গল্প
বনে যা ঘটে

খুব মন খারাপ করে ঘুম ভাঙল দুখাইয়ের। তার লেজটা অনেক বড় হয়ে গেছে, আজ আবার কাটতে হবে। এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের ভেতরে একটাই সান্ত্বনা─আগামী কয়েকদিন তাকে আর ইস্কুলে যেতে হবে না। ইস্কুল তার কাছে এক ভয়াবহ জায়গা। ইস্কুলের ছেলেরা তাকে বান্দর বলে, হেড স্যার বলে ম্যাকাকো। আর ক্লাস-টিচার নাম দিয়েছে মর্কট। মর্কট মানে ছোট বানর। মা অবশ্য তাকে দুখাই নামেই ডাকে।
ভয়ঙ্কর দিন আজ। দুখাই তাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বনের ভেতরে একা একা হেঁটে বেড়ায়। একসময় বেশ নির্জন একটি কেওড়া গাছে উঠে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর ভাবে, ইস্কুলে আর কোনোদিনও না গেলে কী এমন ক্ষতি হয়? সুতরাং ইস্কুল আজ থেকে বাদ। একটা ক্ষতি অবশ্য হয়। সেই ক্ষতিটা তার মায়ের। গত বছর তাদের চরে নতুন ইস্কুল চালু হওয়ার পর যেসব বাচ্চা নিয়ম করে ক্লাসে যায় তাদের একদিন পর পর এক কেজি চাল দেওয়া হয়। তাই ইস্কুল কামাই করলে দারুণ লস। ওই দুই কেজি চাল মিস হলে তার মা খুব রেগে যাবে নিশ্চিত।
কিন্তু ছোট্ট একটি লেজ থাকার কারণে ইস্কুলের প্যান্ট পরতে ভারি অসুবিধে হয় দুখাইয়ের। পাঁচ-ছ’ মাস পর-পর তার লেজটা যখন একটুখানি বড় হয় মাত্র, তখনই তা কেটে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। লেজ কাটার কাজটা তার বড় মামা করে। সে সুন্দরবনের এই দস্যু চরের একমাত্র নাপিত। দুখাইয়ের লেজ বড় হয়েছে জানতে পারলে সে নাপিতের বাক্স বগলদাবা করে অতি আনন্দে ছুটে আসে। তারপর শুরু হয় এক ভয়াবহ যন্ত্রণা-ভরা সময়। তাই কেওড়া গাছের ডাল থেকে আজ আর নামতে ইচ্ছে করছে না দুখাইয়ের।
কেওড়া গাছের পাশের ডালে হঠাৎ একটা বানর কোথা থেকে এসে ঝপ করে বসে। গোল গোল চোখে পিট পিট করে দুখাইয়ের দিকে তাকায়। কেমন অবাক হয়ে যায়। বানরটার দিকে দুখাই এক পলক তাকাতেই বানরটি একলাফে দূরের অন্য ডালে গিয়ে বসে। সেই নিরাপদ দূরত্বে বসে দুখাইকে ভেঙচি কাটে। দুখাই কোনো কথা বলে না। দুখাই না-দেখতে বানরের মতো, না-দেখতে মানুষের মতো। তাই মানুষও তাকে ভেংচি কাটে, বানররাও তার কিম্ভূত চেহারা দেখে ভয় পায়। সে অবশ্য জন্মের সময় এতটা বানর-সুলভ ছিল না। জন্মের পর যত বয়স বাড়তে থাকে ততই প্রকাশ পেতে থাকে তার এই বানরত্ব। তারপর বয়স দুই বছর হতে-না-হতেই তার শিরদাঁড়ার শেষে ছোট্ট একটি লেজ গজিয়ে যায়। বিপদের শুরু তখন থেকেই। কয়েক মাসের ভেতরে তার হাত-পা থেকে শুরু করে সারা শরীরে লম্বা লম্বা ধূসর লোম গজাতে থাকে।
এরপর লেজখানা যেদিন একটু বেশি বড় দেখাল সেদিন তার মা তাকে খুব করে মারল। এ কেমন ছেলে রে বাবা! এ ছেলে নিয়ে তিনি সমাজে মুখ দেখাবেন কেমন করে? তাই দুখাইয়ের মা আচ্ছাকরে তাকে মারেন। যেন দুখাই ইচ্ছে করেই লেজ বানিয়েছে, শরীর লোমে ভরিয়েছে। মা মারতে মারতে বলল, ‘এমনিতেই আগে ছিলি বান্দর-বান্দর দেখতে, এখন তো পুরা বান্দর হইয়া গেলি। মাইনষের কাছে মুখ দেখাবি কেমনে?’
