স্মরণ
মনে পড়ে দীপন ভাই

ফেসবুকে সাধারণত কেউ আমাকে কিছু ট্যাগ করতে পারে না। ওয়ালটা লক করে রেখেছি। কেউ ট্যাগ করলেও সরাসরি ওয়ালে আসে না, টাইমলাইন রিভিউ অপশনে এসে জমা হয়। টাইমলাইন রিভিউতে ঢুকে আমি ট্যাগকৃত জিনিসগুলো দেখি। পছন্দ হলে অ্যাড টু টাইমলাইনে ক্লিক করে অ্যাড করি, অপছন্দ হলে হাইড করে দিই।
এখন, এ লেখাটি যখন লিখছি, আমার টাইমলাইন রিভিউতে দুটি ছবি দেখতে পাচ্ছি, যেগুলো ইচ্ছে করেই হাইড করিনি। ছবিগুলো ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ট্যাগ করা। করেছিলেন গুপ্তঘাতকের নিষ্ঠুর চাপাতির আঘাতে নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে দীপন ভাই, প্রকাশক খান মাহবুব, আমি এবং নাম-না-জানা আরো তিন অতিথি জনৈক কবির কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দর্শকদের উদ্দেশে বইটি প্রদর্শন করছি। দ্বিতীয় ছবিতে একজন বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে আমি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছি। দীপন ভাই ও খান মাহবুব ভাই আমার দুই পাশে দাঁড়িয়ে।
ছবিগুলো টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের অফিসে তোলা। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ আয়োজন করেছিল একটি অনুষ্ঠানের, যেখানে প্রধান অতিথি ছিলাম আমি, বিশেষ অতিথি দীপন ভাই এবং খান মাহবুব ভাই সভাপতি। সেদিন সকালে খান মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে আমরা টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হই একটি প্রাইভেটকারে চড়ে। কারটি ছিল দীপন ভাইয়ের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হকের। দীপন ভাইয়ের সাদা কারটি দূরযাত্রায় অনুপযোগী বলে সেটি নেননি।
আমরা যখন চন্দ্রা চৌরাস্তা পৌঁছাই. তখন দুপুর একটা কি দেড়টা। সকালে নাশতা করার সময় পাইনি বলে খুব খিদা পেল আমার। খাব বলে এক হোটেলে ঢুকলাম। গরুর মাংস ভুনাসহ ভাত অর্ডার দেওয়া হলো। টেবিলে খাবার আসা মাত্র মুহূর্ত দেরি না করে আমি খেতে শুরু করলাম। দীপন ভাই আমার খাওয়া দেখে মুখ টিপে হাসছেন। বললেন, খুব লেগেছে, না? জবাব না দিয়ে আমি গিলছি। এক প্লেট মাংস মুহূর্তেই সাবাড়। হোটেল বয়কে ডেকে দীপন ভাই বললেন আমাকে যেন আরো এক প্লেট মাংস দেওয়া হয়। নিজেও নিলেন বাড়তি এক প্লেট। আমি বললাম, ডায়াবেটিস নিয়ে আপনি আরো এক প্লেট মাংস খাবেন? বললেন, রাখেন তো ভাই ডায়াবেটিস! কদিন আর বাঁচব!
