হুমায়ূন আহমেদের বৃক্ষ ভুবন

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ততদিনে নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লীর ঔষধি বাগানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আমারও খুব ইচ্ছে হলো বাগানটি ঘুরে দেখার। জনপ্রিয় কার্টুন ম্যাগাজিন উন্মাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই নুহাশপল্লীতে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো, অনুমতি মিলল বাগান দেখার। কারণ উন্মাদের সম্পাদক প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই।
অনুমতি তো পাওয়া গেল কিন্তু কবে, কখন, কীভাবে যাব? শেষমেশ একটা দিন ঠিক করা হলো। যতদূর জেনেছি, নুহাশপল্লী মানেই পল্লী। সেখানে যেতে অনেকটাই কাঁচাপথ। নিভৃত পল্লী। একজন লেখকের একান্তে ডুব দেওয়ার মতো যতটা নির্জনতা প্রয়োজন, ততটাই নাকি আছে সেখানে। সবকিছু মিলিয়ে লোভনীয় একটি স্থান।
নুহাশপল্লী যাওয়ার দিন সঙ্গে নিলাম দুই বন্ধুকে। বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গাজীপুর চৌরাস্তা পেরিয়ে আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে বাঁ-দিকে গেলাম। বিক্ষিপ্ত শালবনের ভেতর অনেকটাই নির্জন পথ। একসময়ের ঘন শালবন কেটেছেঁটে অনেক দরদালান উঠেছে। বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এই শালবনগুলোর মালিকানা কার অথচ কে বিক্রি করল সেটা এখনো এক রহস্য। শুধু এখানেই নয়, পুরো গাজীপুর এবং টাঙ্গাইলের সব শালবন উজাড় হলো কিছু মানুষ ধনী হবে বলে। হারিয়ে গেল আমাদের এক বিশাল ঐতিহ্য। যাই হোক, কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের থামতে হলো। কারণ গাড়ি আর যাবে না। সামনে বাকি পথ হাঁটু সমান কাঁদা। রিকশা চলারও কোনো উপায় নেই। একটা রিকশা ঠেলে নিতে দুজন লাগে। কাঁদা দেখে আমার ব্যবসায়ী বন্ধু গাঁইগুই শুরু করল। আমি বললাম এসেছ পল্লী দেখতে, সুতরাং ধুলো কাদা থাকবেই, এ নিয়ে কথা বলা যাবে না। তা ছাড়া সুন্দর কিছু দেখতে হলে তোমাকে কিছুটা কষ্ট স্বীকার করতেই হবে। আমার লেকচার শুনে বন্ধু আর মুখ খোলার সাহস পেল না।
আমরা প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। নুহাশপল্লী পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে এলো। ভাদ্রের তালপাকা গরমে আমরা ঘেমে-নেয়ে একশা। চারপাশে সুনসান নীরবতা। ছায়াঘেরা মায়াময় প্রকৃতি। প্রধান ফটক পেরিয়ে ডানপাশেই সুইমিংপুল লাগোয়া ঘর। বাঁপাশে সবুজ ঘাসের লন। বিক্ষিপ্ত গাছপালা। বর্ষার দু-একটি মৌসুমি ফুলের রেশ তখনো বাগানকে আলোকিত করছে। আরেকটু আগালেই বৃষ্টিবিলাস। সেখানে শুটিংয়ের সেট ফেলা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে বাগানে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে জানানো হলো আমরা তাঁর প্রিয় ঔষধি বাগানটি দেখতে এসেছি। তিনি এক ঘণ্টার জন্য শুটিং বন্ধ রেখে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি এই ঔষধি বাগানটিকে কতটা ভালোবাসেন! বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে তিনি আমাদের সব কটি গাছ দেখালেন। কোন গাছটি কীভাবে কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন, কোন গাছে কী উপকার, আবার এই বাগানের উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ইত্যাকার কোনো তথ্যই আমাদের জানাতে বাকি রাখলেন না।