মানুষের কাছে মুখ দেখানোর সমস্যাটা আসলে দুখাইয়ের না। গোল-গোল চোখ, বানরের মতো শরীরের গঠন, ঠোঁট-মুখ-নাকের বিস্তার নিয়ে দুখাইয়ের কোনো দুঃখ নেই। লজ্জাও নেই। লজ্জা বরং তার মায়ের, এমন অমানুষ চেহারার ছেলে জন্ম দিয়েছে বলে সবাই তাকেই ঠেস মেরে কথা বলতে শুরু করে। কেউ কেউ আড়ালে মুচকি হেসে বলে, বানরের সাথে পিরিতি করেই এমন ছেলে জন্মেছে!
তবে দুখাইয়ের চেহারা একটু অমানুষসুলভ হলেও সে আর দশটার মানুষের বাচ্চার চেয়ে অনেক বেশি শান্ত। শুধু একটাই বদ অভ্যাস তার, তড়তড়িয়ে সে গাছে উঠতে পারে, এক ডাল বেয়ে অন্য ডালে ঝুলতে পারে মাটিতে হেঁটে-চলে বেড়ানোর মতোই। আর খুব বেশি পছন্দ করে কলা খেতে। কিছু গাছের পাতাও খেয়ে ফেলে অনায়াসে। তাই মানুষের মতো কথা বলতে পারলেও তার বান্দর-খ্যাতি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই খ্যাতি যত বাড়ে ততই তার মায়ের কষ্ট-অপমানের সাগর ফুলে-ফেঁপে ওঠে। দস্যু চরে কতই না মান-সম্মান আর প্রতাপ ছিল তার স্বামীর, তাদের সংসারের। কী থেকে কী যে হলো!
সুন্দরবনের এই চরে দু-একজন বাওয়ালি আর মৌয়াল আছে। বাওয়ালিরা কাঠ সংগ্রহ করে আর মৌয়ালরা সংগ্রহ করে মধু। এর বাইরে আর সবাই দস্যুগিরি করে সংসার চালায়। তাই এর নাম দস্যু চর। এদের দাপট এতই যে বাঘও এদের থেকে দূরে দূরে থাকে। সাধারণ জেলেরা সাগরের ঝড় কিংবা বনের বাঘের চেয়েও এদের বেশি ভয় পায়। শান্তির বনে অশান্তির একশেষ করে এরা। দুখাইয়ের বাবা ছিল এই দস্যু চরের নামকরা জলদস্যু। সাগরে যেসব জেলে মাছ ধরতে যেত তাদের সব কিছু লুট করাই ছিল তার একমাত্র উপার্জন। কিন্তু দুখাইয়ের জন্মের ছয় মাসের মধ্যে তার বাপ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। এই নিয়েও দুখাইয়ের মায়ের খুব রাগ। যেন দুখাই না জন্মালে তার বাপ মরতোই না।
দস্যুদের ছেলেমেয়েরা যাতে বড় হয়ে দস্যুগিরি না করে সে জন্যই তাদের গ্রামে সরকার সুন্দর একটা ইস্কুল করে দিয়েছে। সেই ইস্কুলে ভর্তি হলেই প্রতি মাসে ১৫ কেজি চাল পাওয়া যায়। তাই চার বছর বয়সে দুখাইকে যখন ইস্কুলে ভর্তি করা হলো তখন তার ওপর মায়ের রাগ কিছুটা কমে গেল। কিন্তু সমস্যা বাধাল তার লেজ আর শরীরের বড় বড় লোম। তত দিনে তার লেজ যে আরো বড় হয়ে গেছে!
