জন্মদিনে স্মরণ
চন্দ্র ও বৃষ্টিবিলাসী হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ। জন্ম আজকের দিনে, অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮। বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ছায়া সুনিবিড় প্রত্যন্ত কুতুবপুর গ্রামে বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের কোলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থানের বিভিন্ন এলাকার নাম বারবার তাঁর লেখার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। ছেলেবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল কাজল। তাঁর বাবাও একজন লেখক ছিলেন। বিশিষ্ট লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব তাঁর ছোট দুই ভাই।
হুমায়ূন আহমেদ সিলেটের একটি স্কুল দিয়ে শুরু করেন। তার পর পুলিশ অফিসার বাবার বদলিজনিত কারণে সারা দেশের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর ও বগুড়ায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। সে জন্য তিনি সর্বশেষ বগুড়া জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৬৭ সালের এইচএসসি পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে ডিস্টিংশন নিয়ে অনার্সসহ এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পর তিনি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। সেখানে মাত্র ছয় মাস থাকার পরই তিনি চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর গবেষণা করে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। সে সময় থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। প্রথমেই প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। সেই প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ এত বেশি পাঠকনন্দিত হয় যে তার পর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
একটার পর একটা উপন্যাস লিখে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যেতে থাকেন। বর্তমানে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক, যার সবকটিই দেশে সর্বাধিক বিক্রীত। তিনি জনপ্রিয় উপন্যাসের পাশাপাশি লেখা শুরু করেন জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল। টিভি সিরিয়াল লিখতে শুরু করার একটি অদ্ভুত গল্প রয়েছে। ঢাকা শহরে থাকা মধ্য আয়ের একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকের বাসায় তখন একটি রঙিন টেলিভিশন ছিল না। বাসায় একটি রঙিন টেলিভিশন কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য বিটিভির ফরমায়েশে তিনি টিভি নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন। সেভাবেই তিনি টিভি নাটকে সৃষ্টি করেন অন্য রকম ধারা। সে সময় তাঁর নাটকগুলো এমন দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তখন নাটক শুরু হলে রাস্তায় কোনো মানুষ থাকত না। মির্জা, মিয়ার বেটা, বদি, বাকের ভাই ইত্যাদি তাঁর সৃষ্ট অনবদ্য স্মরণীয় চরিত্র। অন্যদিকে উপন্যাস লিখতে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন মিসির আলী কিংবা হিমুর মতো ব্যতিক্রমধর্মী মজার মজার চরিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সমাজসেবী, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, চিত্রকর, চিত্রনাট্য লেখক, নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রবন্ধকার ইত্যদি। তাঁর একটি সহজ-সরল মন ছিল, যা সহজেই পাঠককে নাড়া দিত। যেকোনো একটি স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনাকে তিনি তাঁর কলমের খোঁচায় অসাধারণ হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন। আমাদের চোখের সামনে যা ছিল স্বাভাবিক, তাই ছিল মূলত তাঁর লেখার কাঁচামাল। তিনি যেকোনো বিষয়কে খুব সাবলীল ভাষায় পাঠক ও দর্শকনন্দিতভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। সে জন্যই তিনি ছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক। সেটাই ছিল হুমায়ূন আহমেদের বিশেষত্ব, স্বাতন্ত্র্যবোধ, আলাদা বৈশিষ্ট্য। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে চাঁদের আলো, পূর্ণিমার চাঁদ, বৃষ্টি, বর্ষা, প্রকৃতি ইত্যাদি পছন্দ করতেন। তাঁর লেখায়ও বারবার এগুলো সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। তাই সেগুলো পছন্দ করার কারণে তিনি সময়মতো উপভোগ করার জন্য নিজে থেকেই সুযোগ সৃষ্টি করে নিতেন। তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে এমনও শোনা গেছে যে যখন তিনি পুরোপুরি কাজের ভেতর ডুবে থাকতেন, তখনো যদি চাঁদের জোছনা দেখার সুযোগ হতো, ঠিক তখনই হঠাৎ সেই সেট গুটিয়ে সবাইকে নিয়েই জোছনা উপভোগ করার জন্য চলে যেতেন। আবার বৃষ্টির জন্যও ঠিক একই কাজ করতেন বলে জানা গেছে। আর সে জন্যই তাঁর অনেক লেখায়, গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে এগুলোর প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
‘চন্দ্রকথা’, ‘আমার আছে জল’ ইত্যাদি নামে একাধিক চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন তিনি। একই শিরোনামে গানও রচনা করেছেন, যেমন—‘ও কারিগর দয়ার সাগর ওহে দয়াময়, চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’, ‘আমার আছে জল, আমার আছে জল’ ইত্যাদি। প্রত্যেক সাহিত্যিকই তাঁর সৃষ্ট কিছু চরিত্রের মধ্যে অজান্তে হলেও নিজের চরিত্রকেই ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। আর হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভ্রমণপ্রিয়তা, বিচিত্র খাবার বিলাসিতা, বৃষ্টি বিলাসিতা, জোছনা বিলাসিতা, সৌন্দর্য বিলাসিতার ‘মধুর পাগলামি’ যে মিসির আলী কিংবা হিমুর মাধ্যমে সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। সে ধরনের শখের ও ‘মধুর পাগলামি’ তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রে লক্ষ করা গেছে।
‘বিলাস’ শব্দটার প্রতিও ছিল তাঁর অন্য রকম একটি দুর্বলতা। সে জন্য আমরা দেখেছি, তিনি সেন্টমার্টিনে জায়গা কিনে অবকাশকেন্দ্র তৈরি করে সেখানে ‘সমুদ্রবিলাস’ নাম দিয়েছেন। গাজীপুরের অদূরে একসঙ্গে অনেক জায়গা কিনে সেখানে তিনি নিজের থাকার জন্য যে ‘নুহাশপল্লী’ সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে নিজের পছন্দমতো ‘বৃষ্টিবিলাস’, ‘জোছনাবিলাস’ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করেছেন। ১০ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের ৬৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আরটিভি আয়োজিত একটি লাইভ সংগীত ও আলোচনা অনুষ্ঠানে স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বলেছেন, ছেলেবেলায় হুমায়ূন আহমেদের মামার বাড়িতে কাজ করত আবদুল আউয়াল নামের এক লোক, তিনি লেখককে প্রায়ই গল্প শোনানোর সময় প্রতিটি গল্পেই ‘চান্নিপসর রাইতের’ কথা দিয়ে শুরু করতেন। তা ছাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া একজন মানুষের চাঁদের আলো, বৃষ্টি ইত্যাদির প্রতি বাড়তি আসক্তি থাকতেই পারে। সেটারই প্রতিফলন হয়তো লক্ষ করা গেছে হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে। তিনি সবকিছুতেই ব্যতিক্রম কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বাংলা টেলিভিশন নাটকে, মঞ্চনাটকে, চলচ্চিত্রে দর্শক ও পাঠক সৃষ্টি করেছেন। বাংলা সাহিত্যের পর্বতসম জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিককে ৬৮তম জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।