সৈয়দ শামসুল হকের সাথে শেষ কথা

‘তুমি তিনদিনের একটি গল্পলেখার ওয়ার্কশপ কর। দুদিন আমি আর একদিন তোমার আপাকে (আনোয়ারা সৈয়দ হক) দিয়ে করিও। গদ্যের দিকে ঝোঁক দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেটিকে ফিরিয়ে আন।’
আমি রাজি হয়েছিলাম। দারুণ ভালো লেগেছিল প্রস্তাবটা। প্রাচ্যসংঘের ছেলেদের সাথে বিশেষ করে প্রাচ্য সাহিত্যসংঘের সদস্যদের একাধিক দিন বলেছি। কিন্তু তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কত বড় প্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত হলো এবং সত্যিই আমরা দুর্ভাগা যে সৈয়দ শামসুল হকের হাত ধরে গল্প লেখার ওয়ার্কশপের আয়োজনটা করতে পারলাম না।
সর্বশেষ কবির সাথে আমার কথা হয় ফোনে। লন্ডনে চিকিৎসাকালীন এই তো সেদিন মাস দুয়েক আগে তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছি না। দুপুরে বসে আছি আমার লাইব্রেরিতে (বইহাটে)। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। রিসিভ করলাম। আনোয়ারা সৈয়দ হকের কণ্ঠ। শুনেই আমি ভীষণ উত্তেজিত। ‘আপা কেমন আছেন আপনারা? দুলাভাইয়ের শরীরের খবর কী?’
আপা তাঁর ডাক্তারি পরিভাষায় অনেক কথা বললেন। বললেন, ‘হক সাহেবের সাথে কথা বল। সে তো ভীষণ ব্যস্ত তোমার সাথে কথা বলার জন্য।’
আমি বললাম দুলাভাইকে দেন। ও পাশ থেকে ভেসে এলো সেই মধুরতার দরদি কণ্ঠ-‘হ্যালো’।
আমি তাঁর কণ্ঠস্বর শোনামাত্র কাঁদতে থাকলাম। কথা বলতে পারছিলাম না। তিনি আরো দুবার বললেন, হ্যালো... হ্যালো…। আমি সাড়া দিলাম।
সৈয়দ হক বললেন, ‘কাঁদতে নেই। আমি তোমাদের মাঝে ফিরে আসব। তোমার প্রাচ্যসংঘ কেমন চলছে? ছেলেরা সাহিত্যচর্চা করছে?’
আমি বললাম, ‘চলছে’।
সৈয়দ হক বললেন, ‘তুমি অনেক বড় কাজ করেছ। খেয়াল রাখবে অনেকেই এটাকে পার্টিজান করে ফেলতে চাইবে। সতর্ক থাকবে।’
এই একই কথা সৈয়দ হক আরো একবার বছরখানেক আগে যশোরের সার্কিট হাউজে বসে নিভৃতে আমাকে বলেছিলেন।
ফোনে সৈয়দ হক বললেন অনেক কথা। এমন কী শরীরের যত্ন নিতেও বললেন আমাকে। সর্বশেষ যশোরে মাইকেল মেলায় এসে প্রাচ্যসংঘে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন। যশোর এসে একদিন ফোনে বললেন, ‘চল, ঘুরে আসি, রেডি হও।’
আমি রেডি হতেই আপাকে সাথে নিয়ে কালো মাইক্রোতে চলে আসেন আমার বাড়িতে। কথা প্রসঙ্গে নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন। যশোর শহরের লোন অফিসপাড়ায় সম্মিলনী স্কুলের পাশে তিনি একটি দুতলা বাড়ি করবেন।বাড়ির রং হবে লাল। এখানে তিনি থাকবেন। তার স্বপ্ন এবং নানা পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললেন। তিনি রসিকতা করে বললেন- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যশোরের জামাই। আমিও যশোরের জামাই।’
লোন অফিসপাড়া থেকে নিয়ে গেলেন মুড়লী কসবা। সেখানে একখণ্ড জমি দেখালেন। এইটা বিক্রি করে লোন অফিসপাড়ার লাল দালানটি বানাবেন। সেখান থেকে চাঁচড়া হয়ে তিনি নিয়ে আসলেন ধর্মতলা মোড়ে। এখানে এক চায়ের দোকানে তিনি আমাকে নামালেন। বললেন, ‘তোমাকে বিশেষ চা খাওয়াব।’
আমি অবাক। যশোরের লোক হয়ে জানি না এখানে বিশেষ ধরনের চা পাওয়া যায়। খেয়ে দেখি সত্যিই একদম আলাদা ধরনের চা। এক কাপ চা নিল ২৫ টাকা। বুঝলাম সৈয়দ হক যে গল্পকার! যশোরের ধর্মতলা মোড়ে চায়ের খবর তো তিনি রাখবেনই। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে এলেন কারবালা কবরস্থানে। এখানে স্বজনদের কবর জিয়ারত করলেন। কারবালার ইতিহাস বললেন- ডিটেইল। এখান থেকে দুপুরে চুড়িপট্টিতে তাঁর শ্বশুরালয়ে নিয়ে গেলেন। খাওয়ালেন। সেদিন কত কথা হলো! এসব নিয়ে অন্য একদিন লিখব সময় সুযোগ করে।
মাঝে-মধ্যে হক ভাই ঢাকা থেকে ফোন দিতেন। গেল বছর তাঁর জন্মদিনে ফোন দিয়ে বললেন, ‘বেনজীন তুমি আসবে না?’
বললাম, ‘আসছি তো! রাস্তায়।’ সাথে নিলাম ২৫০ টাকা দামের একটা চকলেট আর ফুলের ছোট্ট তোড়া। পৌঁছে তাঁকে ফুলের তোড়া দিলাম। আর বললাম, ‘কেবল জন্মেছেন সেজন্য চকলেট! খুব খুশি হলেন।’
সুযোগ পেলেই ফোন দিয়ে চলে আসতেন প্রাচ্যসংঘে। তাঁর আলোয় ঝলকিত হতো প্রাচ্যসংঘ। ছোট-বড় সবশ্রেণির সদস্যকে নিয়ে তিনি জমিয়ে তুলতেন আড্ডা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাইব্রেরির ২৫-৩০ হাজার বইয়ের প্রায় সবই যেন তিনি দেখতেন।
নদীর ওপর ঝোঁক বুঝতাম সৈয়দ হকের। এখানে এলেই নদী সম্পর্কিত বই কিনতেন তিনি। মুঘলদের ইতিহাস বারবার দেখতেন।
সৈয়দ হক যখন লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন, তখন আমি কলকাতায়। একটা অনলাইনে দেখলাম সংবাদ-‘চিকিৎসা অসফল। দেশের পথে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক।’ এ সংবাদে আমি আমার অনুভূমি জানালাম লিখে-‘অনাদি শিল্পীর করকমলে প্রার্থনা, একজন কবির জন্য! একজন শিল্পীর জন্য আরাধনা!’
দেশে ফিরে এসে ভেবেছি কবিকে দেখতে যাব ঢাকায়। গতকাল মঙ্গলবার গল্পকার পারভেজ হোসেন ফোনে বললেন, ‘ঢাকা আসেন খান সাহেব। হক ভাইকে একসাথে দেখতে যাব। বললাম, ‘তিন-চারদিনের মধ্যেই আসছি।’ কিন্তু হায়! দুর্ভাগ্য আমার-আমি সে সুযোগ চিরতরে হারিয়ে ফেললাম।