তখন একদিন সকালবেলা পাশের গ্রাম থেকে দুখাইয়ের বড় মামা এসে সহজ সমাধান করে দিলেন। তার নাপিতের বাক্স থেকে ক্ষুর-কাঁচি বের করে দুখাইয়ের লেজ কেটে দিল, শরীরের লোম ক্ষুর দিয়ে কামিয়ে দিল। দুখাই খেয়াল করে দেখেছে, এই লেজ কাটা আর লোম কামানোর কাজটা করার সময় মামার চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে। লেজটা ধরে এমন তাচ্ছিল্যে কাটতে থাকে যেন খড়বিচুলি কাটছে। কাটা হয়ে গেলে ক্ষুর দিয়ে জায়গাটা মসৃণ করার সময় দুখাই চোখে ঘন অন্ধকার দেখে। তার মামার সুন্দর একটি রেডিও আছে। ছোট্ট, সৌরশক্তিতে চলে। ব্যাটারি লাগে না বলে সারাদিন সে সেটা ছেড়ে রাখে। ওই রেডিওতে যখন ধুমধামাকা হিন্দি গান দেয় তখনই তার মামা লেজ কাটতে শুরু করে। আগে থেকেই মামা খুঁজে খুঁজে হিন্দি গানের সেন্টার ঠিক করে রাখে। সেখানে যতক্ষণ না খুব জোশের নাচানি গান দেয়, ততক্ষণ ধরে মামা ক্ষুরে ধার দিতে থাকে এক ফালি লম্বা চামড়ার ওপর।
মজার ব্যাপার হলো, শুধু লেজ কাটার সময়ই মামা ওই সব হিন্দি গান শোনে, আর অন্য সময় শোনে শুধু খবর। ঝড়ের খবর, দেশের খবর। তবে গানের তালে তালে মামা লেজ কেটে মনে হয় খুবই সুখ পায়। এই কারণে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার সে ঠিক মনে করে চলে আসে দুখাইয়ের লোম কাটতে। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বাঘের উৎপাত─কোনো কিছুই তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তবে লেজটা কাটা হয় ছয় মাসে একবার।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুখাই দেখে দূরে বসা তার বয়সী বানরটা কেমন উসখুস করছে। কী ভেবে সাহস করে বানরটা দুখাইয়ের পাশে এসে বসে। দুখাই যেই না তার দিকে তাকায় অমনি খুব তাচ্ছিল্যে বানরটি লম্বা জিভ বের করে ভেংচি কাটে। দুখাই চুপ করে থাকে। এসব ভেংচি-ফেংচিকে সে পাত্তাই দেয় না। আজ তার মন যে এমনিতেই খুব ভার হয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাদের বাড়িতে বড় মামা আসবে, তার লেজ কাটবে। গত কয়েকবার লেজ কাটার পর রাতে তার খুব করে জ্বর হয়। দুই বছর আগে তার মা আবার বিয়ে করেছে। বিয়ের এক বছর পর তার ছোট্ট একটি ভাই হয়েছে। সুখাই নামের এই এক বছর বয়সী ভাইটিই এখন মায়ের চোখের মণি। দুখাই অবশ্য ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। তার ভাই তো তার মতো বান্দর বান্দর চেহারার না। তাই রাতে জ্বর হলেও মা তার দিকে ফিরেও তাকায় না। এসব ভেবে দুখাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠল।
এদিকে দুখাইয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে হঠাৎ বানরটি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। খুব সাহস করে এক লাফে খুব কাছে এসে কষে একখানা চড় মারে দুখাইয়ের গালে। তারপর ষণ্ডামার্কা বানরটি পলকের ভেতরে পালিয়ে চলে যায় দুই গাছ পরের একটি ঘন ডালপাতার আড়ালে। দুখাই তাও কিছু বলে না। ইস্কুলের স্যার আর ছেলেরা তাকে এমনিতেই চড়-কিল-ঘুষি মারে। তাকে মারতে সবাই কেন যেন খুব ভালোবাসে।
২.
এভাবে অভাবে-অবহেলায় সবার লাথি-ঝাঁটা খেয়েও দুখাই অনেক কষ্টে ইস্কুলে যাওয়া বাদ দেয় না। একদিন দুপুরে হঠাৎ ক্লাস ফাইভের চার-পাঁচটা ছেলে ক্লাস ওয়ানে এসে দুখাইকে ডেকে নিয়ে যায়।
পতাকা টানানোর জন্য ইস্কুলের মাঝখানে একটি বাঁশ পোঁতা আছে, সেখানে দুখাইকে এনে দাঁড় করানো হয়। একটি ছেলে আগে থেকেই বাঁশটির গায়ে পিচ্ছিল-মতো কিছু একটা মাখাচ্ছিল। তারা এখন একটি অঙ্কের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা করবে। তাদের গণিত বইতে একটি অঙ্ক আছে, একটি বানর প্রতি মিনিটে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে দুই ফুট ওঠে আর এক ফুট নেমে যায়...।
ব্যাপারটা খুব মজার কিছু ভেবে অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও দুখাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের ভেতরে গণিতের স্যার আসে। দুখাইকে বলে, ‘ওঠ্। বাঁশটা বেয়ে ওপরে ওঠ্।’
স্যার ঘড়ি হাতে দাঁড়াল। দুখাই ভয় পেয়ে যায়। কেউ একজন পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে, ‘বাঁশের মাথায় এক কাঁদি কলা আছে, ওঠ্ ওঠ্, খেতে পারবি।’
দুখাই একটু ইতস্তত করতেই স্যার বেত উঁচিয়ে এগিয়ে আসে। বাধ্য হয়ে দুখাই পিচ্ছিল বাঁশের দিকে এগিয়ে যায়। সবাই জানে গাছ বেয়ে তড়তড়িয়ে উঠতে দুখাইয়ের জুড়ি নেই, কিন্তু এই বাঁশ বেয়ে একটু উঠতেই ধপাস করে পড়ে যায় সে। সবাই হি হি করে হেসে ওঠে। আবার উঠতে গিয়ে আবার পড়ে যায় দুখাই। আবার হি হি কলরব। স্যার বেত উঁচিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলে। তৃতীয়বারের চেষ্টাতে দুখাই তড়তড়িয়ে খুব দ্রুত ওপরে উঠে যায়। স্যার মাথা দুলিয়ে বলে, ‘হলো না রে মর্কট। তোকে একবার একটু উঠে আবার নামতে হবে।’
দুখাই নেমে এলো। একজন ছাত্র পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘কী রে কলার কাঁদি নামালি না যে?’