আমাকে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন এর নাম আইগা তিতা (সম্ভবত আঞ্চলিক নাম)। এ গাছের রস নাকি প্রচণ্ড তিতা এবং অনেক রোগের মহৌষধ। বাগানের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ঢালুতে লাগানো হয়েছে এলাচ। এলাচ ঝোপের পাশে আছে যষ্টিমধুর লতা। নুহাশপল্লীর ৪০ বিঘা জায়গার একাংশে ঢালু জায়গায় গড়ে ওঠা এই বাগানের সংগ্রহ একেবারে কম না। দণ্ডকলস, হাতিশুঁড়, বিষকাটালী, অগ্নিশ্বর, ভেরেণ্ডা, চিকরাশী, পান, শিয়ালমুর্তা, জয়ত্রী, আপাং, চালধোয়া, শ্বেতচন্দন, কল্পনাদ, কষ্টকারী, রক্তজবা, ওলটকম্বল, ধুতরা, বাসক, কর্পূর, আগর, রিঠা, পানবিলাস, নিশিন্দা, সর্পগন্ধা, অর্জুন, পুদিনা, তুলসী, আমলকী, নয়নতারা, রক্তকরবী, যজ্ঞ-ডুমুর, গন্ধভাদালী, টগর, জয়তন, বেত, মহুয়া, মেহেদি, কুমারিয়ালতা, বহেড়া, হরীতকী, দাদর্মদন, গিলা, গুলঞ্চ, ঝুমকোলতা, জয়ন্তী, তেলমাখনা, কলকে, সন্ধ্যামালতী ইত্যাদি। এখানে অন্যান্য গাছের তালিকাও বেশ সমৃদ্ধ। তিনি সব সময় চেষ্টা করেন কিছুটা অচেনা এবং দুর্লভ গাছগুলো সংগ্রহ করতে। বাগানের বাওবাব গাছটি দেখেই আতোয়া সাঁ এক্সুপেরির ‘লিটল প্রিন্সের’ কথা মনে পড়ল। গল্পের নায়ক লিটল প্রিন্স শুধু স্বপ্নই দেখে। আর বাওবাব নামের রাক্ষসী গাছ যার শত্রু হয়ে ওঠে—
‘ছোট রাজকুমারের আবাস, তার গ্রহে কিছু কিছু ভয়ঙ্কর বীজও উড়ে আসত, আর ওগুলো বাওবাব গাছের। গোটা গ্রহটি তাতে বোঝাই হয়ে গিয়েছিল। বাওবাব এমন জিনিস তাকে তড়িঘড়ি উপড়ে না ফেললে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন।’
মরু অঞ্চলের এই উদ্ভিদ প্রজাতিটি রমনা পার্কে আরো আগেই দেখেছি। এখানে দুটো অপরিণত গাছ দেখে ভালোই লাগল। এদের বয়স্ক গাছের মধ্যিখানে একসময় খোঁড়ল দেখা দেয়, তাতে জল জমে, কোনো কোনোটিতে ২৫০ গ্যালন পর্যন্ত। এরপর তিনি আমাকে মধুমালতীর ফুল দেখাতে নিয়ে গেলেন। তাঁকে জানালাম এ গাছের প্রকৃত নাম রেঙ্গুন ক্রিপার। রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন মধুমালতী। বিচিত্র প্রকৃতির এই অনিন্দ্য উদ্যানকে কীভাবে মূল্যায়ন করতেন হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর কাছ থেকেই শোনা যাক। ‘ধরুন কোনো এক অজপাড়াগাঁ— হাতের কাছে নেই ডাক্তার বা হাসপাতাল। প্রসব বেদনায় অস্থির কোনো নারী। অবস্থা সংকটাপন্ন। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন একটা মুহূর্তে নিজ বাড়িতেই ডেলিভারি সম্ভব। যদি রোগীকে সেবন করানো হয় একটি বিশেষ জংলি লতাগাছের কাণ্ড ছেঁচে একটুখানি রস। এ যেন জীবন্ত ক্লিনিক।’
সবশেষে আমাকে কয়েকটি গাছের নাম জিজ্ঞেস করলেন। সঠিক উত্তর দেওয়ার পর বললেন দশে দশ পেয়েছ। কারিপাতার দুটো গাছ নিয়ে ম্যানেজার বুলবুলকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখা গেল। বললাম দুটোই কারিপাতা, বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে নুহাশপল্লীর প্রথম সাক্ষাতে সেদিন অবশ্য একটি গাছ চিনতে পারিনি। পরে শনাক্ত করেছি, নাম হাড়গজা। শালবন অঞ্চলেরই গাছ। প্রচলিত স্থানীয় নাম আজবী গাছ।
দুপুরে আমাদের খাবারের কথা বলে তিনি আবার শুটিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমরা আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখলাম। এই বাগানের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে শালবনের ভেতর অনেকগুলো শটিফুল দেখে খুবই মজা পেলাম সেদিন। ঔষধি বাগানের গোড়াপত্তনের সময় তিনি একাধিক লেখায় তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। মূলত তখন (২০০৫ সালের দিকে) নুহাশপল্লীতে ঔষধি গাছ রোপণ নিয়ে একধরনের উৎসব আমেজ বিরাজ করত। তাঁর সহকর্মীরা যেখানেই কোনো ভেষজ গাছের সন্ধান পান অতি উৎসাহে তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এভাবেই বাড়তে থাকে বাগানের সংগ্রহ। অনেককেই তখন এই কাজে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ কোথাও কোথাও লিখেছেন, নুহাশপল্লীতে ঔষধি গাছ রোপণের ব্যাপারটি সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে।
