এদুয়ার্দো গালেয়ানোর গল্প
বউখেকো সরীসৃপ মানব

নদীর ধারে লম্বা ঘাসে প্রায় ডুবে থেকে একটা মেয়ে বই পড়ছিল।
বইতে লেখা আছে, কোনো এককালে এক দেশে ছিল বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী এক লোক। লুকানোমারকা শহর ও এর আশপাশের সবকিছু ছিল তার অধিকারে, শুকনো ভেজা শান্ত বন্য সব, যা কিছু স্মরণযোগ্য কিংবা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে সব। কিন্তু এত কিছু থাকলেও তার ছিল না কোনো উত্তরাধিকারী। একটা পুত্রসন্তান চেয়ে প্রতিদিন ধনী লোকটার স্ত্রী ঈশ্বরের কাছে হাজারবার প্রার্থনা করত, রাতে জ্বালাত শত শত মোমবাতি।
ঈশ্বর এই নাছোড়বান্দা নারীর চাওয়ার জ্বালায়, বিশেষ করে যেটা তার দেওয়ার ইচ্ছে নেই, তেমন কিছুর প্রার্থনা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত হয় এ ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করতে, নয়তো দৈবশক্তির প্রভাবে সম্ভব হলো অলৌকিক ঘটনা। খুশি নেমে এলো ধনী লোকটির সংসারে।
বাচ্চাটি দেখতে মানুষের মতোই ছিল, তবে তার দেহ ছিল সরীসৃপের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটি কথা বলতে শিখল, কিন্তু হাঁটতে হতো পেটে ভর দিয়ে। দেশের সেরা শিক্ষক তাকে পড়তে শেখাল, কিন্তু হাতের গড়নের কারণে সে আর লিখতে শিখল না।
১৮ বছর বয়স হতেই ছেলেটি বিয়ের আবদার করে বসল।
ধনী বাবার বদৌলতে জোগাড় হলো পাত্রী। পুরোহিতের আস্তানায় ধুমধাম করে শেষ হলো বিয়ে।
প্রথম রাতে, সরীসৃপ ঝাঁপিয়ে পড়ল নতুন বউয়ের ওপর আর তাকে গিলে খেল। যখন সকাল হলো, নবদম্পতির বিছানায় বিপত্নীক বরের পাশে তখন পড়ে আছে ছোট ছোট কিছু হাড়।
তারপর সরীসৃপ মানবের আবার বিয়ের দাবি, আবার একটা বিয়ের উৎসব, আবার বউকে গিলে খাওয়া এবং তারপর আবার বিয়ে। এভাবে চলতে থাকল।
বিয়ের পাত্রী পেতে কখনোই খুব অসুবিধা হয়নি, গরিবের ঘরে বিলিয়ে দেওয়ার মতো মেয়ে সব সময় মজুদ থাকে।
নদীর জলে খসখসে চামড়া ভিজিয়ে ভাতঘুম দিচ্ছিল সরীসৃপ মানব ডোলসিডায়ো।
এক চোখ খুলে বই পড়তে থাকা মেয়েটিকে দেখল সে। এর আগে চশমা চোখে দেয়, এমন কোনো নারী তার চোখে পড়েনি। মুখ বাড়িয়ে ডোলসিডায়ো জিজ্ঞেস করল, ‘কী পড়ছেন?’
বই নামিয়ে অধ্যয়নরতা ঠান্ডা চোখে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল। ‘রূপকথা।’
‘রূপকথা?’
