মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ
নারী জাগরণের আলোকবর্তিকা কবি সুফিয়া কামাল
কবি সুফিয়া কামাল। তিনি ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ ৮৯ বছরের কর্মজীবন শেষে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আজ এ মহীয়সী নারীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর যখন জন্ম, তখন নারীদের কোনো স্বাধীনতাই ছিল না। সেই অবস্থা থেকে শুধু নিজগুণে জীবনের এত দূর পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর প্রথাগত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজের আগ্রহে এবং বাবা-মা, দাদা-দাদির সহযোগিতায় নিজেই বাড়িতে বসে পড়া শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে বড় মামার বিশাল লাইব্রেরি। সেখানেই নিজে নিজে লেখাপড়া শিখে মাত্র ১২ বছর বয়সে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ’ পত্রিকায় ‘সৈনিক বধূ’ নামের গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে।
অপরদিকে বরিশালের মাতৃমঙ্গল সেবাদানের মধ্য দিয়ে সমাজসেবায় তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীজাগরণ এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালের নামটি নিবিড়ভাবে জড়িত। তারপর তিনি একে একে রচনা করে গেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া, একাত্তরের ডায়েরি, মায়াকাজল, উদাত্ত পৃথিবী, ইতল বিতল, কেয়ারকাঁটা, সোভিয়েত দিনগুলো ইত্যাদি। তিনি এসব সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- বুলবুল ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রাশিয়ার লেলিন স্বর্ণপদক, একুশে পদক, নাসিরুদ্দিন পদক, শেরেবাংলা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মান। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন আপসহীন নারী।
১৯২৫ সালে তিনি অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধী বরিশাল এলে তিনি নিজের চরকায় সুতা কেটে গান্ধীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্য ছিলেন তিনি। নারী জাগরণের আরেক অগ্রদূত বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে তিনি কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দালনের সময় ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিল আয়োজন, নেতৃত্ব প্রদানসহ সামগ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রথম সভানেত্রী হন তিনি। ১৯৬০ সাল তাঁর নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কমিটি’ গঠন করা হয়। সেই সময় তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম রোকেয়ার নামে মহিলাদের জন্য একটি ছাত্রী হল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠন করে তিনি এর সভানেত্রী হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা শহরেই অবরুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিলেন। সুফিয়া কামাল একজন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। এ দেশের অবহেলিত, নির্যাতিত ও শোষিত নারীসমাজের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নারীদের সাহসী, সংগ্রামী ও আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার তিনিই অনুপ্রেরণা। ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।