বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ইতিহাসের মহানায়কেরাই কেবল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে পারেন। উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে পারেন জীবনের পরতে পরতে। আর এমন মহানায়ক পাওয়া তো যে কোনো জাতির জন্যই পরম ভাগ্যের। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরাও অনেক সৌভাগ্যবান। আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন প্রজ্ঞাবান সূর্যসন্তানকে। যাঁর জন্মই হয়েছিল জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে। তাঁর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়েছিল একদিকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে, অন্যদিকে আবার জাতি পুনর্গঠনের কাজেও। সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে তিনি সময় পেয়েছিলেন খুবই সামান্য। কিন্তু এই সামান্য সময়কেও তিনি অসামান্য করে তুলেছিলেন তাঁর সম্মোহনী জাদুতে। দূরদর্শী এই নেতা বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের মুক্তির পথ কোন দিকে। তাই আলো ফেলেছিলেন অসংখ্য উদ্দীপনা ও গঠনমূলক কজে।
তাঁর দূরদর্শী কর্মকাণ্ড থেকে বাদ যায়নি বৃক্ষরোপণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও। আমরা এখন যা কেবল ভাবতে শুরু করেছি, তিনি ভেবেছিলেন আরো চল্লিশ বছর আগে। এ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা বজায় রাখতে তিনি বৃক্ষরোপণের ওপরই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তাঁর এই উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশও ঘটেছিল নানাভাবে। সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি সবাইকে বৃক্ষপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গণভবন, বঙ্গভবন ও বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ লাগিয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি গাছ আছে জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়।
প্রতিবছর জুন মাসে এখন বেশ উৎসবের আমেজে সারা দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়। বন বিভাগের নার্সারিগুলো কম-মূল্যে চারা বিতরণ করে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অসংখ্য বৃক্ষমেলার আয়োজন থাকে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিদিন অন্যান্য সওদাপাতির সঙ্গে দু-চারটি গাছের চারাও কিনে নিয়ে যান। দেশব্যাপী এই যে বৃক্ষ আন্দোলন, বৃক্ষ সচেতনতা, তার প্রবক্তাও বঙ্গবন্ধু। মূলত তিনিই দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণকে আনুষ্ঠানিকতা দান করেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে শুধু জীবন ও সম্পদই নষ্ট হয়নি, দেশের বৃক্ষ ও বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা থেকে উত্তরণের জন্য, দেশকে বৃক্ষসম্পদে আরো সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশে বৃক্ষরোপণ অভিযান কার্যক্রম চালু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৃক্ষরোপণ অভিযান উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বাণী প্রদান করেন :
“বনাঞ্চলগুলিতে সরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন ও অধিক উৎপাদনশীল করার জন্য সরকার উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকারি বনাঞ্চল-বহির্ভূত এলাকার ও জনসাধারণের সহযোগিতায় অধিক গাছ লাগিয়ে বৃক্ষসম্পদ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে। এই উদ্দেশে ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালিত হয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য এই বৃক্ষরোপণ অভিযানের সময় এবং পরে অধিক বৃক্ষরোপণ করে সরকারের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা। কেননা, জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া মুষ্টিমেয় সরকারি কর্মচারীর পক্ষে এ বিরাট দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই আমি দেশের জনপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সমাজসেবী ও আপামর জনসাধারণের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন নিজেদের এলাকায়- স্কুল, কলেজ, কলকারখানা, রাস্তাঘাট এবং বাড়িঘরের আশপাশে যেখানেই সম্ভব মূল্যবান গাছ লাগিয়ে এবং তার পরিচর্যা করে সরকারের এ প্রচেষ্টাকে সফল করে।’
তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীই দেশের কোটি কোটি মানুষকে বৃক্ষ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। নতুন আঙ্গিকে বৃক্ষপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তবে শুধু বাণীই নয়, বঙ্গবন্ধু সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে গাছের চারাও রোপণ করেন। ১৯৭২ সালে রমনা মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে জুয়াখেলা বন্ধ করে তিনি নারকেলের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যান তৈরির উদ্বোধন করে উদ্যানটির নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন নগরীর কোটি কোটি মানুষের ফুসফুস সচল রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এই যে উদ্যানের যাত্রা, তা এখন অনেকটাই বিস্মৃত। কিন্তু পৃথিবীর সব কিছুরই একটা কার্যকারণ থাকে। আমাদের চারপাশের এই বিপুল বৃক্ষরাজির নিশ্চয় কোনো অভিভাবক রয়েছে। প্রতিদিন পথ চলতে চলতে আমার সে কথাই মনে হয়, বারবার। বিশেষ করে প্রায় ১৮ বছর আগে, যখন বৃক্ষপ্রেমে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নারকেল গাছগুলো দেখে অনেকদিন ভেবেছি এই গাছগুলো কে লাগিয়েছেন। এই ভাবনা এত জোরালো হওয়ার কারণ, কর্মসূত্রে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই একবার এই উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আমার উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা আমাকে নিয়ে অনেক দিন এই উদ্যানে ঘুরে ঘুরে গাছ দেখেছেন। স্বাধীনতাস্তম্ভের সুদৃশ্য নাগেশ্বরগুলো তাঁর পরিকল্পনারই একটি অংশ।