‘প্রাচীন কণ্ঠস্বর।’
‘কেন?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে মেয়েটির উত্তর, ‘সঙ্গ পেতে।’
মেয়েটি নিশ্চিতভাবেই আশপাশের কোনো পাহাড় থেকে আসেনি, জঙ্গল থেকে না, এমনকি উপকূল থেকেও নয়।
ডোলসিডায়ো বলল, ‘আমিও পড়তে জানি।’
বই বন্ধ করে মেয়েটি মুখ ঘোরাল।
হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগে ডোলসিডায়ো কেবল কোনোভাবে বলতে পেরেছিল, ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’
পরের রোববার, দুপুরের ঘুম শেষে জেগে উঠে মেয়েটির দেখা পাওয়া গেল আবার। হাতে বই নেই, তবে চোখে চশমা আছে।
বালুর ওপর বসে ছিল সেই মেয়ে, পা ঢাকা কাপড়ের রঙিন ঝুল, যেন সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে গেঁথে আছে সেখানে। আগন্তুকের ওপর দৃষ্টি গাঁথা ছিল তার।
মেয়েটিকে মুগ্ধ করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে চায় ডোলসিডায়ো। দূর দিগন্তে নীল পাহাড়ের দিকে থাবা উঁচিয়ে বলল, ‘যতদূর দেখা যাচ্ছে এবং যা দেখা যাচ্ছে না, সবই আমার।’
সেদিকে তাকিয়েও দেখল না মেয়েটি, চুপ করে রইল। একেবারে নিঃশব্দ।
উত্তরাধিকার বলে প্রাপ্ত ধনের গড়গড় বর্ণনা চলল। অনেক ভেড়া, অসংখ্য আদিবাসী—সব তার আজ্ঞাবহ। বিস্তৃত ভূমি, জল, বায়ু—সবকিছুর প্রভু সে, এমনকি যেখানে মেয়েটি বসে আছে, সেটাও তার জায়গা। ‘কিন্তু আপনি ওখানে বসতে পারেন’, মেয়েটিকে আশ্বস্ত করতে চাইল সে।
বেণি দুলিয়ে মেয়েটি কুর্নিশ করল তাকে, ‘ধন্যবাদ।’
তখন সরীসৃপ মানব বলল যে সে যদিও খুব ধনী, কিন্তু সে বিনয়ী, শিক্ষিত, পরিশ্রমী এবং মোটের ওপর একজন ভদ্রলোক, যার ঘর বাঁধার স্বপ্ন আছে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বারবার পত্নীহারা হতে হয় তাকে।
মেয়েটি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মাথাটা সামান্য নামিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে সে।
ডোলসিডায়ো নড়েচড়ে বসল। তারপর ফিসফিস করে করে বলল, ‘একটা উপকার করতে পারেন?’
এরপর মেয়েটির দিকে পিঠ পেতে দিয়ে বলল, ‘পিঠটা একটু চুলকে দিতে পারেন? আমার হাত পৌঁছাচ্ছে না।’
সরীসৃপ মানবের খসখসে পিঠে হাত দিয়ে মেয়েটি মন্তব্য করল, ‘একেবারে রেশমের মতো।’
ডোলসিডায়ো টানটান হয়ে থাকল, চোখ বন্ধ, মুখটা ফাঁক হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে লেজ—এমন কিছু সে অনুভব করছে যেমনটা আগে কখনো হয়নি।
কিন্তু যখন সে ঘাড় ঘোরাল, দেখল মেয়েটি সেখানে নেই। ডোলসিডায়ো তাকে খুঁজতে লাগল, লম্বা ঘাসের আড়াল তছনছ করে দৌড়াতে দৌড়াতে একবার এদিক যায়, আরেকবার ওদিক। পুরোটা এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল সে, কোথাও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মেয়েটি বরাবরের মতোই যেন হাওয়ায় উবে গেছে।
পরের রোববার মেয়েটি নদীর ধারে এলো না। এর পরের রোববার, তার পরের রোববার মেয়েটির দেখা মিলল না।
