিলাম, কথা বললাম। তোমার মনে পড়ে না।’
‘না। একবারও ফোন দিস নাই।’
‘তাই মা।’
‘হ।’
‘আচ্ছা, কালকে তোমাকে কয়বার ফোন দেবো, বলো?’
‘দশবার ফোন দিবি।’
‘আচ্ছা। আমি গুনে গুনে তোমাকে দশবার ফোন দেবো। আচ্ছা, মা তুমি কি কিছু খেয়েছ?’
‘না, বাবা আমি তো কিছু খাইতে পারি না। গলা দিয়া ভাত ঢোকে না।’
‘তাহলে ভাত কচলিয়ে কচলিয়ে নরম করে খেতে পারলে একটু ভালো লাগত, মা। আমি তোমাকে খাবার বানিয়ে দিই।’
‘না। আমি খাইতে পারি না। এট্টা ইলিশ মাছ আনতে বললাম আনলি না, আনলে এট্টু খাইতে পারতাম। আমার নাকে খালি ইলিশ মাছের ঘ্রাণ পাই।’
‘কাল বাজারে গিয়ে কিনে আনব, মা। তুমি এখন আজ যা রান্না করেছে তাই দিয়ে খাও।’
‘না। আমি খাইতে পারি না, বাবা।’
পরের দিন বিকেলে আমি হাতে টাকা পেয়ে বাজারে যাই। ছয়শ টাকা দিয়ে পাঁচশ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ মাছ কিনে আনি। এই শীতের বাজারে ইলিশের সে কী দাম! আমার মন আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে। যাই হোক, মা তো একটু ইলিশ মাছ খেতে পারবে। কত দিন ধরে বলছে, বাতাসে ইলিশ মাছের ঘ্রাণ তার নাকে এসে দোল খেতে থাকে।
শীতের রাত। সারা শহর কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়ায়, ভরা জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছে না। তবে আমাদের বাসার চারপাশে জ্যোৎস্নার বিচ্ছুরণের কিছুটা আভা এসে পড়েছে। বড় আপু ছ্যাত ছ্যাত শব্দে ইলিশ মাছ তেলে ভাজছে, তার সুবাস এসে আমার নাকে লাগছে। ইলিশের ঘ্রাণ নাকে আসায় আমার ভেতরে কেমন যেন একটু খুশির ঝিলিক দোল খেতে লাগলো। আমি একটু আগ্রহ নিয়ে ইলিশের ঘ্রাণের গল্প বলতে মায়ের কাছে যাই।
আমি মায়ের ঘরে গিয়ে দেখি, মা তার পুরো শরীরটা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। আমি মাকে খুব খুশি জড়ানো কোমল গলায় ডাকছি, ‘মা, মা। ও মা। ওঠো। ভাজা মাছ খাবে না।’ কিন্তু মা কিছুতেই আমার ডাকের কোনো সাড়া দিচ্ছে না।
সে আর কোনোদিন আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। পুরো এক জীবনে আমি আর কোনোদিন বাজার থেকে বড় ইলিশ মাছ কিনতে পারিনি। যখনই কিনতে গেছি, বুকের ভেতর কেমন করে যেন একটি কালোদাগের আফসোস মোচড় দিয়ে উঠেছে।
প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশা। বাইরে বেরোতে পারছি না। ইচ্ছে করছে, তবুও কেন জানি যেতে পারছি না। মনে হচ্ছে কুয়াশার চাদর ভেঙে বাইরে কিছু জ্যোৎস্না এসে পড়ছে।
খুব ভোরে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখতে থাকি অনেক দিন পরে, চড়ুই পাখির বাসার মুখে আরো কতগুলো চড়ুই পাখির আনাগোনা শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, কয়েকটি চড়ুই মৃত স্ত্রী চড়ুই পাখিটিকে বাসা থেকে টেনে টেনে বের করে আনছে। আমি ভোরের আলোতে মায়ের নিস্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার নাকেও ভাজা ইলিশ মাছের সুবাস এসে লাগছে। অথচ আমাদের চারপাশে সে কী প্রবল শোকের ছায়া নেমে এসেছে!