খাওয়া শেষ করে পরপর দুটি সিগারেট ফুঁকে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে এবার গাড়ি ড্রাইভ করছেন দীপন ভাই। খেয়াল করলাম, ড্রাইভারকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করছেন। ড্রাইভারকে কেউ আপনি সম্বোধন করে, ঢাকা শহরে খুব একটা শোনা যায় না। দীপন ভাই করতেন। শুধু ড্রাইভারকে নয়, তাঁর অধীন কর্মচারীকেও তিনি আপনি সম্বোধন করতেন। মনে আছে, আজিজ মার্কেটের নিচতলায় জাগৃতির সেলস সেন্টারে এক তরুণ চাকরি করতেন, নামটা ভুলে গেছি, প্রায় কুড়ি বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও দীপন ভাই তাকেও আপনি সম্বোধন করতেন। একদিন দীপন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা ভাই, কর্মচারীদের তো সাধারণত কেউ আপনি সম্বোধন করে না, আপনি করেন, কারণটা কী? উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, নেন, ধরান। বললাম, আপনি আমাকে আপনি করে সম্বোধন করছেন, এটাও কিন্তু আপত্তিকর। বললেন, শোনেন, আপনি লেখক, আমি প্রকাশক। লেখকদের সব সময় আপনি সম্বোধন করতে হয়। বললাম, আমি কি শুধু লেখক? আপনার ছোট ভাইও তো, তাই না? বললেন, তা হলেও আপনি একজন লেখক। ছোট ভাই সম্মানীয় হলে বড় ভাইয়ের উচিত তাকে যথাযথ সম্মান জানানো। বলেই অট্টহাসি দিলেন।
যাই হোক, বিকেল প্রায় সাড়ে চারটার দিকে আমরা টাঙ্গাইল পৌঁছাই। সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠান পাঁচটায়। এই অবসরে চলে গেলাম টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী চমচমের দোকানে। টাঙ্গাইল এসেছি, যাওয়ার সময় বিখ্যাত চমচম না নিয়ে গেলে কি হয়? দোকানে বসে তিনজনে মিলে চমচম খেলাম। বাড়ির জন্য আমি কিনলাম এক কেজি। দীপন ভাই কিনলেন প্রায় পাঁচ কেজি। ঢাকায় নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের দেবেন। চমচমের দাম পরিশোধের জন্য মানিব্যাগ বের করলে তিনি আমার দিকে অভিমানের চোখে তাকালেন। চোখের ভাষা ছিল এই : আমি থাকতে আপনাকে টাকা দিতে হবে কেন? মানিব্যাগ পকেটে ঢোকান!
তিনি এমনই ছিলেন। মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। তিনি যেসব খাবার অর্ডার দিতেন আমি সাধারণত সেসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। খেতে সংকোচ হতো। না জানি কত টাকা বিল হয়! বিল পরিশোধের সময় বলতাম, দীপন ভাই, আমিও কিছু শেয়ার করি? বলতেন, আরেক দিন কইরেন। কিন্তু সেই ‘আরেক দিন’ কখনো আসত না। বিল তিনি দিয়েই যেতেন আর আমি খেয়েই যেতাম।
আজিজ মার্কেটে গেলেই জাগৃতির অফিসে ঢুঁ মারতাম একবার। দীপন ভাই বলতেন, খালি হাতে এলেন, সিগারেট আনলেন না? আমি সোফায় হেলান দিয়ে বসলে পরে এয়ারকুলার ছেড়ে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিতেন আমার দিকে। বলতেন, আনলেন না যেহেতু এখান থেকে খান। প্যাকেটে সিগারেট না থাকলে নিজে গিয়ে নিয়ে আসতেন। সিগারেট টানা শেষ হলে বলতেন, বলেন কী খাবেন? বলতাম, কিছু না। বলতেন, চা তো খাবেন অন্তত। তরুণ শিশুসাহিত্যিক কাদের বাবু আজিজ সুপার মার্কেটের দোতলায় ‘বাবুই’ নামে একটা দোকান দিয়েছিলেন, যেখানে পাওয়া যেত একধরনের চা, লেমন-টি। প্রতি কাপের দাম বিশ টাকা। দোকানটা যতদিন চালু ছিল, জাগৃতির অফিসে গেলেই দীপন ভাই লেমন-টির অর্ডার দিতেন। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাসায় ফেরার জন্য আমি যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিতাম, টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতেন, এগুলা নিয়া যান। আমি কখনো নিতাম, কখনো নিতাম না।
২.