দুখাই পরের বার এক নিমিষে উঠে কলার কাঁদি নিয়ে নেমে এলো। স্যার জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হলো না, হলো না।’ পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাংলার স্যার। বলল, ‘কী করে হবে? বাঁশে মাখা দরকার সর্ষের তেল, আর এরা মেখেছে মধু।’
যে ছেলেটা বাঁশ পিচ্ছিল করার দায়িত্বে ছিল তার দিকে গণিত স্যার আগুন চোখে তাকাল। ছেলেটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘সর্ষের তেল পাবো কোথায় স্যার? আমার বাপ তো মৌয়াল। গত বছরের অনেক মধু জমে ছিল ঘরে। মা বলল মধুতেই ভালো হবে। ঘরে একটুও তেল নেই, আমার কী দোষ!’
এই ঝামেলার ফাঁকে কলার কাঁদি নিয়ে সটকে পড়ে দুখাই।
ছেলেটিকে স্যার কষে একটা থাপ্পড় মারল। যেন বুঝিয়ে দিল, সর্ষের তেল না আনলে চোখে এমন সর্ষের ফুলই দেখতে হয়।
৩.
তবে দুখাই এক ক্লাসে পর-পর তিন বছর ফেল করার পর ইস্কুল থেকে বলা হয়, গাধা পিটিয়ে মানুষ করা সহজ কিন্তু বান্দরকে কিল-ঘুষি মেরেও মানুষ করা সম্ভব না। তাকে যখন ইস্কুল থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়া হলো তখন সে খুশিই হলো। কিন্তু বেজায় রাগ করল তার মা। এখন প্রতি মাসে ১৫ কেজি চাল কী করে আসবে?
পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিন বড় মামা এসেছে তার লেজ কাটতে। ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠান্ডা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশা। গত দুই সপ্তাহ ধরে এখানে উত্তুরে হিমেূল ঠান্ডা বাতাস বইছে। বড় মামা রেডিওর খবর শুনে বলে, ‘সত্য (শৈত্য) প্রবাহ আরো এক মাস চলবে। সুন্দরবনে এবার বরফশীত পড়বে।’
সত্য কথা। নইলে এমন ঠান্ডা আর কুয়াশা তার বোধবুদ্ধি জন্মানোর পর কোনোদিন দেখেনি দুখাই। দুদিন পর নতুন বছরের ক্লাস শুরু হবে। এই ঠান্ডার ভেতরে তার লেজ কাটা হবে, সারা গায়ের চুল চাঁছা হবে। সে মনে মনে কামনা করে, ‘সত্য প্রবাহ যেন মিথ্যা হয়।’ কিন্তু তারপরই তার মনে পড়ে, আর তো ইস্কুল নেই। তাই লেজ কাটারও বালাই নেই। গায়ের লোম এবার থেকে আগাছার মতো গজাতেই থাকবে। কাটার দরকার কী?