প্রথম দেখার সময় থেকেই ডোলসিডায়ো কেবল মেয়েটিকেই দেখেছে। মেয়েটিকে দেখা ছাড়া আর কিছুই খেয়াল করেনি সে।
ঘুমকাতুরের চোখে ঘুম নেই, পেটুক হারিয়েছে খাবার রুচি। মৃত স্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শোবার ঘরে যে শান্তি পাওয়া যেত, তাও এখন আর নেই। দেয়ালের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মৃত স্ত্রীদের ছবি সাজানো, কমলা রঙের ফুল দিয়ে গাঁথা হৃদয়াকৃতির মালা সেসব ছবিতে। কিন্তু ডোলসিডায়ো, যার কাছে এখন অসহ্য লাগে এই নির্জনতা, বালিশে এলিয়ে পড়ে আছে, যেন তলিয়ে যাচ্ছে হতাশার গভীরে। সারা দেশ থেকে অসংখ্য বৈদ্য এসেও সারাতে পারল না তার অসুখ, সবকিছু থেকে তার এই মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া।
সস্তায় কেনা ছোট্ট রেডিও এখন তার সঙ্গী। রাতদিন সেখানে বাজতে থাকে পুরোনো দিনের গান, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাতে ডুবে থাকে সে।
ডোলসিডায়োর বাবা-মা হতাশ হয়ে দেখতে থাকে ছেলের এই অবস্থা। আগের মতো ছেলে আর বলছে না, আমি ক্ষুধার্ত, আগের মতো আর স্ত্রী পাওয়ার বায়না করছে না।
ছেলে এখন কেবল কাতরাচ্ছে, ভালোবাসা আমাকে নিঃস্ব করেছে। ভাঙা গলায় ভীতিকরভাবে কবিত্ব শক্তি উজাড় করে দিয়ে বারবার আনুগত্য প্রকাশ করছে তার প্রতি, যে হরণ করেছে তার হৃদয়, তার শান্তি।
রাজ্যের সমস্ত লোককে লাগিয়ে দেওয়া হলো সেই মেয়েকে খুঁজে বের করতে। স্বর্গ মর্ত্য তন্নতন্ন করে ফেলা হলো, কিন্তু তারা তো সে মেয়ের নাম পর্যন্ত জানে না। আশপাশের এলাকায় এমন কোনো মেয়েকে কেউ দেখেনি যে চোখে চশমা দেয়।
একদিন রোববার দুপুরে, যেন কিছু একটার আভাস পেল। ব্যথিত ডোলসিডায়ো উঠে দাঁড়াল। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এলো নদীর তীরে।
মেয়েটি সেখানে ছিল।
ডোলসিডায়ো চোখের জলে ভেসে যেতে যেতে ছলনাময়ী আর নির্লিপ্ত স্বপ্নকন্যার কাছে নিবেদন করল তার প্রেম। স্বীকার করল যে ভালোবাসার মধু আস্বাদনের তৃষ্ণায় সে মরে যাচ্ছে। বলল, প্রাণের কপোতীর এমন অবজ্ঞা সে প্রত্যাশা করে না। এবং এমন আরো অসংখ্য স্তুতি আর সোহাগীবাক্যে ভরিয়ে তুলল তাকে।
ধার্য হলো বিয়ের দিন। সবাই খুব খুশি। অনেক দিন এমন উৎসব হয় না। আর এ তল্লাটে এমন বিয়েবাজ পুরুষ আর কে আছে। পুরোহিতের কাছেও বিশেষ মক্কেল হিসেবে ডোলসিডায়ো পায় বিশেষ ছাড়।
গিটারের বাদন, সেইসঙ্গে বেহালা আর বীণার সুর মূর্ছনা আবিষ্ট করে রাখল অভ্যাগতদের। সবাই প্রেমিক যুগলের সুখী দাম্পত্য জীবন কামনা করল, ফুলের শুভেচ্ছায় ভেসে গেল বিয়ের আসর।
বিয়ে উপলক্ষে ডোলসিডায়োর দেহে নতুন চামড়া—ঘাড়ের কাছে গোলাপি, বিশাল লেজের দিকটা সবুজাভ।
অবশেষে যখন তারা একা হওয়ার সুযোগ পেল, যখন সত্য উন্মোচনের সময় এলো, ডোলসিডায়ো ঘোষণা করল, ‘তোমার পায়ের কাছে আমি আমার হৃদয় সমর্পণ করলাম।’