দীপন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ২০০৭-এর শুরুর দিকে। আমি তখন প্রয়াত নাট্যকার ড. সেলিম আল দীনের একান্ত সচিব। সেলিম স্যারের নৃত্যনাট্য ‘উষা-উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ’ এবং কথানাট্য ‘ধাবমান’ এ দুটি বই জাগৃতি থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা। স্যারের সঙ্গে দীপন ভাইয়ের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিক জব্বার হোসেন। বইয়ের অগ্রিম রয়্যালটি বাবদ দীপন ভাইয়ের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা সম্মানীও নিয়েছিলেন স্যার। কিন্তু বই দুটি প্রকাশের আগে, ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি সেলিম আল দীন আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে অসুস্থ স্যারকে যেদিন ধানমণ্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আনলাম, ফেরার পথে স্যার জানতে চাইলেন, জাগৃতির বই দুটি কি রেডি করেছিস? আমি বললাম, না, এখনো রেডি হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে হয়ে যাবে আশা করি। স্যার বললেন, দেরি করিস না, মেলার আর বেশি বাকি নাই। তাড়াতাড়ি রেডি করে দে।
স্যারের মৃত্যুর পর বই দুটি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই আমার কর্তব্য বলে মনে হলো। আমি পাণ্ডুলিপি দুটি দীপন ভাইকে মেইল করে পাঠিয়ে দিলাম। পরদিন জব্বার ভাইসহ জাগৃতির অফিসে এলে দীপন ভাই ‘ধাবমান’ পাণ্ডুলিপির একটা প্রিন্ট কপি আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ভালো করে দেখে দেন। স্যারের লেখাজোখার স্টাইলটা আপনি ভালো বোঝেন। প্রুফ রিডারকে দিলে ঝামেলা পাকিয়ে বসবে।
রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত জাগৃতির অফিসে বসে ‘ধাবমান’-এর প্রুফ দেখলাম, তবু শেষ হলো না। আমার বাসা তখন সাভার রেডিও কলোনি। এত রাতে বাসায় যেতে ইচ্ছে হলো না। কাল তো আবার আসতে হবে। চলে গেলাম মোহাম্মদপুরে জব্বার ভাইয়ের বাসায়। প্রায় সারা রাত জেগে ‘ধাবমান’-এর প্রুফ দেখা শেষ করি। দুপুরে যখন পাণ্ডুলিপিটি দীপন ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতে জাগৃতিতে এলাম, দীপন ভাই বললেন, আপনি দ্রুত একটা ভূমিকা লিখে দিন।
কিসের ভূমিকা? বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ধাবমানের। বললেন তিনি।
বললাম, দীপন ভাই, আপনি পাগল হলেন! সেলিম স্যারের বইয়ের ভূমিকা লিখব আমি? স্যার কবর থেকে উঠে এসে আমাকে জুতো দিয়ে পেটাবেন।
দীপন ভাই বললেন, দেখুন, স্যার এখন বেঁচে নেই। আপনি জানেন, বইটি প্রকাশের ব্যাপারে স্যারের সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট হয়েছিল। তাঁর অবর্তমানে বই দুটি প্রকাশের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব আমার। স্যারের একান্ত সচিব হিসেবে আপনারও একটা দায় আছে। সেই দায়বোধের জায়গা থেকে আপনি একটা ভূমিকা লিখে দিন।
আমি আর আপত্তি করলাম না। রাতে কম ঘুমিয়েছি বলে মাথাটা হালকা লাগছিল খুব, তাই বাসায় ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভূমিকাটা লিখতে বসি। হাত কাঁপছিল খুব। কারণ আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না সেলিম স্যার পৃথিবীতে নেই। কেবলই মনে হচ্ছিল এই বুঝি স্যার এসে আমার পেছনে দাঁড়ালেন। এই বুঝি জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখছিস ব্যাটা?
কাঁপা হাতে ‘কৈফিয়ত’ শিরোনাম দিয়ে লেখাটা শেষ করলাম। দীপন ভাইয়ের মেইলে পাঠিয়ে দিলাম রাতেই। প্রায় সাতদিনের মধ্যে বই ছাপা হয়ে এলো। বইটি হাতে নিয়ে বেজায় মন খারাপ হয়ে গেল। পাতায় পাতায় ভুল আর ভুল। অনেক যুক্তবর্ণ ভেঙে গেছে। ঘটনা কী? অনুসন্ধান করে জানা গেল কম্পিউটার অপারেটর আমার দেখা প্রুফ কপিটি সংশোধন না করেই ট্রেসিং ছেড়ে দিয়েছেন! আমার মন খারাপ দেখে দীপন ভাই বললেন, ছাপা তো হয়ে গেছে, এখন কী আর করা! পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে নেব। আমাকে এক কপি বই দিয়ে বললেন, এটিতে আপনি কারেকশন করে আমাকে আবার দেবেন, আমি সব ঠিক করে নেব। কারেকশন আমি শুরু করেছিলাম, প্রায় ৪৬ পাতা করেছিও, কিন্তু পরে নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় পুরো বইয়ের কারেকশন আর হয়ে উঠল না। দীপন ভাই মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করতেন কারেকশন করা বইটা কবে দেব। আজ দেব কাল দেব করে শেষ পর্যন্ত আর দেওয়া হলো না।
