পতিত হৃদয়ে ঈদ আনন্দ

বহুদিন অবধি পতিত পড়ে আছে হৃদয়। তাকে দেখা হয়নি। কেবলই পুঁজি আর পণ্য- এসব জড়িয়ে বুঁদ হয়ে আছে দেহখানি। এমন কোটি কোটি দেহ মিলে ঢাকাবাসী। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা এমন হৃদয়কে রবীঠাকুর ‘স্থাবর মন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। স্থাবর এই হৃদয়গুলো নিস্তেজ-নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে অস্থাবর শরীরটির মাঝে। ঢাকার এই জীবনে বেশির ভাগেরই নেই এক ইঞ্চি নিজ নামে লেখা জমি- অথবা একটি ফ্ল্যাট। এ জীবনের এক ফাঁকে ঈদ আসে- প্রতীক্ষার ঈদ। তাই সবারই টান থাকে প্রিয়জনের কাছে ফিরে যাওয়ার। বেশির ভাগের ঈদ কাটে বাস্তুভিটায়। আবার কারো বা ঢাকায়।
এই ঢাকা শহর। দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ জমিনে গড়ে উঠেছে। তার ওপর জড়ো হয়েছে দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ। এখানে বাসে চেপে বেশির ভাগের চলতে হয়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, এমনকি নারী-পুরুষ সবাইকে। এখানে লোকাল বাসে সব মিলে যত সব আসন থাকে, তার চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ বাসে চাপে। কখনো কখনো তার চেয়ে বেশি। এই কোটি মানুষের বাসগুলো কিছু মানুষের চেপে থাকা হাজার হাজার লাল-নীল রং-চঙা ব্যক্তিজনের গাড়ির পেছনে আটকে থাকে। ফলে দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়। অবাক হয়ে দেখতে হয়, প্রাইভেট কারের খালি পড়ে থাকা হাজার হাজার আসনের পেছনে লাখে-লাখো মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার ভিড় জমে এই ঢাকায়। যুবকের সাথে বৃদ্ধ আর পুরুষের সাথে নারীরা বাসে ওঠার দৌড়ে প্রতিযোগিতা করে। জীবিকার দৌড়ে কোটি মানুষ যা আয় করে, কিছু মানুষের বাড়িতে মাথা গুজতে তার অর্ধেকখানি ব্যয় হয়। কিছু মানুষের হোটেলে উজাড় হয় কোটি মানুষের পকেট। আসলে, এই ঢাকা একটি স্টোরি- মানে সাজানো রোজনামচা। এভাবে দিনে দিনে বহুদিন পার হয়ে যায়, তবু হৃদয়খানি একটু খুলে দেখা হয় না। এই আত্মহারা জীবনকে তাই কবি টি এস এলিয়টের মতো করে বলতে হয় ফাঁকা মানুষ (hollowman) বা পতিত জমি (Waste land)। ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার প্রথম অংশে তিনি যা লিখেছেন তা বাংলায় এভাবে বলা যায়-
‘কি এক শেকড়! আকড়ে ধরে, আবার ছত্রে ছত্রে ছেয়ে যায়
এসব ভিন্ন সবই কি নির্মম? হে মানব পুত্র-
বলতে পার না- ধারণা বাহির; জান কিছু মাত্র
গাদাগাদা ছবি- ছিন্ন-ভিন্ন ছবি, যেখানে ঠিকরে পড়ে রবি
মরা গাছ আর ঝিঁঝিঁ: ছায়া নেই- নেই বিরাম
অথবা শুকনো পাথর- নেই ছলছল, কলকল, ফুটফাট ধ্বনি’
এমন এক নগরী ছেড়ে তাই ঈদের এই ক্ষণে যদি প্রিয়ার হাত ধরে ছুটে যাওয়া যায় প্রিয়জনের কাছে! আহা! ছুটি বটে তিনদিন। যাওয়া আর আসা দুইদিন। মাঝে ঈদের দিন। কী আনন্দ- কী আনন্দ! যদি বা পথেই আটকে থাকি বাসের সারিতে। অথবা হৃদয়ের অবসান হয় দুর্ঘটনার জালে। অবশেষে সব বাধা মাড়িয়ে দেখা হয় প্রিয়জনের মুখ। সে এক অনাবিল ঈদের আনন্দ। কতই না নির্মল সেই সুখ। থাকে স্নিগ্ধ হাসি, রাশি রাশি। সব ব্যাথা ভুলে প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয় সবার যেন সে মধ্যমণি। কেননা বহুদিন বাদে দেখা। আবার, তার মতোই যারা ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে এলাকায় এসেছে, তাদের সাথে জমে ওঠে আরেক অনুভূতি। এই অনুভূতিগুলো কেবলই যেন পতিত জমিকে জাগিয়ে তোলে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতির সাথে এই অনুভূতিকে মেলানো যায়। তিনি বলেন, আকাশ থেকে নামা বৃষ্টির ধারা ‘ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়, সেই চেষ্টা বিভিন্নভাবে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে’। পতিত হৃদয়খানি এভাবেই জেগে ওঠে।
বেশির ভাগ ঢাকাবাসীর আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান খুব কম হওয়ায় এবং ছুটি-ছাটার সংকটের কারণে তারা ভ্রমণের মতো বিনোদনের সুযোগ পায় না। এমনকি ঢাকার ভেতরে ঘোরাঘোরির জন্যও নেই কোনো ভালো পরিবেশ। তবে ঢাকা যে উন্নত হচ্ছে না- তা নয়। ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণায় বলা হয়েছে বড় বড় অট্টলিকা, প্রশস্ত রাস্তা, উড়াল সেতু সবই হচ্ছে। কিন্তু স্থিতীশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো সব দিক বিবেচনায় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বাস অযোগ্য শহরের প্রথম কয়েকটির মধ্যেই রয়েছে। কেননা এখানে বাতাসে সিসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস-পানি, বিদ্যুৎ-সংকটের সমস্যা যেন নিত্যদিনের। তা ছাড়া চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, গুম ও হত্যার ঘটনায় নগরবাসী উদ্বিগ্ন। তবুও এই ঢাকা যেন প্রত্যাশিত নগরী। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার লোক প্রবেশ করে দুই হাজার বেরিয়ে যায় এবং তিন হাজার স্থায়ী হয়। তাতে গড়ে প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ লোক ঢাকায় স্থায়ী হয়। এভাবেই প্রত্যাশার মাত্রাকে সংখ্যায় বিবেচনা করা চলে। কিন্তু হৃদয়ের পাল্লা বড়ই নিষ্ঠুর। এখানে পাশাপাশি বসবাসের পরও চেনাজানা হয় না। এমনকি কারো বিপদে কেউ এগিয়ে গিয়ে ঝামেলা বাড়াবার দায় নেয় না। এভাবেই হৃদয়টি অনাবাদী পড়ে থাকে। স্থাবর হয়ে রয়।
তাই বছরের প্রায় ৩৪০টি দিনের এ নিষ্ঠুরতার পর যখন ঈদ আসে তখন হৃদয় জেগে ওঠে। নতুন করে আবাদ হয়। ক্ষণে ক্ষণে হিন্দোল, ক্ষণে-ক্ষণে সরসে ভরে ওঠে হৃদয়।