২০০৫ সালে ‘আনন্দ আলো’র এপ্রিল সংখ্যায় প্রসঙ্গত তিনি বৃক্ষব্যাধি শিরোনামে নিজেই লিখেছেন-‘একদিনের ঘটনা বলি- নুহাশপল্লীতে উপস্থিত হয়েছি, দেখি কর্মচারীরা কেউ নেই। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সবাই কোদাল কাঁধে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেছে ঔষধি গাছের সন্ধানে। অবশ্য কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এখানে চারা এনে দিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে একজন সফল, জননন্দিত কথাশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর অবস্থান গগনস্পর্শী। আমি সে প্রসঙ্গে না গিয়ে শুধু তাঁর বৃক্ষ ভাবনা নিয়ে দু-চারটি কথা বলতে চাই। তিনি শুধু ঔষধি বাগান করেই দায়িত্ব শেষ করতে চাননি। তাঁর এই ভালোবাসার জগৎটি পাঠকের কাছেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে ১৬ মে ২০০৭ সাল থেকে অন্যদিন পত্রিকায় বৃক্ষকথা শিরোনামে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন।
এই লেখাগুলো পড়ে খুব সহজেই ভিন্ন এক হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করা যায়।
সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের এই লেখাগুলো পাঠ করে লেখকের আলাদা একটি সত্তাও অনুভব করা যায়। এসব লেখায় আছে লেখকের নিজস্ব ভাবনা, অনুসন্ধান, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং কোথাও কোথাও গভীর দর্শন। লেখকের সবচেয়ে বড় সফলতা তাঁর উপস্থাপনার কৌশল। আমরা জানি সাধারণত নিরস কিংবা ভারী বিষয়ের ওপর লেখা অনেক পাঠকেরই অপছন্দ। বৃক্ষ বিষয়ক লেখাও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি শুধু নিজ যোগ্যতায় এই প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গেছেন। লেখাগুলো গতানুগতিক ধারায় না রেখে সর্বজন পাঠ্য করেছেন। তাঁর ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কারণে লেখাগুলো বরাবরই স্বাদু হয়ে উঠেছে।
কাজটি অবশ্য তাঁর জন্য খুব একটা সহজ হয়নি। বৃক্ষবিষয়ক অসংখ্য বই তিনি গোগ্রাসে পড়েছেন। প্রতিটি লেখায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। আমাদের অজানা অনেক তত্ত্ব-তথ্য হাজির করেছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখা লোকগল্পগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বিখ্যাত কবিতাগুলোর অংশবিশেষ তুলে এনেছেন। সেই কালিদাসের মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। কিছু অভিনব তথ্য তিনি বেশ মজাদারভাবেই উপস্থাপন করেছেন। কদমফুল নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন- ‘কদম ফল যে রান্না করে খাওয়া হয়- এই তথ্য কি জানেন? আমি জানতাম না। নলিনীকান্ত চক্রবর্তী ত্রিপুরার গাছপালায় লিখেছেন, কদমের ফল রান্না করে খাওয়া হয়, তবে সহজে হজম হয় না। যারা বিচিত্র রান্নায় উৎসাহী, তারা রান্না করে দেখতে পারেন। হজমের দায়দায়িত্ব আপনাদের।’
এখানে কদম প্রসঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত মতামতও উদ্ধৃত হলো : ‘আমার মতে, কদম্বের সবচেয়ে বড় ভেষজ গুণ মন ভালো করে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা। পূর্ণ বর্ষায় এই গাছের নিচে দাঁড়ালে মনে হয়- আহারে! বেঁচে থাকাই আনন্দের। এই গাছের রোগ সারানোর কোনো প্রয়োজন নেই সে তার সৌন্দর্য নিয়েই ঝলমল করুক।’ আবার অসময়ে যে কদম ফোটে তাও লেখক জানাতে ভুলেননি। এটা তাঁর নিজস্ব অনুসন্ধান। বই থেকে ধার করা কোনো জ্ঞান নয়। সত্যিকার অর্থেও তাঁর কদমপ্রীতি ছিল। নুহাশপল্লীতে কয়েকটি কদম গাছ আছে। এসব লেখায় তিনি অনেক সাবলীলভাবে ভেষজ গাছগুলোর লৌকিক ব্যবহারের কথা বলেছেন। যদিও এসব ব্যবহারের কথা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু এখানে সহজভাবে উপস্থাপনের গুণে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে তাঁর পড়ার পরিধি দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। বেলের শরবত প্রসঙ্গে তিনি তিব্বিয়া হাবিবিয়া ইউনানী কলেজের হেকিম মাওলানা মো. মোস্তফার একটি রেসিপি দিয়েছেন। এই লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায় যে কাজগুলো মোটেই আরোপিত নয়, নিজের আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকেই তিনি করেছেন।
বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা একটি বড় স্থান দখল করে আছে। তিনি বলেছেন, ‘গাছপালা-বিষয়ক শুকনা (?) বিষয় নিয়ে আমার লেখাগুলি পাঠক-পাঠিকারা পড়ছেন বলে মনে হয় না। যারা পড়েছেন তাদের হয়তো ইতোমধ্যে ধারণা হয়েছে, ভেষজ বৃক্ষের ওষুধি গুণের উপর আমার অসম্ভব আস্থা। তা কিন্তু না।... একটা উদাহরণ দেই। ভেষজবিদদের সবাই আনারস খাবার পরে দুধ খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন।...আমি অনেকবার ভরপেট আনারস খেয়ে দুধ খেয়ে প্রমাণ করেছি তথ্যটা মিথ্যা।’
কোনো কোনো লেখায় তিনি অন্যদের লেখার কিছু ভুল বর্ণনার প্রকৃত তথ্য তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের লেখাগুলোতে নিজে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের কথাও লিখেছেন। বাজনা গাছ নিয়ে লিখেছেন- ‘গাছের নাম বাজনা। গাজীপুর অঞ্চলে এই গাছ প্রচুর দেখা যায়। গা-ভর্তি বড় বড় কাঁটা। দেখতে কিম্ভূতকিমাকার। নুহাশপল্লীতে বড় বড় বেশ কয়েকটা বাজনা গাছ ছিল। গাছের কোনোরকম গুণাগুণ কোথাও খুঁজে পাইনি বলে একটা গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে বললাম। কর্মচারীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তারা বলল এই গাছের বীজ ভাঙলে অতি সুঘ্রাণের তেল তৈরি হয়। ওই তেলে মুড়ি মেখে খাওয়া আর অমৃত খাওয়া না কি একই। আমি খেয়ে দেখেছি। ওয়াক থুর কাছাকাছি।’ এই হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। সরাসরি স্বাদটা চেখে নিয়েই মতামত লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। ভেষজ বাগান তৈরি কিংবা ভেষজ গাছগাছালি নিয়ে লেখালেখিও তাঁর আরেকটি ক্ষেত্র। এ বিষয়ে তাঁর কাজ চলমান ছিল। বাগানের সংগ্রহ যেমন ক্রমবর্ধমান ছিল, তেমনি এ বিষয়ে লেখালেখিও অব্যাহত রেখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বৃক্ষ এবং প্রকৃতি সাহিত্যেও তাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। এই জগতের মোহমায়া ত্যাগ করার আগেই তিনি ‘বৃক্ষকথা’ শিরোনামে বৃক্ষবিষয়ক একটি গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন। সমৃদ্ধ হলো আমাদের বৃক্ষবিজ্ঞান।
২০০৫ সালে নুহাশপল্লীতে তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর অনেকগুলো বছর। নুহাশপল্লীর অনেক পরিবর্তন দেখেছি স্বচক্ষে। ২০১২ সালের জুলাই মাস। তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাজির হলাম সেখানে। প্রকৃতিতে তাঁর প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। মাত্র কয়েকদিন আগে কদম ফুটেছিল। বর্ষার ফুলগুলো তাদের রঙের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তবু চারপাশে বিরাট শূন্যতা। সেদিন এই বাড়িটি যেন আক্ষরিক অর্থেই কাঁদছিল। তাঁর সন্তানতুল্য বৃক্ষগুলোও যেন বুঝতে পেরেছিল ওদের প্রিয় মানুষটি আর ফিরে আসবে না কখনো। আর কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে না, ডাল ছুঁয়ে একটু আদর করে দেবে না। না আর কখনো না।