একই বছর প্রকাশিত হলো আমার প্রথম উপন্যাস ‘নাভি’। ঢাকা থিয়েটারের কর্মী বন্ধুবর ওয়াসিম আহমেদ ও সুমন ইব্রাহিম ‘ধাবমান প্রকাশ’ ও ‘বনলতা পাবলিকেশন্স’ থেকে যৌথভাবে বইটি প্রকাশ করলেন। ধাবমান প্রকাশ নামে কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আগেও ছিল না, এখনো নেই। শুধু আমার বইটি ছাপানোর জন্য ওয়াসিম ভাই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেলিম আল দীন স্যারের কথানাট্যের নামে ‘ধাবমান’ নামটি ব্যবহার করেছিলেন। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন বন্ধু দ্রাবিড় সৈকত। বইমেলার বহেড়াতলায় বনলতা পাবলিকেশন্সের একটা সিঙ্গেল স্টল আছে। বিক্রির জন্য কয়েক কপি বই স্টলে রাখা। স্টল থেকে একটা বই নিয়ে জাগৃতির স্টলে গেলাম দীপন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। বইটি তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, আমার প্রথম বই, আপনার জন্য। তিনি নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, কী করেছেন এটা! এটা কোনো বই হলো? এ কী যাচ্ছেতাই বাইন্ডিং! আপনি আমাকে বললেও তো পারতেন, আমি সুন্দর করে করে দিতাম।
যাই হোক, অটোগ্রাফ দেন। বললাম, অটোগ্রাফ লাগবে না। বললেন, আরে দেন তো ভাই! বইটি হাতে নিয়ে আমি লিখলাম, ‘আমার ভবিষ্যৎ প্রকাশক ও অভিভাবক ফয়সল আরেফিন দীপনকে, শুভেচ্ছাসহ।’
৩.
২০১০ সাল। এরই মধ্যে আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাস বেরিয়ে গেছে। একদিন আজিজ মার্কেটের নিচতলায় দীপন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে জাগৃতির অফিসে নিয়ে গেলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আপনার সম্পাদনায় বাংলাদেশের গল্পকারদের নিয়ে আমি একটি সংকলন করতে চাই।
আমি তো অবাক। এটা হয় নাকি! লেখক হিসেবে আমি একেবারেই নবীন। আমার সম্পাদিত গল্পের বই পাঠক কিনবে কেন? দীপন ভাই বললেন, নিজেকে এত ছোট ভাবেন কেন? আপনি ঔপন্যাসিক। আমি আপনার দুটি উপন্যাস পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়েছে সমকালীন গল্পকারদের গল্প নিয়ে একটি সংকলন আপনার সম্পাদনায় বের হলে খারাপ হবে না।
আমি বললাম, মোটেও ভালো হবে না। সম্পাদনা জ্ঞান আমার এখনো পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠেনি।
দীপন ভাই কোনো কথা শুনতে নারাজ। বললেন, আপনি কাজ শুরু করে দিন। আগামী মেলাতেই প্রথম খণ্ড বের করতে চাই।
নাছোড়বান্দার উৎসাহ পেয়ে আমি কাজ শুরু করে দিলাম। কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সারির গল্পকারদের গল্প সংগ্রহের কাজ শেষ হলো। সর্বজ্যেষ্ঠ গল্পকার আবুবকর সিদ্দিক থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ অদিতি ফাল্গুনী পর্যন্ত সবাই গল্প দিয়ে সহযোগিতা করলেন। গল্প দিলেন না শুধু একজন গল্পকার। বলতে গেলে তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না।
‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গল্প’ নামে সংকলনটি বেরিয়ে গেল ২০১১ সালের একুশে বইমেলায়। সংকলনের শুরুতে তিন পাতার সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় আমি দীপন ভাই প্রসঙ্গে লিখেছিলাম, ‘এ সংকলন মূলত জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের পরিকল্পনাজাত। একদিন বৈশাখের তপ্ত দাবদাহে সামান্য প্রশান্তি লাভে তাঁর কার্যালয়ে গেলে তিনি এ ব্যাপারে আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। সুতরাং এ গ্রন্থ প্রকাশের সব কৃতিত্ব বলা চলে তাঁরই। তাঁর প্রতি বেশুমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। প্রকাশক যদি সম্মত হন, তবে অচিরেই আমরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গল্পের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের কাজ শুরু করব।’
