নবান্ন
কৃষকের আনন্দ, সকলের উৎসব

এমন একটা দিন ছিল, যখন সামান্য বাতাসের দোলাতেই মন ভালো হয়ে যেত। শিস দিয়ে দোয়েল গেয়ে গেলে আপ্লুত হতো মন। কত দ্রুত সেসব দিন পাল্টে গেছে। একটা সময় পর্যন্ত এই পরিবর্তন ছিল ধীরগতি, আমাদের কিশোর বয়সটা হবে বোধ হয়। তার পর প্রতিদিন এর গতি বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। মানুষের মন ভালো করে দেওয়ার অঙ্গীকারে উদ্ভাবন হয়েছে কত কিছু। কিন্তু একটা দিন ছিল, সামান্য তালপাতার বাঁশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে ছোট ছেলেমেয়েরা। এখন তারা এত অল্পে আর খুশি হয় না। এমনকি গ্রামেও পৌঁছে গেছে আধুনিকতার নানা সরঞ্জাম। আর এর সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেছে আমাদের দেশি উপকরণ।
আধুনিক এন্টারটেইনমেন্টের নানা উপকরণে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্য। আমি অবশ্যই আধুনিকতার বিরুদ্ধে নই। এমনকি আজকের নাগরিকের হাতে আধুনিক সরঞ্জাম যাবে না, তা-ও বলতে চাই না। তবে তার আধিক্যে হারিয়ে যাবে আমার অস্তিত্ব—এ যেন মানা যায় না। কারণ, সামান্য এই সরঞ্জামের কারণে আমাদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি মুছে যেতে বসেছে। আর তার পথ ধরে পানসে হয়ে এসেছে আমাদের নানা পালা-পার্বণ। নবান্ন উৎসবের মতো পার্বণ হারিয়ে যাওয়াটা বেদনার। এতে জড়িত আমাদের অস্তিত্ব। মানুষের আদি ইতিহাসে খাদ্য আহরণটাই ছিল বোধ হয় সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ। আর ধান যেহেতু আমাদের প্রধান খাদ্য, সেহেতু সেটার আগমনে চারদিক মেতে উঠবে—সেটাই স্বাভাবিক। অনেকে ঈশ্বরকে স্মরণ করত ফসলপ্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমাদের দেশের আদিবাসীদের মধ্যে নবান্ন উপলক্ষে প্রচলিত আছে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা। তাদের উৎসবে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে থাকে নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান।
আমাদের সাহিত্যেও এর প্রভাব দেখা যায় প্রায়ই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় অনেক জায়গাতেই নবান্নের উল্লেখ আছে। যেমন তাঁর ‘আনুষ্ঠানিক’ পর্বের গানে আছে—‘আয়রে মোরা ফসল কাটি/মাঠ আমাদের মিতা ওরে, আজ তারি সওগাতে, মোদের ঘরের আঙন সারা বছর ভরবে দিনে রাতে/মোরা নেব তারি দান, তাই-যে কাটি ধান, তাই-যে গাহি গান, তাই-যে সুখে খাটি।’ মাটি আর মানুষের যৌথ শ্রমের ফলেই এ ফসল। এখানে বোধ হয় তাই মাটিকে মানুষের বন্ধু হিসেবে দেখানো হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ফসল ঘরে তোলার আনন্দ অপরিসীম। তাদের সেই অর্জন তাই ভরে উঠত নৃত্যগীত আর নানা রকম অনুষ্ঠানে। অর্থকরী এ ফসলের আগমনেই দেখা দিত কৃষকের ঘরে সাময়িক সচ্ছলতা। নতুন কাপড় আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে শখের বস্তুও কিনে নিত তারা।
আমাদের আদি সমাজে আরেকটা বিষয় ছিল খুবই প্রেরণাদায়ক; ফসলের মাঠে দেখা যেত নারী-পুরুষকে সমানভাবে। সাম্যের এই চিত্র দেখা যায় চিত্রকর সুলতানের আঁকায়। তাঁর আঁকায় আরো একটা বিষয় ছিল, সেখানে চরিত্রগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শক্তিশালী। এই স্বাস্থ্য-প্রাচুর্য একটা সুখী জাতির পরিচায়ক, যা থেকে অবলীলায় একটা উৎফুল্ল পার্বণের ছবি আঁকা যায়। উদ্দীপক এই চিত্র দেশের মানুষকে আশার আলো দেখায়। তবে মাটিকে অনেকেই ঐশ্বরিক আধিপত্যে বিচার করে থাকে। তাতে উৎপাদিত ফসলকে ধরে নেয় তারই দান হিসেবে। আদিবাসীদের অনেকে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নৈবেদ্য সাজায়। রবীন্দ্রনাথের গানেই আছে এর সুর। যেমন ‘প্রকৃতি’ পর্বে পাই ‘...ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’ এ গেল সুখী চিত্র। কিন্তু সর্বত্র তা তো থাকে না। মানুষকে পার হতে হয় অনেক সমস্যাসংকুল পথ।