এক ফুঁয়ে বাতি নিভিয়ে দিল মেয়েটি। বিয়ের বিশেষ পোশাক, চশমা খুলে রাখতে রাখতে বলল, ‘গাধার মতো কথা বলো না, এসব ফালতু কথা ছাড়ো।’ হেঁচকা টানে ডোলসিডায়োকে উন্মোচিত করল খাপখোলা তলোয়ারের মতো, মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল তার বিশেষ চামড়ার আবরণ, আলিঙ্গনে যেন জ্বলে উঠল ডোলসিডায়ো।
এর পর স্ত্রীকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ডোলসিডায়ো এবং জীবনে প্রথমবারের মতো স্বপ্ন দেখতে লাগল।
ডোলসিডায়ো ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই তাকে খেয়ে নিচ্ছিল মেয়েটি। ছোট ছোট গ্রাসে সাবাড় করছিল তাকে—মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত, যতটা সম্ভব কম শব্দ করে শোভনভাবে চিবিয়ে। চেষ্টা করছিল যেন ডোলসিডায়োর ঘুম না ভাঙে, যাতে তার সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা না হয় ডোলসিডায়োর।
লেখক পরিচিতি : সমকালীন লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানোর (১৯৪০-২০১৫) জন্ম উরুগুয়ের মন্তেবিদেয়ো শহরে। লেখক ও সাংবাদিক গালেয়ানোর ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’র অপরিহার্যতা ও গুরুত্বের বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে লেখা ট্রিলজি : মেমোরি অব ফায়ার। সাংবাদিক হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রো, উগো শাভেজ, সালভেদর আলেন্দসহ বহু পৃথিবী বিখ্যাত রাজনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। তাঁর রাজনীতি ভাবনার নানা বয়ান হয়ে উঠেছে গল্পের মতোই আকর্ষণীয়। ঐতিহাসিক নানা গল্প থেকে উপাদান খুঁজে এনে পাঠকের সামনে হাজির করেন তিনি। বলেন, ‘আমি এমন একজন লেখক, যাঁর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে স্মরণীয় ঘটনাবলির প্রতি, বিশেষ করে স্মরণযোগ্য অতীত থাকা সত্ত্বেও যে লাতিন আমেরিকার বদনাম রয়েছে স্মৃতিভ্রষ্টতার।’
লেখক পরিচিতি : সমকালীন লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানোর (১৯৪০-২০১৫) জন্ম উরুগুয়ের মন্তেবিদেয়ো শহরে। লেখক ও সাংবাদিক গালেয়ানোর ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’র অপরিহার্যতা ও গুরুত্বের বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে লেখা ট্রিলজি : মেমোরি অব ফায়ার। সাংবাদিক হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রো, উগো শাভেজ, সালভেদর আলেন্দসহ বহু পৃথিবী বিখ্যাত রাজনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। তাঁর রাজনীতি ভাবনার নানা বয়ান হয়ে উঠেছে গল্পের মতোই আকর্ষণীয়। ঐতিহাসিক নানা গল্প থেকে উপাদান খুঁজে এনে পাঠকের সামনে হাজির করেন তিনি। বলেন, ‘আমি এমন একজন লেখক, যাঁর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে স্মরণীয় ঘটনাবলির প্রতি, বিশেষ করে স্মরণযোগ্য অতীত থাকা সত্ত্বেও যে লাতিন আমেরিকার বদনাম রয়েছে স্মৃতিভ্রষ্টতার।’
গ্র্যান্ড স্ট্রিট ম্যাগাজিনে মূল ভাষা থেকে গল্পটি অনুবাদ করেন এ্যালেস্টার রিড। বাংলায় গল্পটি অনুবাদ করেছেন রেশমী নন্দী।