কিন্তু লেজ কাটতে না-পেরে তার বড় মামা এমন রেগে গেল যে পারলে দুখাইয়ের গলাটাই কেটে ফেলে। দুখাইকে ইচ্ছে মতো চড়-থাপ্পড় মেরে হাতের সুখ মেটাল। তারপর বলল, সদরে না গিয়ে এত কষ্ট করে যখন বাঘের পায়ের ছাপ-ভরা বনপথ আর নদী পার হয়ে দস্যু-গ্রামে এসেই পড়েছে তখন এবারের মতো দুখাইয়ের লেজ আর লোম কেটেই যাবে।
খোলা উঠোনে বসে দুখাইয়ের মাথা তার দুই হাতের ফাঁকে চেপে ধরে সারা গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দিল মামা। তারপর সাবান মাখিয়ে যখন তার শরীরের লোম কাটতে থাকল তখন দুখাই বরফ ঠান্ডায় রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছে।
ব্যাপারটা দুখাইয়ের কাছে অতি ভয়াবহ। এখন একঘণ্টা ধরে তার লোম কামানো হবে, শেষে লেজ । এমন শীতল বাতাস বইছে যে দুই দন্ড পর-পর যখনই তার গায়ে জল ঢালা হলো তখনই মনে হতে লাগল, একটা ধারালো ছুরি দিয়ে তার চামড়া যেন ফালি ফালি করে কেটে ফেলা হলো। তখন দুই হাতের লোম কামানো হয়েছে মাত্র। হঠাৎ তার মামা কী ভেবে, পুরো শরীরের লোম কামানোর আগেই, তার লেজটা ধরে ক্যাচ করে গোড়া থেকে কেটে ফেলল। চিৎকার করে উঠল দুখাই। প্রতিবারই এমন চিৎকার করে সে। কিন্তু এখন তার মনে হলো, অতীতের মতো এখনো নীরবে এমন কষ্ট সহ্য করার কোনো মানে হয় না।
তাই এর পরের ঘটনাটি সে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে ঘটিয়ে ফেলল। লেজ কাটার পর মামা যেই না লেজটা হাতে নিয়েছ, অমনি তার নাকে সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষি মারল দুখাই। মামা নাকে হাত দিয়ে বসে পড়তেই দুখাই তার নাপিতের বাক্স আর রেডিও নিয়ে দে দৌড়। তারপর এই গাছ থেকে ওই গাছ করে সে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত পালাতেই থাকল। পালাতে পালাতে কোনো এক ন্যাড়া মাথার এবড়ো থেবড়ো চরে এসে থামল। তারপর একটা নদীর পাড়ে বসে কাঁদতে থাকল হাপুস নয়নে। এই চরে অনেক হরিণ। সারাদিনে কিছুই খাওয়া হয়নি। সে যদি বাঘ হতো তবে বেশ আরাম করে একটা হরিণ ধরে খেতে পারত। এত হরিণ দেখে সে একটু ভয়ই পেল। বাঘমামার ভয়। এক মামার হাত থেকে পালিয়ে এলেও বাঘমামা ধরলে আর রক্ষে নেই। সে শুনেছে, যেখানে হরিণ রয়, সেখানে বাঘের ভয়। কারণ বাঘ জানে কোথায় তার খাবার। খাবারের খোঁজে ঠিক ঠিক খুঁজে নেয় হরিণ-চরার জায়গা। ন্যাড়া মাথার চরে অনেক খুঁজে কয়েকটা কেওড়া, গরান, পশুর ও খলসি গাছ দেখতে পেল। একটি গাছের মাথার ওপর বসে সে তার মামার নাপিতের বাক্সটা আগে খুলল। তার ভেতরে রয়েছে একটা কাঁচি, আয়না, দুটো ক্ষুর, দুটো বিড়ি খাওয়ার ম্যাচলাইট, দেয়াশলাই বাক্স আর ফিটকিরি। সে উদাস হয়ে রেডিওটা ছেড়ে দিল। তখন সন্ধ্যা।
৪.
রাত বাড়তেই এমন উত্তুরে শীতল হাওয়া খুব জোরে বইতে শুরু করল যে, দুখাইয়ের হাড়ের মজ্জার ভেতরে যেন কাঁপন ধরিয়ে দিল। দুই হাতের লোম কামানো। সে শুধু একটা হাফ প্যান্ট পরা। এমন ঠান্ডায় কী করে রাত পার করবে? এদিকে লেজ কাটার যন্ত্রণায় তার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। কাটা জায়গায় একটা কাপড় পেঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু এখন তাও নেই। কাপড় দিয়ে জায়গাটা বেঁধে দেওয়ার আগেই সে পালিয়ে এসেছে। সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। কী আর করবে, পাতাঘেরা বড়সড় একটা ডালে আধশোয়া হয়ে রেডিয়োর গান শুনতে থাকে সে। গান থেমে গিয়ে হঠাৎ রাতের খবর শুরু হয়। দুখাইয়ের লম্বা-লম্বা দু’কান খাড়া হয়ে যায়। খবরে বলল, বঙ্গোপসাগরে বেশ বড়সড় একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দু-একদিনের মধ্যে বইতে শুরু করবে নিম্নচাপের দক্ষিণা বাতাস। আর তাতেই আটকে যাবে এখনকার উত্তুরে হাওয়া। উধাও হয়ে যাবে ভয়াবহ শীতের দাপট।
খবর শুনে খুব অবাক হলো দুখাই। আনন্দও হলো খুব। যাক, তা হলে ঠান্ডার জন্য আর দু-একদিন মাত্র কষ্ট করতে হবে। কিন্তু আজ রাতটা পার করবে কীভাবে? রেডিয়োটা বন্ধ করে এমন আকাশ পাতাল ভাবছে, হঠাৎ আবছা জোছনা-আলোয় দেখতে পায় ছয়-সাতটা বানর তাকে ঘিরে ধরেছে। দুখাই ভয় পেয়ে যায়। এদের চোখমুখে ভীষণ নিষ্ঠুরের ছাপ। বানরদের ভাষা সে মোটামুটি বুঝতে পারে। বলতেও পারে অল্পবিস্তর। বানরদের সর্দার প্রথমে মুখ খুলল, ‘তুই কে রে? তোকে দেখে সব বানর ভয় পেল কেন?’