বঙ্গবন্ধু কি জানেন তাঁর উদ্যানের সেই নারকেল গাছগুলো এখন ফলবতী হয়েছে? তাঁর নারকেলবীথির পাতায় পাতায় খেলা করে গ্রীষ্মের আলুথালু বাতাস, জোছনারাতে রুপালি আলোয় ঝলমল করে হেসে ওঠে ওরা? আবার বিকেলের সোনারোদ পিছলে যেতে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি নারকেল গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে তিনি একটি নারকেল গাছের চারা রোপণ করেন। ৪৪ বছর বয়সী গাছটি এখন বেশ বড় হয়েছে। ফল ধরছে আরো কয়েক বছর আগে থেকেই। গাছটির চারপাশ ঘিরে রাখা হয়েছে কালো পাথরের বেদি দিয়ে। পাশে আছে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষমূর্তিও। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে একটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। তারপর মহিলা কলেজ পরিদর্শনে এসে চারাটি রোপণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি গাছ দেখা যায়। তাঁর সমাধিসৌধের পুরোনো প্রবেশপথ ধরে কিছুটা এগোলে টুঙ্গিপাড়া খাল থেকে একটু পশ্চিমে একটি শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটটি নতুন হলেও সংলগ্ন হিজলগাছটি শতাব্দীপ্রাচীন। গাছটির ডালপালায় পরজীবী অর্কিডের রাজত্ব। এই পথে নৌকা ও বজরা যেত বাঘিয়া নদী হয়ে মধুমতিতে। বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা এই পথে কলকাতার সঙ্গে ব্যবসা করতেন। তাঁর সমাধির অদূরে ৭০ থেকে ৮০ বছরের পুরোনো একটি নারকেল গাছও আছে। বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক ভিটা লাগোয়া পুকুরপাড়ে আছে শতবর্ষী কয়েকটি হিজল। মোটা কাণ্ডের এই গাছগুলো গড়নের দিক থেকে খাটো, ডালপালা ছোট এবং ঘনবদ্ধ। দেখতে অনেকটা বনসাইয়ের মতো। আশপাশে পুরোনো আমলের কয়েকটি আমগাছও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নতুন প্রবেশপথে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কয়েকটি হিজল অবিকৃতভাবেই রাখা হয়েছে। একজন মহানায়কের সমাধিসৌধ এমনই হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু তনয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুরোনো এই গাছগুলো স্বাভাবিকভাবে রেখেই সমাধিসৌধের নতুন পথ নির্মাণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছর গোপালগঞ্জ শহরের মিশন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ওই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এ সময় তিনি বাবা লুৎফর রহমানের সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরের বাড়িতে থাকতেন। বাড়ির সামনে ছিল বিরাট ফাঁকা মাঠ। পশ্চিম পাশে সরকারি পুকুর। সেখানে পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণের একটি আমগাছ এখনো বেঁচে আছে। বঙ্গবন্ধু আমগাছটির তলায় তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গল্পগুজব ও রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। মাঝে মাঝে তিনি সেখানে জনসভার অনুকরণে বক্তৃতা দিতেন। আমগাছটি ছিল তাঁর প্রথম জীবনে বক্তৃতা শেখার মঞ্চ। এ সময় তাঁর বয়স সতেরো, ছিপছিপে গড়নের সুদর্শন তরুণ, চোখে চশমা, তীক্ষ্ণ মেধা ও গভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সব কিছুতেই একটু আলাদা।
গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইদুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধুর বাল্য-কৈশোর ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ নামে ৮০ পৃষ্ঠার একটি তথ্যবহুল গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকালের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্থান পেয়েছে। তিনি সেই ঐতিহাসিক আমগাছে একটি নামফলকও সেঁটে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মুখস্থ করে আমগাছটির নিচে দাঁড়িয়ে তা আবার বলার চেষ্টা করতেন। এতেও তিনি তৃপ্ত হতেন না। লেখক সাইদুর রহমান জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজ চরিত্রের ভক্ত ছিলেন। সিরাজ চরিত্রের রূপকার নির্মলেন্দু লাহিড়ী সে সময়ের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্মলেন্দু লাহিড়ীর সংলাপে খুবই আকৃষ্ট হন। তিনি ওই নাটকটি আগাগোড়া মুখস্থ করে ফেলেন। এভাবে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর বাচনভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে তাঁর মধ্যে। আমগাছের তলায় এই মহড়া চলত দিনের পর দিন। শতবর্ষী সেই আমগাছে জন্মেছে অনেক পরগাছা। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এই আমগাছ গোপালগঞ্জের হাতেগোনা দু-চারটি শতবর্ষী বৃক্ষের মধ্যে অন্যতম।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পথের পাশে, মহাসড়কের ধারে, বাড়ির আনাচে-কানাচে ও পতিত স্থানে ফলদ বৃক্ষরোপণের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই দূরদর্শী ভাবনা বর্তমান সময়ে এসে কতটা যুগোপযোগী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি জানতেন, একটি ফলগাছ একসঙ্গে অনেক মানুষের বিচিত্র চাহিদা পূরণ করতে পারে। তা ছাড়া, ফল শুধু মানুষই খায় না, জীবজগতের একটি বিশাল অংশও ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। দেশের বৃক্ষ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্য উৎস
১. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, প্রথম খণ্ড, সময় প্রকাশন, ঢাকা
২. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু কোষ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ঢাকা
৩. বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ও বৃক্ষ ও নিসর্গ, সময় প্রকাশন, ঢাকা