সারা বছরের দুঃখ-দুর্দশায় ভরা জীবনের অন্ধকার নবান্নের আলোকছটায়ও আলোকিত হয় না অনেক সময়। চৈনিক একটা লেখায় নবান্নকে চিত্রিত করা ছিল অন্যভাবে। ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয় জমিদারের লোক। সারা বছরের নেওয়া কর্জ আদায়ের জন্য শুরু হয় তাদের তর্জন-গর্জন। কর্জের পরিমাণ তখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে অনেক। আর সে সুদের কোনো নিয়মকানুন নেই। জমিদারের খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে তার উশুলের পরিমাণ। যে পাত্রের মাপে কর্জ দেয়, ফেরত নেওয়ার সময় সে পাত্রের মাপ অভিনব কায়দায় যায় বেড়ে। কৃষকের শেষ দানাটা পর্যন্ত কেড়ে নেয় নানা রকম বুজরুকি দিয়ে। আমাদের দেশেও আছে এর নমুনা, তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘পৌষ-লক্ষ্মী’। গল্পের মুকুন্দ পাল জমি চাষ করে ফসল ফলায়। শত চেষ্টাতেও তার দুঃখ যায় না। তার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলছেন, “এত দিন পৌষ এসে ‘বউনির বাঁধন’ মানে নাই, মাঘ মাস যেতে না যেতে গোলা খালি হয়েছে, খাজনায়, মহাজনের পাওনায় সব কর্পূরের মতো যেন উবে গিয়েছে। আসছে বছরের খোরাকির জন্য আবার মহাজন ঠিক করতে হয়েছে।”
আজ হয়তো সেভাবে মহাজন বা জমিদার নেই। তবুও কৃষক তার ফসলের ন্যায্য পাওনা বুঝে পায় না। ফসল এখন উৎপাদন হচ্ছে দ্বিগুণ হারে। তবুও মানুষের দুঃখের অন্ত নেই। আমাদের দেশের কৃষক বা কৃষিনির্ভর মানুষগুলোই টিকে আছে ধুঁকে ধুঁকে। পেট পুরে খেতে না পাওয়া মানুষের দল ভিটেবাড়ি ছেড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এসে আশ্রয় নেয় শহরে। শত কষ্টের পরও সাহসী মানুষ হাল ছাড়ে না। বারবার হেরে গিয়েও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। মাটির বুকে ঝরে তার নোনা ঘাম। কর্ষণে কর্ষণে সরেস করে আনে শুকিয়ে শক্ত হয়ে আসা মাটি। বপন করে স্বপ্নের বীজ। আশা তার, আবার ভরে উঠবে গোলা। এ সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী। কিছুদিন আগে মেক্সিকোয় হয়ে যাওয়া কৃষকদের আন্দোলনই প্রমাণ করে, আজও কৃষকরা অবহেলিত। তার পরও তারা দমে যায়নি, তাদের সংগ্রামে ভাটা পড়েনি। বহুদিন আগের একটা উপন্যাসের কথা উল্লেখ করলে বোঝ যাবে, এ সংগ্রাম চলছে যুগ যুগ ধরে। ওয়াল্টার ডি এডমন্ডসের ‘ড্রামস অ্যালং দ্য মোহক’ উপন্যাসের গিলবার্ট মার্টিন আর তাঁর স্ত্রী ম্যাগডেলানা পেরিয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম। সময়টা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার। গিল বা লানা জড়িয়ে পড়ে এই যুদ্ধের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এ ছাড়া সেইসঙ্গে ছিল তাদের জমি এবং ফসল রক্ষার লড়াই। ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেও তারা থামায় না তাদের ফসল বোনার কাজ। ভোলে না পাকা ফসল ঘরে তুলতে। আর এভাবেই একসময় তারা বিজয় ছিনিয়ে আনে, সঙ্গে সঙ্গে রক্ষা করে তাদের বসত, খামার। সেই সংগ্রামী কৃষক জেগে উঠুক আমদের দেশেও।
একদা যারা জেগেছিল তেভাগা আন্দোলনে, আবার তাদের মুখে হাসি ফুটুক। ভরে উঠুক বাংলার গ্রামগুলো নবান্ন উৎসবে। প্রথম কথায় ফিরে আসি। হারিয়ে যাওয়া এসব পালা-পার্বণ আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এ শুধু উৎসব নয়, এ মানুষের অস্তিত্বের গোড়া ধরে নাড়া দেওয়া। নতুন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে এ অপরিহার্য। এখনকার প্রজন্ম যাতে তাদের শিকড় ভুলে না যায়, তার জন্য। এই সব পালা-পার্বণই আমাদের ঐতিহ্যের ধারক। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা না থাকলে পরের প্রজন্ম পথ হারাবে অন্ধকারে।