দুখাই চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। বানররা তাকে দেখে কেন ভয় পেল─তা সে কী করে জানবে? সে ভেবেছিল মাত্র ছয়-সাতটা বানর। আসলে তার সামনে যে ক’টা রয়েছে তারা সৈন্য বানর। তাদের হাতে সূচালো শক্ত ডাল। যে কারো পেট তাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া যায়। দূরে অন্য কয়েকটিতে গাছে রয়েছে অসংখ্য বানর। দুখাইয়ের গলা কেমন শুকিয়ে গেল।
বানর সর্দার আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘কী রে? বোবা নাকি? কে তুই?’
বিপদে বুদ্ধিনাশ হয়, কিন্তু দুখাইয়ের মাথায় হঠাৎ ভয়ানক এক বুদ্ধি খেলে গেল। তার মা শত বকাঝকা করলেও তাকে ভালোও বাসত। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছোটবেলায় মায়ের কাছে সে বাঘ-সিংহ-বানর-হরিণদের নিয়ে অনেক রূপকথা শুনেছে। তার মনে হলো, বনের পশুপাখিদের একবার চমকে দিতে পারলে এরা একদম ক্রীতদাস হয়ে যাবে। তখন আর দুখাইয়ের থাকা-খাওয়ার চিন্তা থাকবে না। খুব সাহস আর বুদ্ধি করে কথা বলতে হবে। দুখাই, তাই, খুব সাবধানে খুব নাটুকে ভঙ্গিতে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি তোদের বাপ। বাপের বাপ। তার বাপ। আমি তোদের সবার বাপ। আমি এসেছি তোদের রক্ষা করতে।’
বানর সর্দারকে সবাই খুব মান্য করে। সবার সামনে দুখাই তাকে এভাবে বলায় অপমানে তার মুখ কয়লা-কালো হয়ে গেল। বানর সর্দার তাই আদেশ দিল, ‘এর পেট ফুঁড়ে দাও।’
দুখাই খ্যাক খ্যাক করে হাসল। বলল, ‘আমাকে মারলে তোদের কে বাঁচাবে? আমার তাতে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমাকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন তোদের উদ্ধার করতে।’
বানর সর্দার বলল, ‘ঈশ্বর আবার কী জিনিস?’
দুখাই তার মায়ের মুখ থেকে শোনা কথাগুলো এখানে তোতাপাখির মতো বলে দিল, ‘এই যে ঠান্ডা-গরম, ঝড়বৃষ্টি, গাছপালা, ফুল-ফল, বাঘ-হরিণ... চারদিকে যা যা দেখছিস তা ওই ঈশ্বরের সৃষ্টি।’
এবার বানর সর্দার খ্যাক খ্যাক করে হাসল। বলল, ‘যতসব পোড়ামাটিখোর কথা।’
পোড়ামাটিখোর বলায় দুখাই খুব অপমান বোধ করল। বানররা পোড়ামাটি খায় নেশা করতে। সেই নেশায় বানররা নাকি আজগুবি সব কাণ্ডকারখানা করে।
দুখাই বলল, ‘ঈশ্বর আমাকে বলেছেন─তোরা আমাকে সহজে মেনে নিবি না। ঈশ্বর আমাকে আরো অনেক কিছু বলেছেন। সেগুলো শুনলে তোদের অনেক উপকারই হতো।’
সর্দার হাসতে হাসতে পেট চেপে বসে পড়ল। বলল, ‘তুই এত সুন্দর পোড়ামাটি কোথা থেকে খেয়েছিস বল তো? আমায় একটু দিবি? অনেক দিন ভালো পোড়ামাটি খাই না।’
দুখাই বলল, ‘বিশ্বাস করবি না, তা তো আমি আগেই জানি। আজ শুধু একটা কথা বলে রাখি, ঈশ্বর বলেছেন, আর মাত্র কয়েকদিন পর সব ঠান্ডা তুলে নেবেন। অনেক তাড়াতাড়ি বসন্ত এনে দেবেন।’
দুখাই এমন আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথাগুলো উচ্চারণ করল যে সর্দার এবার একটু ভড়কে গেল। বলল, ‘সত্যিই? যদি মিথ্যে হয়, তবে কী হবে?’