প্রকাশকের সম্মতি তো আছেই। পরের বছরই আমি সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ শুরু করে দিলাম। ‘বাংলাদেশের সমকালীন গল্প’ নামে বেরিয়ে গেল ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়। সংকলনের ভূমিকার শেষাংশে লিখেছিলাম, ‘অলাভজনক এই সংকলনটি প্রকাশ করার জন্য প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে আন্তরিক অভিনন্দন। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’
যাদের গল্প নিয়ে এই সংকলন, তাদের তো একটি করে দিতে হয়। সৌজন্য কপি। দীপন ভাইয়ের কাছে লেখক কপি চাইতে আমার বাধে। একদিন বললাম, দীপন ভাই, লেখকদের তো সৌজন্য কপি দিতে হবে। তিনি বললেন, মানা করল কে? আপনার যা ইচ্ছা নিয়ে যান। আর আগামী বছর আপনার উপন্যাস করতে চাই। যেটি লিখছেন, লেখা শেষ হলে আমাকে মেইল করে দেবেন। ভুল যেন না হয়।
কিন্তু ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি তাঁর এই অনুরোধটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ২০১২ সালে আমার ‘বেগানা’ উপন্যাসটি প্রকাশ পেল বিদ্যাপ্রকাশ থেকে। ২০১৩ সালে পরবর্তী উপন্যাস ‘হীরকডানা’ যথারীতি বিদ্যাপ্রকাশকেই দিলাম। একদিন পাবলিক লাইব্রেরি গেটে দীপন ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অথচ হায়, দীপন ভাই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে আরেকজনের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত! আমি তো রীতিমতো অপমান বোধ করতে লাগলাম। হলো কি দীপন ভাইয়ের। এমন আচরণ করছেন কেন তিনি আমার সঙ্গে।
কী ব্যাপার দীপন ভাই? বললাম আমি।
কই? কিছু না তো। বললেন তিনি।
কিন্তু পেটের কথা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলেন না। অভিমানের সুরে বললেন, আপনি ভাই বড় লেখক। আপনার কাছে আমার কি আর পাত্তা আছে?
আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আসল ঘটনা কী খুলে বলেন তো দীপন ভাই। আপনি রেগে আছেন কেন?
আপনি না বলেছিলেন এ বছর আমাকে বই দেবেন? কই, দিলেন না তো।
ও আচ্ছা, এই ঘটনা। আমি আপনাকে বই দেব বলেছিলাম? আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না ভাই।
মনে পড়বে কী করে? আমার মতো তুচ্ছ প্রকাশকের কথা বড় লেখকদের মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।
দীপন ভাই, আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। এ রকম হলে আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না।
এবার তিনি হেসে দিলেন। বললেন, আগামী উপন্যাস আপনি আমাকেই দিচ্ছেন, কথা কিন্তু পাকা। অন্য কাউকে কথা দিয়ে ফেলবেন না আবার।
আচ্ছা ঠিক আছে, দেব। প্রতিশ্রুতি দিলাম আমি।
কিন্তু সে বছর, অর্থাৎ ২০১৩ সালে, আমি উপন্যাস লিখে শেষ করতে পারলাম না। ‘কালকেউটের সুখ’ লেখার মধ্যে আছি, ২০১৪-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরের আগে লেখা শেষ হবে না। ২০১৩-এর শেষের দিকে কোনো এক দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার একটি গল্প ছাপা হলো। গল্পটি পড়ে দীপন ভাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। ফোন করে জানতে চাইলেন, উপন্যাস কদ্দূর? আমি আমার অপারগতার কথা জানালে তিনি বললেন, তাহলে একটা গল্পের পাণ্ডুলিপি গোছান। বিস্মিত হলাম আমি। দীপন ভাই অকারণে টাকা নষ্ট করতে চাচ্ছেন কেন? কে কিনবে আমার গল্পের বই? যে কটি গল্প লিখেছি সেগুলো আদৌ গল্প হয়েছে কি না আমি সন্দিহান। কিসের পাণ্ডুলিপি গোছাব। কিন্তু দীপন ভাই তা মানবেন কেন, তিনি গল্পের বই বের করবেনই, টাকাগুলো জলে যাবে জেনেও।
