সৈয়দ হক ডাক দিয়ে যান

উত্তরের জনপদ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর গ্রামীণ সাদাসিধে এক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইনের বড় ছেলে সৈয়দ শামসুল হক কালের পরিক্রমায় যে বাংলা সাহিত্যের নাগমণি হয়ে উঠবেন, তা কে জানত? এমনটা জানলে বাবা হয়তো ছেলেকে ডাক্তার হওয়ার জন্য জোরাজুরি করতেন না। আবার বাবার পীড়াপীড়িতে অতিষ্ঠ সৈয়দ হক তৎকালীন বোম্বেতে গিয়ে সিনেমা প্রোডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ না করলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণাও হয়তো আমূল পাল্টাত না। জীবনের নানা ঘাটে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নিখাদ সোনায় রূপান্তরিত হয়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকলেন সৈয়দ শামসুল হক। যে তারকার দ্যুতি আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে ভবিষ্যতের সাহিত্য প্রতিনিধিদের।
লেখক সৈয়দ শামসুল হক এক জীবনে সাহিত্যের সপ্ত সমুদ্রে সমানতালে সাঁতরেছেন। আর সাগর সেঁচে কুড়িয়েছেন প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, কাব্যনাট্য, উপন্যাস, কথাকাব্য, গল্প, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য নামের মণিমুক্তো। আর সাহিত্যের সেই নীলকান্ত মণিরাজিরা তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘সব্যসাচী’র বরণমালা।
সমালোচকরা বলেন, সব বাদ দিয়ে কেবলমাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘পরাণের গহীন ভেতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ লিখতেন, তবে এই দুটো গ্রন্থই তাঁকে অমর করে রাখত। তিনি যদি শুধুমাত্র ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ আর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নামের কাব্যনাট্য দুটো লিখতেন তবেই তিনি বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। এমন একজন মানুষ জীবনের শেষবেলা পর্যন্ত মননশীল রচনায় নিজেকে ভাস্বর রেখেছিলেন। তুলনারহিত এই লেখক মানুষটির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি থাকল।
সৈয়দ হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে তাঁর আসল জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়েও পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখেই সাহিত্যের নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন তিনি। যে মানুষটির ভবিতব্য ছিল এমন যে ভাবীকালে তিনি হয়ে উঠবেন শিল্পের মাস্টার, তাঁর একাডেমিক পড়াশোনায় কালক্ষেপণ করলে চলবে কেন? কোনোকিছুতেই বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতায় ব্যাঘাত করা কি তাঁর মানাত?
জীবনবেলার দীর্ঘ যাত্রাপথে মহাকাব্যিক পটভূমিকায় রচিত ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘নিষিদ্ধ লোবান’ কিংবা ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘নীল দংশন’ ও ‘আয়না বিবি’র পালাসহ অর্ধশতাধিক উপন্যাসের সফল রূপকার সৈয়দ হক।
সৈয়দ হক তাঁর রচিত ছোটগল্পে নিজের জন্মভূমির প্রান্তিক মানুষের বেদনার ভার মর্মন্তুদ ভাষায় তুলে এনেছিলেন। নাটকের ভাষায় ব্যবহার করেছেন রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা, গ্রামীণ মানুষের মুখের কথা। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে প্রতিবাদী নূরলদীন যখন হাঁক দিয়ে যান :
‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’।
ঘুমিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে পড়া আমাদের সামগ্রিক বাঙালি চেতনাকেই যেন জানান দিয়ে যায়, জাগবার সময় এখনই, নয়তো আর কখনোই নয়।
কবি সৈয়দ হক প্রতিবাদী নূরলদীনকে স্মরণে রেখেছেন দেশ ও মানুষের উত্থান-পতনে বারবার।
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
এগারো-বারো বছর বয়সে যে কবি লিখেছিলেন তাঁর প্রথম পদ ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে!’ সেই কবি জীবনের শেষবেলায় ‘মৃত্তিকার ঘন অন্ধকারে’ কাব্যের মাধ্যমে স্বর্গীয় আলোয় পড়া জীবনপাতার ওপর কাঁধের ফেরেশতাদের হিসাবনিকাশের কাব্যিকতা শেষে নিজেকে সমর্পিত একজন মানুষ হিসেবে নির্ভাবনার চিরপ্রয়াণকে আলিঙ্গন করেন।
মানুষের মুখে মুখে ফেরা বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুসে’র অমর স্রষ্টা সৈয়দ শামসুল হককে কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না, যার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি নিজের গানেই যেমনটা লিখেছিলেন, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা...’ , এই অতুল্য মানুষটি ৮১ বছরের বর্ণিল জীবনের গল্পপাঠ সমাপনান্তে অনন্তের পথ পাড়ি দিয়ে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, কাব্যময়তা, রূপকল্প আর কথকতায় চিরঞ্জীব হয়ে রইলেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’ আরো বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল পত্রিকার কলাম ‘হৃৎকলমে’র অমৃত ঝরনাধারায়।
‘পরাণের গহীন ভেতর’ কাব্যে সৈয়দ শামসুল হক বড় সুন্দর করে আমাদের এই বিস্ময়কর জীবনের বন্দনা করেছিলেন :
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।
.....
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভেতর।
কবির নশ্বর দেহটি আজ আমাদের মাঝে নেই বটে, কিন্তু কবি থাকলেন তাঁর অতি আরাধ্য কথার কারুকাজে। নিজের মৃত্তিকাকে ভালোবেসে শেষ ঘরের ঠিকানা কবি নিজেই ঠিক করে গিয়েছেন ধরলা নদীর পাড়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে। নাগেশ্বরীর ভূমিপুত্র অন্তিমশয্যায় সুশান্তির ঘুমের দেশ হিসেবে বেছে নিলেন নিজের চিরচেনা বাহের জনপদকেই।
সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন, ‘জন্মে জন্মে বারবার কবি হয়ে ফিরে আসব এই বাংলায়’। আর আমরাও বারবার বরণডালা সাজিয়ে রাখব দেশজ এই কবিকে স্বাগত জানাতে। কবি থাকবেন বাংলার কথায় ও মানুষের কবিতায়।