দুখাই হাসতে হাসতে বলল, ‘তা হলে তোরা আমার পেট ফেড়ে মেরে ফেলিস। এখন আমাকে তোরা কিছু শুকনো পাতা এনে দে। কয়েকটা কলা কিংবা সোনালু ফল এনে দে।’
সৈন্য বানররা দৌড়ঝাঁপ করে শুকনো পাতা জড়ো করল, কলা আনল ডজন খানেক, সোনালু ফলও আনল। ফলটি দেখতে লাঠির মতো গোল, ভেতরের শাঁস মিষ্টি স্বাদের। দুখাই খুব রসিয়ে খায় বলে তার সহপাঠীরা সোনালুকে বলে বান্দরলাঠি।
দুখাই শুকনো পাতার অর্ধেক এক জায়গায় জড়ো করে ম্যাচলাইট দিয়ে আগুন ধরাল। আগুন দেখে আর সব বানরেরা ছিটকে দূরে সরে গেল। ভয়ে পালিয়েই গেল অনেকে। এমন কাজ তারা মানুষদের করতে দেখেছে, কিন্তু বানররা আগুনকে ভয়ই পায়। আগুন জ্বালানোর কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই। আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে ওম নিতে নিতে দুখাই আরাম করে কলা খেলো, বান্দরলাঠি খেলো। সারাদিন পর তার শরীর এখন একটু ভালো লাগল।
৫.
মাত্র এক সপ্তাহেই দুখাই বানরসমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী বানরে পরিণত হলো। বলা যায়, সে এখন বানরদের দেবতা। তার ঐশী শক্তিতে প্রায় সব বানরই চমকে গেছে। বনে এখন বইছে বসন্তের ফুরফুরে দখিনা হাওয়া। ঠান্ডা উধাও। এটা তারা সবাই মেনে নিয়েছে যে দুখাইয়ের ঐশী শক্তিতেই এমনটি হয়েছে। শীত-তাড়ানো এমন ভেলকি তারা কোনোদিনও দেখেনি। দুখাইয়ের খাতির-যত্ন এখন রাজার মতো। এ সময় একদিন দুপুরে হঠাৎ রেডিওতে সে জানতে পারে, আসছে শেষ রাতে নিম্নচাপের কারণে দক্ষিণ ভারতে ঝড় হবে। আর তার প্রভাবে সুন্দরবন এলাকায় বৃষ্টি হবে ক’দিন। দিন রাত ঘন কুয়াশা থাকবে। এ খবর শোনার পর বিকেলে সে জরুরি সভা ডাকে। সবাইকে বলে, ‘ঈশ্বর তাকে জানিয়েছে─আগামী ক’দিন তিনি পৃথিবীর চারদিকে ধোয়ায় ভরে রাখবেন। সব কিছু থেকে ধুলো পরিষ্কার করবেন। এই জন্য আকাশ থেকে দিনরাত অনবরত জল ঝরাবেন।’
বানররা এর পর কয়েকদিন ধরে অবাক হয়ে দেখল, তাদের দুখাই দেবতা যা বলছে তাই ফলে যাচ্ছে।
কিছু বানর অবশ্য ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে মেনে নিল না। দুখাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন কয়েকজন সন্দেহবাদী বানর এসে তার পোটলাপুটলি ঘেঁটে দেখল, সেখানে কিছু হিজিবিজি জিনিস আছে। এর ভেতরে আয়নাটাকে তারা চিনতে পারল। আর দেখল সেই রেডিওখানা। এই রেডিও নিয়ে বানরদের কৌতূহলের শেষ নেই। মানুষের মতো কথা বের হয় এই যন্ত্র দিয়ে। তারা তার বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারে না। এসব সন্দেহবাদীরা হঠাৎ একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা বানর সর্দারকে বলে, ‘এ তো বানর নয়। খুব বাজে চেহারা। কেমন মানুষ-মানুষ দেখতে।’
সর্দার বলে, ‘ঈশ্বর পাঠিয়েছেন তাই এমন দেখতে।’
তারা বলে, ‘কিন্তু এর লেজ নেই কেন?’
সর্দার বলে, ‘লেজ নেই কথাটা ঠিক না। লেজ ছিল, কিন্তু কেটে ফেলেছে।’
‘কেন?’ তারা অবাক হয়।
সর্দার বলে, ‘লেজ থাকা তো ভালো কথা না। লেজ দিয়ে কাজটা কী? আমি ঠিক করেছি আমার লেজটাও কেটে ফেলব।’
তারা চিৎকার করে বলল, ‘কেটে ফেলবেন?’