কী আর করা, সব কটি গল্প একত্রিত করে ঝাড়াই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা গেল বইতে অন্তর্ভুক্ত করার মতো গল্প আছে মোটে দশটি। এগুলো দিয়ে বই করলে বইটি হবে নির্ঘাত দুর্ভিক্ষকবলিত। প্রকাশকের বিনিয়োগকৃত টাকাটাও ঠিকমতো উঠবে না। পৃষ্ঠা তো আরো বাড়াতে হবে। কী করি? সাত-আট বছর আগে লেখা গল্প দুটিও বের করলাম। সেগুলোকে পুনর্লিখন করে দাঁড়াল তেরোটি। এরই ফাঁকে কোনো এক দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের চাপে আরো একটি গল্প লেখা হয়ে গেল। সাকল্যে এবার গল্পের সংখ্যা দাঁড়াল চৌদ্দটি। তার মধ্যে একটি গল্পের নাম ‘নিশিরঙ্গিনী’। গল্পটি লিখেছিলাম গল্পকার মণি হায়দারের অনুরোধে। তিনি বারবণিতাদের ওপর লেখা গল্প নিয়ে একটি সংকলন করবেন সেজন্য। যদিও সংকলনটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। গল্পটি আমি ছাপতে পাঠাই ‘কালি ও কলমে’। ছাপাও হলো। এই গল্পের নামানুসারেই প্রথম গল্পের বইটির নাম রাখলাম। চৌদ্দটি গল্পকে শেষবারের মতো সম্পাদনা করে, একজন প্রফেশনাল প্রুফরিডারকে দিয়ে একবার প্রুফ দেখিয়ে, প্রচ্ছদের ব্লার্বে দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা ভূমিকা লিখে পাঠিয়ে দিলাম দীপন ভাইয়ের মেইলে। ব্যস, আমার দায়মুক্তি ঘটে গেল। কদিন পর শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলি সুন্দর একটা প্রচ্ছদও করে দিলেন। ২০১৪-এর একুশে বইমেলায় বেরিয়ে গেল প্রথম গল্পের বই ‘নিশিরঙ্গিনী’।
৪.
২০১৪ সালের কথা। খ্যাতিমান গল্পকারদের প্রেমের গল্প নিয়ে একটা সিরিজ প্রকাশিত হচ্ছে জাগৃতি থেকে। দীপন ভাই আমাকে বললেন সৈয়দ হক, হাসান আজিজুল হক ও শওকত আলীর সঙ্গে যেন এই ব্যাপারে যোগাযোগ করে তাঁদের পাণ্ডুলিপির ব্যবস্থা করে দিই। কিন্তু তাঁরা কি আমার কথা রাখবেন? কত বড় লেখক তাঁরা। দীপন ভাই বললেন, শুনবেন, আমি জানি তাঁরা আপনাকে খুব স্নেহ করেন।
কী আর করা, শুরু করে দিলাম যোগাযোগ। সৈয়দ শামসুল হককে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে সক্ষম হলাম। তিনি অমত করলেন না। বললেন, গল্পগুলো তুমি বাছাই করো, আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে।
সৈয়দ হকের গল্পসমগ্র সংগ্রহ করে দিলেন দীপন ভাই। সমগ্রের সব কটি গল্প পড়ে প্রেমের গল্পগুলো বাছাই করে দীপন ভাইকে দিলাম। দীপন ভাই সেগুলো কম্পোজে দিয়ে দিলেন। এরই মধ্যে একদিন হক ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম যে আমরা তাঁর বাসায় যেতে চাই। তিনি অনুমতি দিলেন। তবে যেতে হবে সকাল আটটায়। কিন্তু আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারি না। দীপন ভাইকে বললাম, আপনি একাই যান বরং, আমার যাওয়ার দরকার নেই। দীপন ভাই গেলেন। হক ভাইয়ের বাসায় গিয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, আমি চেকবই নিয়ে এসেছি সাথে করে। হক ভাইকে কত টাকা দেব? বললাম, দশ হাজার দিন আপাতত।
কদিন পর হাসান আজিজুল হক ও আল মাহমুদের গল্পসমগ্রও সংগ্রহ করে দিলেন। এ দুজনের প্রেমের গল্পগুলোও আমাকেই বাছাই করতে হবে। শুধু বাছাই নয়, দুজনের ভূমিকাও লিখতে হবে আমাকে। ভারি তো বিপদ! এমন দুই মহারথীর বইয়ের ভূমিকা আমি লিখব, এটা হয় নাকি? দীপন ভাই বললেন, কেন হবে না? তারাই তো বলেছেন আপনার কথা। আমার বিশ্বাস হলো না। আমি আল মাহমুদের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। হাসান স্যারের সঙ্গেও ফোনে কথা বললাম। তাদের বইয়ের ভূমিকা সত্যি আমাকে লিখতে হবে কি না, জানতে চাইলাম দুজনের কাছে। দুজনই বললেন ভূমিকা যেন আমি লিখি। ফলে দুটি বইয়ের ভূমিকা আমাকেই লিখতে হলো।
২০১৫ সালের জানুয়ারির এক রাতে, প্রায় সাড়ে আটটার দিকে কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর হাটখোলার বাসায় গেলাম দীপন ভাইসহ। স্যার দরজা খুললেন। ভেতরে গিয়ে বসলাম আমরা। সিঁড়ি বাইতে পারেন না বলে এখন তিনি চারতলা বাড়ির নিচতলায় থাকেন। অগোছালো ঘর। জানালার শিকে, দরজার পাশে, দেয়ালে, এখানে-ওখানে অসংখ্য পোটলা-পুঁটলি টাঙানো। খাটের ওপর ওষুধের বাক্স। বইগুলোতে ধুলোবালি জমে কালো হয়ে গেছে। স্যার স্মৃতি তো হারিয়েছেনই, সেই সঙ্গে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস তো আছেই।
স্যার বললেন, আদেশ করুন।
আমি বললাম, আদেশ তো স্যার আপনি করবেন, আমরা কী আদেশ করব?
