স্লাভয় জিজেকের সাক্ষাৎকার
‘ইউরোপ জানে না তারা কী চায়’

স্লাভয় জিজেক বিখ্যাত স্লোভেনিয়ান দার্শনিক। বর্তমানে জীবিত দার্শনিকদের মধ্যে জিজেক অন্যতম। উদার বামপন্থী এই দার্শনিক বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এবং নিউ-লিবারালিজমের কঠোর সমালোচক। ইউরোপ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিয়েও রয়েছে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সম্প্রতি অভিবাসন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইত্যাদি বিষয়ের ওপর তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে ‘ইউরো নিউজ’ নামক একটি অনলাইন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সারিগো ক্যান্তোনে। সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন হাসনাত শোয়েব।
প্রশ্ন : আপনার মতে বিশ্বায়ন হচ্ছে সাম্প্রতিক অভিবাসন সংকটের প্রাথমিক উৎস, কেন?
জিজেক : আমার মতে, বিশ্বায়নের আরেকটা দিক হলো নতুন ধরনের অদৃশ্য বিভাজন তৈরি করা। আমাদের বেকারত্বের সমস্যা আছে। এমনকি স্লোভেনিয়াতেও শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করছে। আমি কোথাও পড়েছি, প্রায় ৫০ ভাগ শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। অনেক রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে, প্রচুর লোক বস্তিতে বাস করছে, যাদেরকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
তো এটা এখন আর পুরোনো পরিষ্কার শ্রেণি বিভাজনের মধ্যে আবদ্ধ নেই। এটা এখন তাদের মধ্যে অনেক বেশি অস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করেছে, যারা নাগরিক সুবিধা, মৌলিক নিরাপত্তাসহ আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে এবং যারা পারছে না। আমাদের এখন প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত বলবৎ করার ক্ষেত্রে কিছু বহুজাতিক ক্ষমতা। কারণ এ ধরনের পদ্ধতি ছাড়া বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ করা যাবে না, অভিবাসন সংক্রান্ত মামলাগুলো রক্ষা করা যাবে না।
প্রশ্ন : কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত এই ধরনের বহুজাতিক ইস্যুগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া করা। কিন্তু এটা ব্যর্থ হয়েছে। তারা সেটা করেনি।
জিজেক : হ্যাঁ, এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্র্যাজেডি। ইউরোপ জানে না তারা কী চায়। আমার মূলত বর্তমানে দুই ধরনের ইউরোপ দেখি। একটা ইউরোপ হচ্ছে ব্রাসেলস কেন্দ্রিক টেকনোক্রেটিক ইউরোপ। এমনকি তারা কেবল চায় যে কোনোভাবে বিশ্ববাজারের অংশ হয়ে থাকতে। তারা কোনো পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে না।
এরপর আরেকটা হলো অভিবাসীবিরোধী জনপ্রিয় ইউরোপ, আমি মনে করি এটা ইউরোপের জন্য সত্যিকারের হুমকি। আমি আসলে বড় ধরনের বহিঃআক্রমণের ভয়ে ভীত নই। আমরা সেটা মোকাবিলা করতে পারব। আমি ভয় পাই, যারা আজ ইউরোপকে রক্ষা করতে চায় তাদের। এমন ইউরোপ কি হবে, উদাহরণ স্বরূপ, ফ্রান্সে লে পেন ক্ষমতায় এলো এবং এ রকম আরো কিছু ঘটবে যেখানে ভালোবাসা থাকবে, সে ইউরোপ আমরা সবাই জানি। আমি কি আশা করি? ইউরোপ এখনো টিকে আছে কিছু মুক্তির মূল্যবোধ, সামাজিক নিরাপত্তা, সমতা, নারী অধিকার এবং আরো বেশ কিছু বিষয়ের ওপর।
প্রশ্ন : কেন পশ্চিমা দুর্বল শ্রমিক শ্রেণি এবং মধ্যবিত্তেরও অন্যান্য মহাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করা উচিত?
জিজেক : আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছেন যা, বেশির ভাগ বামপন্থী এড়িয়ে যান। কারণ, সাধারণ মানুষ যারা অভিবাসীদের ব্যাপারে ভীত, কিছু অর্থে তারা যৌক্তিকও। যদি ইউরোপ পুরোপুরিভাবে অভিবাসীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তবে ধনী লোকেরা তার ভুক্তভোগী হবে না; হবে যাদের কাজ ও বেতন কম তারা।
এটা যে শুধু মানবতা কিংবা শরণার্থীদের গ্রহণ করা, না করার ব্যাপার না, সেটিকে স্পষ্ট করতে যূথবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার পথ খুঁজে বের করাই আমার মতে একমাত্র সমাধান হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো কল্যাণ রাষ্ট্রের পতনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইউরোপে বিশেষভাবে ক্ষোভ আছে। কিসে ইউরোপের মানুষ অসন্তুষ্ট, কী তাদের এত যন্ত্রণা দেয়, এর সবই বৈশ্বিক পুঁজিবাদের ভারসাম্যহীনতার যে সংকট তারই অংশ।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের সংগ্রামের সঙ্গে আমাদের সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে। যদি আমরা এটা মেনে না নিই, যদি আমরা একই রকমই থেকে যাই তাহলে শরণার্থীরা আসতেই থাকে, বোঝা হবে এবং আমরাও হারতে থাকব। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের দরকার বহুজাতিক সংগঠন।
প্রশ্ন : আইন জারি করার ক্ষমতাবলে?
জিজেক : অবশ্যই। আমি এখানে কোনো সমস্যা দেখি না।
প্রশ্ন : কিন্তু এটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং এই তারা ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে...