সর্দার হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘হ্যাঁ। লেজে ময়লা জমে। মারামারির সময় সবাই লেজ ধরে টানে। কী দরকার ঝামেলা রাখার? তোমরা চাও তো তোমাদেরটাও কাটার ব্যবস্থা করি।’
সর্দারের প্রস্তাবে তারা খুব বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
এর কয়েকদিন পর আবার প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ল। দুখাই এর আভাস এবার আগেভাগে দিতে পারেনি। সর্দার বললে, ‘হুজুর, আবার যে শীতল বাতাস বয়?’
দুখাই খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ঈশ্বর রাগ করেছেন। তোরা আমাকে বিশ্বাস করছিস না, তাই আবার ঠান্ডা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’
সর্দার বলল, ‘কয়েকজন বাদে আমরা সবাই-ই আপনাকে বিশ্বাস করেছি হুজুর। আপনি সাক্ষাৎ দেবতা।’
দুখাই বলল, ‘যারা আমাকে বিশ্বাস করে না তাদের আজ সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে আস। আমি আজ রাতে নতুন একটা ঐশী দেখাব সবাইকে।’
৬.
সন্ধ্যাবেলায় দুখাই সবাইকে বলল, ‘কেউ কেউ আমাকে নাকি বিশ্বাস করছে না! এজন্য আজ আমি খুব রেগে আছি। আমার রাগ হলো ‘লাল’। আজ রাতে একখানা গোল চাঁদ উঠবে। আমার রাগ দিয়ে সেই চাঁদখানা লাল করে দেব। আর চাঁদটাকে আমি অল্প অল্প করে নষ্ট করে দেব। তারপর আমার যখন মন ভালো হবে তখন চাঁদটা আবার আগের মতো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’
এদিন সকালেই রেডিওতে দুখাই আজকের চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে ঠিক এই কথাগুলোই অন্যভাবে শুনেছে। দুপুরের খবরে আবার ভালো করে শুনে নিয়েছে যাতে সে ভুল কিছু না বলে ফেলে।
আকাশ ছিল মেঘমুক্ত, স্বচ্ছ। রাতে সবাই বনের বিভিন্ন গাছের মগডালে বসে এই অদ্ভুত বিস্ময়কর দৃশ্য দেখল।
এর পর থেকে দুখাইয়ের পথে আর কোনো কাঁটা রইল না। সবাই একবাক্যে তাকে দেবতা বলে স্বীকার করল। শুধু সেই অবিশ্বাসীরা মুখে কিছু না-বললেও ভেতরে ভেতরে মেনে নিতে পারল না।
বছর খানেক পর একদিন তাদের ভেতর থেকে একজন ঠিক দুখাইয়ের রেডিওর মতো একটি রেডিও কোনো এক মানুষের ঘর থেকে চুরি করে আনে। সর্দারকে বলে, ‘এ রকম একটা জিনিস দুখাইয়েরও আছে। ওটা মানুষের। দুখাই বানর না, মানুষ।’
সর্দার ওদেরকে দুখাইয়ের কাছে নিয়ে গেল। দুখাই রেডিওটা নেড়েচেড়ে দেখে মুগ্ধ হয়। একদম নতুন রেডিও। তার রেডিওটা আজকাল মাঝেমধ্যেই বিগড়ে যায়। নষ্ট হতে খুব দেরি নেই। দুখাই খুব সন্তর্পণে তার পুরনো রেডিওটা বদলে নেয় নতুনটার সঙ্গে। পুরনোটা ফেরত দিতে-দিতে বলে, ‘এইটায় তেমন ভালো গান হয় না।’
সর্দার জানে গান কী জিনিস। খুব মন দিয়ে দুখাইয়ের সঙ্গে সে গান শুনেছে। যদিও সে ভাষা বোঝে না একটুও, তারপরও মনটায় কেমন দোল খায়। সর্দার ওদের তাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘যা যা, কী সব বাজে জিনিস আনিস।’
সেদিন সর্দার ঘোষণা দেন, দুখাই দেব্তার সম্মানে আজ থেকে তার রাজ্যের সবাইকে লেজ কাটতে হবে। এই ঘোষণা শুনে অনেকেই রাজ্য ছেড়ে পালাল, অনেকে স্বেচ্ছায় লেজ কাটল। কিন্তু সেই থেকে বানরসমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। লেজকাটা আর লেজওয়ালা। বনে-বনে লেজকাটা বানরে ছেয়ে গেল দিন দিন। দিন দিন প্রায়ই রক্তারক্তি ঘটনা বাড়তে লাগল লেজ-কাটা আর লেজওয়লাদের সঙ্গে। বানরসমাজে আর সুখ রইল না।
দুখাই রয়েছে মহাসুখে। এত সুখের পরও এত মারামারি তার ভালো লাগে না। কিন্তু সে চাইলেই এখন তা আর থামাতে পারে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। দুখাই ভাবে, একদিন সব বলে দেবে বানর সর্দারকে।