অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ডিলানের গান

পুরো নাম রবার্ট এলেন জিমারম্যান। জন্ম ২৪ মে ১৯৪১ সালে। তিনি একজন কিংবদন্তিতুল্য গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। আমেরিকার লোকসংগীতকে যিনি সাধারণ মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। শুধু একজন সংগীতশিল্পী হিসেবেই নন, একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে ডিলানের অবস্থান ছিল সব অন্যায়ের বিপক্ষে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং শরণার্থীদের তহবিল সংগ্রহের জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। এ বছর সাহিত্যে নোবেলজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয় ডিলানকে, তাঁর সংগীতের শক্তিশালী গীতিকবিতা রচনার জন্য। এই ঘোষণার পরপরই ডিলানকে নিয়ে একটি লেখার মাধ্যমে নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম পথিকৃৎ কবীর সুমন। তিনি একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।
বব ডিলানের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ অক্টোবর ভারতের পত্রিকা ‘হিন্দুস্থান টাইমসে’ প্রকাশিত হয় কবীর সুমনের এই লেখাটি। সেখান থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন হাসনাত শোয়েব।
বব ডিলান কথার দিক থেকে সহজ হলেও তাঁর অনুভূতির প্রকাশ অসামান্য। তিনি সব সময় আমাকে শতবর্ষের বাঙালি সংস্কৃতির বাউল গায়কদের কথা মনে করিয়ে দেন, যারা সহজ কথার মাধ্যমে গভীর দার্শনিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। বব ডিলানকে তাঁর যথোপযুক্ত সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সাধারণ অর্থে একজন সাহিত্যিক না হয়েও তিনি কাব্যগুণ সংবলিত একজন প্রেরণাদায়ক গীতিকবি। তার এই প্রাপ্তির আনন্দ আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
আমার আরেক প্রিয় গীতিকবি রবীন্দ্রনাথের নোবেলজয়ের ১০০ বছরেরও বেশি সময় পর আর কেউ এই নোবেল স্বীকৃতি পেলেন। যাঁরা দুজনই আমার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছেন। আমি পিট সিগারের সঙ্গে একই মঞ্চে গানবাজনা করার সুযোগ পেলেও ডিলানের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু আমি কখনো আমার জীবনে তাঁদের প্রভাব অস্বীকার করতে পারব না। একজন সমগোত্রীয় গীতিকার হিসেবে- যদিও মানের দিক থেকে নিম্নতর হয়েও ডিলানের লিরিকের এই স্বীকৃতিতে আমি গর্ব বোধ করি। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, ১৯৭৩ সালের সেই দিনটির কথা, যেদিন আমি এক বন্ধুর কাছে প্রথম ডিলান শুনেছিলাম। গানটি ছিল ‘এ হার্ড রেইনস গনা ফল’, যা আমাকে একই সঙ্গে হতভম্ভ ও বিস্মিত করেছিল। কণ্ঠটা তেমন ভালো লাগেনি বরং অনেকটা ‘অশিল্পীসুলভ’। কিন্তু গানটির দৃশ্যকল্প ছিল সরল, শক্তিশালী, কাব্যিক এবং অনন্যসাধারণ। যা আমাকে হতচকিত করে দিয়েছিল। তাঁর লিরিক গতানুগতিক আমেরিকান লিরিক নয় অথবা নির্দিষ্ট একটি রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এসব লিরিকের আবেদন বিশ্বজনীন। তাঁর আগমন বিশ্বের নানা বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ; পৃথিবীজুড়ে সবকিছু অতিদ্রুত বদলে যাচ্ছিল। এবং ডিলান সেই করাল সময়ের প্রেক্ষিতে উপযুক্ত ভাষাটি খুঁজে পেয়েছিলেন। ডিলানের এই সারল্য আমাকেও আমার লোকসংস্কৃতির শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল। এমনকি এখনো যখন আমি ডিলান শুনি, তা আমাকে কেবল মানবিক অনুভূতি এবং গুণাবলিকেই মনে করিয়ে দেয় না বরং কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ এবং ইউরেনিয়াম মাইনের ওপর বসবাস করা জাদুগোদা গ্রামের অধিবাসীদের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। ডিলানের গান যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারে।
এটা সত্য যে, ডিলান আমার গুরু নন, বরং আমির খানকে আমি অনেক বেশি মানি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বলিষ্ঠতা আমার কাছে সংগীতকে উপলব্ধি করার ও গ্রহণ করার সমস্ত দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছিল। কিন্তু ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলা গানের যে স্বর তা খুব কমই আলোড়ন তুলতে পেরেছিল। সে সময় যে কটি গান আমি রেকর্ড করেছিলাম তা আমাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ডিলান আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল মানসিক স্থবিরতা কাটিয়ে সেসব লিরিকে ডুবে যেতে, যা কিনা সব সময় আমার আরাধ্য ছিল।