না বলছি, আপনাদের জন্য কী করতে পারি সেই আদেশ করুন।
কিছুই না স্যার, এমনি দেখা করতে এলাম। দীপন ভাই আপনার দুটি বই প্রকাশ করেছেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে?
না, স্যার মনে করতে পারলেন না কোন দুটি বই জাগৃতি থেকে বেরিয়েছিল। কিচ্ছু মনে নেই তাঁর। স্মৃতি হারিয়েছেন। কথার একপর্যায়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি স্বকৃত নোমান, না? স্বকৃত নোমান...। আচ্ছা, তোমার নাম স্বকৃত কেন? কে রেখেছে নামটা?
বললাম, আপনাকে আমি অনেকবার বলেছি নামটা সেলিম আল দীনের রাখা। কেন বলতে পারব না। এর পেছনে আমার কোনো হাত ছিল না। আপনি ভুলে গেছেন স্যার।
কি জানি বাবা, মনে নেই। সেলিম কেমন আছে?
স্যার, তিনি তো সেই কবেই চলে গেছেন।
ওহ, কিছুই মনে রাখতে পারি না।
আমি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, জীবনের কাছে মানুষ কত না অসহায়। বার্ধক্য কত না নিষ্ঠুর। যত বড় লেখকই হোন না কেন, বার্ধক্যের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। জানালার তাকে রাখা একটা বয়াম থেকে বিস্কিট বের করে খেতে দিলেন আমাদের। বললেন, এই খেয়ে নাও। আমি মরে গেলে লিখো, শওকত আলী তার বয়াম থেকে বিস্কিট খাইয়েছিলেন।
বললাম, তথাস্তু স্যার।
তারপর আমি প্রস্তাব দিলাম জাগৃতি থেকে তাঁর প্রেমের গল্পের একটি সংকলন বের করার কথা। স্যার বললেন, শওকত আলী কি প্রেমের গল্প লিখেছে কখনো?
বললাম, সেই অর্থে না স্যার, আপনার একটি বই আমরা করতে চাই। কিন্তু নতুন পাণ্ডুলিপি তো নেই, তাই প্রেমের গল্প নাম দিয়ে পুরোনো লেখাগুলোই ছাপব।
স্যার বললেন, ছাপো, আমার আপত্তি নাই।
দীপন ভাই সঙ্গে চেকবই নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা পাতা ছিঁড়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, দশ হাজার টাকা লিখুন। দীপন ভাই তাই করলেন। চেকটি স্যারকে বুঝিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। মনে আছে, সেদিন তিনি আমাকে ফার্মগেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সেই সাদা গাড়িতে করে।
২০১৫ সালে জাগৃতি থেকে প্রকাশিত হলো আমার ‘কালকেউটের সুখ’ উপন্যাসটি। আগের বছরের ডিসেম্বরেই আমি পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করি দীপন ভাইয়ের কাছে। নিজ উদ্যোগে প্রচ্ছদ করিয়ে নিই শিল্পী আমজাদ আকাশকে দিয়ে। প্রচ্ছদটি দীপন ভাই পছন্দ করলেন না। প্রচ্ছদটি তাঁর মনমতো হয়নি। তিনি অন্য একজন শিল্পীকে দিয়ে আরেকটি প্রচ্ছদ করিয়ে নিতে চান। কিন্তু আমার জোর আপত্তিতে তিনি আমার প্রচ্ছদটিই রাখলেন শেষ পর্যন্ত। বললেন, সেকেন্ড অ্যাডিশনে প্রচ্ছদ অবশ্যই চেঞ্জ করব। আমি আপত্তি করলাম না।
একুশে বইমেলার শুরুতেই ‘কালকেউটের সুখ’ প্রকাশিত হলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে বছর একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিল বাংলা একাডেমি। প্রকাশক রিয়াজ খানকে একটি দুষ্টচক্র নানাভাবে হুমকি দিতে লাগল। এসব হুমকির প্রতিবাদে এবং মেলায় রোদেলার স্টল খুলে দেওয়ার দাবিতে আমি ছিলাম মুখর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্টল খুলতে দিল না একাডেমি। মেলার শেষের দিকে এসে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আমার ‘কালকেউটের সুখ’ নিয়ে অপপ্রচার শুরু করল। এই উপন্যাসে নাকি ধর্মবিরুদ্ধ কথা আছে। শুনে তো আমি থ! ফেসবুকের স্পন্সর পেইজে, বিভিন্ন ব্লগে আমার বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করল একটি চক্র। একটি স্পন্সর পেজ থেকে আমাকে হত্যা, জাগৃতির অফিস এবং আমার উপন্যাসটির অনলাইন বিক্রেতা রকমারি.