আলমগীর কবিরের কথিকা
বাংলাদেশের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ

ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অসংখ্য ব্যক্তির আত্মত্যাগ ও অবদানে সমৃদ্ধ। চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাঁদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথিকা বয়ান করতেন তিনি। আন্তর্জাতিক শ্রোতাদের উদ্দেশে প্রচারিত সেই কথিকা মুক্তিযুদ্ধে জড়িত বিবিধ গোষ্ঠী ও মতাদর্শ নিয়ে আলমগীর কবিরের ক্ষুরধার রাজনৈতিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত সেই কথিকার ৮১টি পরবর্তী সময়ে ‘This was Radio Bangladesh 1971’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়। ১৯৮৪ সালে বইটি ছাপে বাংলা একাডেমি।
‘আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১’ শিরোনামে সম্প্রতি বইটি তর্জমা করেছেন আফজালুর রহমান, আরস্তু লেনিন খান, তাহমিদাল জামি, প্রিয়ম পাল ও সামসুদ্দোজা সাজেন। আগামী বইমেলায় প্রকাশিতব্য বইটি থেকে বাছাইকৃত কিছু কথিকা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে এনটিভি অনলাইন।
বাংলাদেশকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে জুড়ে দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ওপর যে অর্থনৈতিক শোষণ চলে আসছে, ধরনে ও মাত্রায় তা বর্তমান গণঘাতী যুদ্ধের আতঙ্কের চেয়ে কোনো অংশেই কম মর্মান্তিক নয়। মূলত এই বছরের এপ্রিল মাস থেকে এই মর্মান্তিক শোষণ অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছে।
বাংলাদেশ অর্থাৎ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান গত ২৩টি বছর ধরে নিখিল পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ আয় করেছে, অথচ বিনিময়ে জাতীয় সম্পদের যে পরিমাণ শরিকানা বাংলাদেশ লাভ করেছে, রূপকের ছলে তাকে চিনাবাদামের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এসব কথা আজ সবাই জানে। ভেস্তে যাওয়া ফেডারেশনের এই অংশকে তারা রীতিমত পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পকারখানার পণ্য বেচার ঔপনিবেশিক বাজারে পরিণত করেছে। দুঃখের বিষয়, আমাদেরই অর্থকরী ফসল পাট আর চা বিদেশে বেচে যে প্রচুর আয় হয়েছে, তা দিয়েই গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। শিল্পকারখানার জোয়ারের ছিঁটাফোটা পূর্ব পাকিস্তানেও কিছু লেগেছিল। কিন্তু সেসব কারখানার বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানাধীন কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হতো না বললেই চলে। ফলে, বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রের যে অংশটুকু পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানাধীন ছিল না, তা গড়ে উঠেছে সরকারের অধীনে। তবে এসব কারখানাও পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। কর্ণফুলী পেপার এবং সিন্থেটিক ফাইবার কমপ্লেক্স এই প্রবণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই জঘন্য অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সর্বজনের অসন্তোষ জঙ্গি গণবিক্ষোভের রূপ নিলেও কাজের বেলা আদতে কিছুই বদলায়নি। সত্য বলতে, এহেন অর্থনৈতিক উপনিবেশ আরো পোক্ত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের জান্তার মদদপুষ্ট পুঁজিপতিদের কল্যাণে। আর এই জান্তা পাকিস্তান আমলের একদম গোড়া থেকে পরোক্ষে এবং শেষ এক যুগ ধরে তো সরাসরিই পাকিস্তান শাসন করেছে।
কয়েক বছর ধরে খুবই নিষ্ঠুর রূপ নিয়েছে এই শোষণ। পূর্ব বাংলায় সক্রিয় পশ্চিম পাকিস্তানি কারবারিরা এখানে কোনো কানাকড়ি বিনিয়োগ করা তো দূরের কথা, বরং পূর্ব পাকিস্তানের অফিসগুলোর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল সূর্যাস্তের আগেই যেন সব আদায়কৃত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জলমাটির সাথে খাপ খায় না বলেই পাটশিল্পটা পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা যায়নি। এ রকম নজির একমাত্র এই পাটশিল্পই। শুরু থেকেই এই শিল্পে সর্দারি করতেন আদমজি। দেশ ভাগ হওয়ার আগে বোম্বেতে এই আদমজিকেই কপর্দকশূন্য দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। আর পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর একরকম আক্ষরিক অর্থেই চোখের পলকে তিনি কোটিপতি বনে গেলেন। পাটের বাজারটা একচেটিয়া করে নিয়েছিলেন এই অর্থগৃধ্নু ধান্দাবাজ লোকটি। পাটচাষিদের কার্যত ভিখারিতে পরিণত করা হয়েছিল। আর তাদেরই শ্রমের ফসল আকাশছোঁয়া দামে বেচে টাকার খনি বানিয়ে নেন আদমজি। পরে আরো কিছু অবাঙালি পুঁজিপতি তাঁর সাথে যোগ দিয়ে শোষণে নবতর মাত্রা যোগ করেছেন। যে সরকারি পরিসংখ্যান সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে, সেই পরিসংখ্যানে পর্যন্ত এই অনবরত, বহুমুখী ও নিষ্ঠুর শোষণের চেহারা ফাঁস হয়ে গেছে। পূর্ব বাংলার মাথাপিছু আয় আজ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের প্রায় অর্ধেক। অথচ গোড়াতে উভয়ের আয় সমান ছিল। ১৯৪৭ সালে বাঙালিরা বরং কিছুটা এগিয়েই ছিল বলা যায়।