জিজেক : এবং এটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, ঠিক আছে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কিন্তু বিকল্পটা কী? আমি কোনো বিকল্প দেখছি না। কারণ যদি আমরা এটা পরিত্যাগ করি এবং শক্তিশালী জাতি রাজ্যের খেলা খেলি… যেটা আসলে ইংল্যান্ড করে থাকে।
প্রশ্ন : কিন্তু সমস্যা এখানে ব্রাসেলস না, বিশ্বায়ন...
জিজেক : এটা তাই যা আপনি বলছেন, কিন্তু আমি তা মনে করি না।
প্রশ্ন : এটা কল্যাণ রাষ্ট্রের সংকটের কারণে নয়... ব্রাসেলসের অভিযোজনের...
জিজেক : ব্রাসেলসের সমালোচকরা প্রায় যা উপেক্ষা করে তা হলো, ব্রাসেলস মানে কেবল মাত্র এই বাজে বৈশ্বিক আমলাতন্ত্রই নয়। ব্রাসেলস ন্যূনতম একটা কাজের মানও নিশ্চিত করেছে এবং আরো অনেক কিছু, সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টাও। যার ফলে সম্যকভাবে এখনো আমি মনে করি এই যুদ্ধটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে চালিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন : ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক ঘটনাটি। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র কি একধরনের বৈপ্লবিক সময়ের সম্মুখীন হয়েছে?
জিজেক : অবশ্যই। ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প অসহ্য, বাজে বর্ণবাদী কৌতুক, অশ্লীল এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু একই সময়ে আপনি কি খেয়াল করেছেন, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল বিষয়ে সে কিছু সত্যি কথা বলেছে। সে বলেছে, আমাদের উচিত প্যালেস্টাইনের স্বার্থটাও দেখা এবং এই পরিস্থিতিটা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে অগ্রসর হওয়া। সে বলেছে, আমাদের উচিত নয় রাশিয়াকে শত্রু বানিয়ে রাখা, সেখানে আলাপের একটা পথ খুঁজে বের করা। সে এমনকি ন্যূনতম উচ্চ মজুরির কথাও বলেছে। সে ইঙ্গিত দিয়েছে সে সহজেই ওবামার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনীতিকে বাতিল করবে না।
প্রশ্ন : সে উদার, মধ্যপন্থী...
জিজেক : হ্যাঁ! এটাই আমার উসকানিমূলক তত্ত্ব! যদি তুমি এটাকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে পারো এবং বিপজ্জনক হলেও আমি এটা স্বীকার করতে পারি, সে অনেক বেশি সুযোগসন্ধানী প্রার্থী যদিও তার আসল রাজনীতি সম্ভবত খুব খারাপ না।
প্রশ্ন : রাশিয়া ও চীন কি ভিন্নধর্মী অর্থনৈতিক কাঠামো, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন উপস্থাপন করতে পেরেছে, এমন একটি বিকল্প যা পাশ্চাত্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে?
জিজেক : হ্যাঁ, তবে আমি এখানে পরিমিতভাবে সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্যের পক্ষে। কারণ ওটা একটা বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু তা স্রেফ ফ্যাসিবাদ অনুপ্রাণিত স্বৈরাচারী পুঁজিবাদের বিকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি এটা খুব ভালো করেই জানি। আমি চীনে গিয়েছিলাম, আমি তাদের সঙ্গে তর্ক করেছি ওই সব কমিউনিস্ট শাসনের দৃশ্যত সূক্ষ্ম কনফুশিয়ান ন্যায্যতা নিয়ে। তাদের বিষয়বস্তু সব সময় একই থাকে: ‘আমরা এখনো গণতন্ত্রের উপযোগী নই, এর মানে বিশাল এক সামাজিক বিস্ফোরণ দরকার অনেকটা...’ তারা সব সময় কোনোরকম সচেতনতা ছাড়াই এই সব ফ্যাসিস্ট টার্ম ব্যবহার করে। আমাদের কিছু করপোরেট স্থিতি দরকার, যেখানে সবাই নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করবে। সংহতির জন্য সেখানে দরকার কেবলমাত্র একটি আদেশ মঞ্জুর হওয়া। তারা চায় একটি রক্ষণশীল আধুনিকায়ন। আমি বলি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুঁজিবাদও এই নিদের্শনা অনুযায়ী চালিত হয়।
প্রশ্ন : আমি কি আপনাকে এবার শেষ প্রশ্ন করব, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
জিজেক : হে ইশ্বর, আমি ভেবেছিলাম আমি মানুষ না, একটা দৈত্য...
প্রশ্ন : আপনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, আপনি দর্শনের এলভিস। এটা কী...
জিজেক : না, আমি বলিনি। আমি এটা ঘৃণা করি। আপনি এখন শত্রুর মতো কথা বলছেন এবং আমরা মানুষরা ক্ষমতা গ্রহণ করব, আপনাকে পাঁচ বছরের জন্য গুলাগে (১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিচালিত একধরনের শ্রমশিবির, যেখানে প্রচুর লোকা মারা যায় বলে ধারণা করা হয়) পাঠানো হবে। পাঁচ বছরের জন্য, হ্যাঁ। এগুলো সেই সব ব্যক্তিরা বলে যারা আমাকে সরাসরি আক্রমণ করার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে আক্রমণ করে। প্রচার করে ‘আমি পাগল স্টালিনবাদী, বিভ্রান্ত...’, আপনি জানেন, তারা স্বীকার করে আমার বিশেষ জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু এটি যে বার্তা দেয় তা হলো, আমি এলভিস, ‘যে বেশ মজাদার লোক, তুমি তাকে শুনতে যেতে পারো, কিন্তু এটা পপ দর্শন, কৌতুক, এটাকে সিরিয়াসলি নেবে না,’ আরো কত কি।