কম-এর অফিস জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে লাগল। ফেসবুকে ও ব্লগে আমার মোবাইল নম্বর প্রচার করে দেওয়ায় বিভিন্ন নম্বর থেকে আমার নম্বরে ফোন আসতে লাগল। আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে লাগল। বিরক্ত হয়ে আমি ফোনটি বন্ধ করে দিলাম। দীপন ভাই আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, বাদ দিন এসব। আপনি কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মানুষ নন, আমি জানি। আপনি এ বিষয়ে কোনো কথাই বলবেন না। চুপচাপ থাকেন।
৫.
৩১ অক্টোবর ২০১৫। এরই মধ্যে বিস্তর স্মৃতি জমা হয়ে গেছে দীপন ভাইয়ের সঙ্গে। শনিবার ছিল সেদিন। সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ সম্পাদক আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন আরিফুর রহমান দোলন ভাই সেদিন দুপুরে আমার বাসায় এলেন। তিনি আসতে আসতে প্রায় চারটা বেজে গেল। এরই মধ্যে ফোনে খবর পেলাম শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষে প্রিয় আরিফ ভাই চলে গেলেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে বাসায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ ফোন করে জানালেন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে খুন করেছে গুপ্তঘাতকরা।
দ্রুত কম্পিউটার অন করলাম আমি। বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে ক্লিক করতে লাগলাম। কোথাও দীপন ভাই আক্রান্ত হওয়ার নিউজটি নেই। দ্রুত আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। কতক্ষণ হেলান দিয়ে বসেছিলাম জানি না। একটা সময় খেয়াল করি আমার উদোম বুকটা ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। আমি কি কাঁদছি? আমার স্ত্রী নাজু চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো জোরে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার তখন মনে হলো, পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেছে। পৃথিবীতে আমার মতো অসহায়, আমার মতো বিপন্ন, আমার মতো দুঃখী মানুষ আর কেউ নেই।
২৭ মে, ২০১৬। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘কালকেউটের সুখ’ উপন্যাসটির জন্য আমাকে সেদিন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হলো। আমি যখন পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ব্যক্ত করতে মঞ্চে উঠলাম, আমার মনে হলো, দর্শকদের মধ্যে কোথাও চুপিসারে বসে আছেন বইটির প্রকাশক, আমার বন্ধু, আমার ভাই ফয়সল আরেফিন দীপন। আমার চোখ তাঁকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু যখন বুঝতে পারি, দীপন ভাই এই পৃথিবীর কোথাও নেই, আমি তখন কাঁপতে থাকি। আমার গলা ধরে আসে। কান্নার ধকলে আমার কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যায়।
প্রিয় দীপন ভাই, সেদিন এই পুরস্কার আমি আপনার নামে উৎসর্গ করেছিলাম। আপনি বেঁচে থাকলে সেদিন বিকেলে নিশ্চয়ই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জাগৃতির অফিসে টেনে নিয়ে যেতেন। সোফায় বসিয়ে এসিটা ছেড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে ধরে বলতেন, নেন, ধরান।