সামরিক-পুঁজিতান্ত্রিক-আমলাতন্ত্রিক আঁতাত ভেবেছিল এইভাবে তিলে তিলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খুন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোনো অধিকার রাজনৈতিকভাবে পূর্ববঙ্গের মানুষের নাই। তাদের দমন করার জন্য ‘ইসলাম বিপন্ন’, ‘ভারতের চর’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’, ‘জাতীয় সংহতি বিপন্ন’ ইত্যাকার বহুবিধ জুজুর ভয় দেখানো হয়। বাঙালির উপর রাজনৈতিক দমনপীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করল। বিনা বিচারে জেলে পচতে লাগল হাজার হাজার লোক। রাজনৈতিক কূটকৌশল, দমনপীড়ন আর বাটপারির এক অপূর্ব সমন্বয়ে ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করলেন আইয়ুব খান। যে ক্ষোভের পাহাড় পূর্ব পাকিস্তানে এতদিনে জমা হয়েছে, তা সূক্ষ্মভাবে প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন তিনি। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কবুল করলেন যে পূর্ববঙ্গ এত বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তার প্রতিকার করবেন বলে অঙ্গীকারও করলেন তিনি। অবশ্য তাঁর মনে ছিল ভিন্ন কথা। শোষণ সমান তালে চলতে লাগল। শোষণটা মানুষের কাছ থেকে লুকানোর জন্য নাখোশ বুদ্ধিজীবীদের চাকরিবাকরি, বৃত্তি ও অন্যান্য আইনি-বেআইনি বস্তুগত ঘুষ দিয়ে কেনার চেষ্টা করলেন আইয়ুব খান। কাজ তাতে হলো ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে সিধা চলে এলো পেটে লাথি খাওয়া গণমানুষের হাতে। এদেরও কিনে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আইয়ুবের ছিল না। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বাদবাকি গল্প আমরা সবাই জানি। সেসব কথা এখানে আর নাই বা বললাম।
আইয়ুব খানের যে কাবিলতি তা ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার ছিল না। আর তাই বাংলাদেশের মানুষের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম দুইধারি আক্রমণ আজ আমাদের দেখতে হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর কসাইদের হাতে এর মধ্যেই কতল হয়ে গেছে ১০ লাখ লোক। বছরটা শেষ হওয়ার আগেই ইতিহাসের জঘন্যতম দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে তোলার ছক নিয়ে ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইয়াহিয়া ও তার চক্র। তার তালে তাল ঠুকে এগিয়ে এসেছে শিল্পকারখানা লুটপাট। পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতির মালিকানাধীন কলকারখানার সব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা করাচি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, অর্থনৈতিক লুটপাটের কাজটা এখন ওদের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে খুনি টিক্কার সামরিক প্রশাসন। সরকারি মালিকানাধীন শিল্পকারখানা অর্থাৎ যেসব কারখানা বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি সেখান থেকে কলকব্জা সমানে লুট হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ঢাকার চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন স্টুডিওর কথা বলা যায়। ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এটা ছিল বাড়ন্ত একটা চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণভোমরা। এখানকার দামি দামি সব মালসামান লোপাট হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র ক্যামেরা, শুটিং ফ্লোরের যন্ত্রপাতি, শব্দধারণের যন্ত্রপাতি, সাদাকাল ও রঙিন ফিল্ম ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি লাহোরে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদে তৎকালীন প্রাদেশিক শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপন করা আইনের বলে গড়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ছবি বেরিয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন অন্যান্য শিল্পকারখানাতেও এ রকম লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। আমরা শুনেছি ব্রিটেন একসময় ম্যানচেস্টারের বস্ত্রশিল্পের বাজার ধরে রাখতে আমাদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প নির্মমভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ নীলকরদের নৃশংসতার কথাও আমরা জানি। সেই থেকে ইতিহাস যেন আর এক পাও আগায় নাই। পাকিস্তানি নরাধমরা বাংলাদেশে এহেন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হলে সে কথা সবার অজানাই থেকে যেত।
প্রচার : ২৬ জুলাই ১৯৭১