মাহবুবুল হক শাকিল : কবি অথবা বন্ধুর অধিক

আমি তাকে কী বলব, কবি মাহবুবুল হক শাকিল নাকি বন্ধু মাহবুবুল হক শাকিল? যদিও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি এবং অন্য পরিচয় রাজনীতিবিদ মাহবুবুল হক শাকিল।
তিনি জীবিতাবস্থায় আসলে কোন পরিচয়টাকে ধারণ করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন? কী নামে ডাকলে তিনি সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হতেন? কী নামে ডাকলে তিনি মেনে নিতে পারতেন না? এসবের একটি হিসাব কিন্তু আমি মনে মনে করে ফেলেছি। সত্যিকার অর্থে আমি ছিলাম তাঁর সামান্য অনুজ এবং আড্ডায় বন্ধুর অধিক। তাঁকেও আমি সেভাবে সম্বোধন করতাম। তিনি আমার চেয়ে বয়সে চার বছরের বড় হওয়ায় প্রাণভরে শাকিল ভাই বলে ডেকেছি। আর তিনিও আমাকে আমার ধারণা সাধারণত ছোট ভাই আর আড্ডায় বন্ধুর অধিক বিবেচনা করতেন।
ফেসবুকে ভাই বা বন্ধু সম্বোধনের চেয়ে কবিতার নিচে কবি সম্বোধন করে কমেন্ট করলে যারপরনাই খুশি হতেন। মনে পড়ে মাস দুয়েক আগে আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের, আমি এবং শাকিল ভাই একটি অনুষ্ঠানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাহের ভাইও আমাদের পুরোনো বন্ধু; দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেন। তাঁর সঙ্গেও আমরা হাসিঠাট্টা করে কথাবার্তা বলি। তো এক ফাঁকে আমি তাহের ভাইকে ‘লিডার’ সম্বোধন করে কথা বললে শাকিল ভাই রিএ্যাক্ট করে বসেন। বলেন, ‘ওবায়েদ তুমি আমাকে এটা বলতে পারো না।’ বুঝেছিলাম একজন রাজনীতিবিদ বা ‘লিডার’ সম্বোধনে কী তীব্র আপত্তি তাঁর। তখন শাকিল ভাই মনে করেছিলেন আমি তাঁকে (শাকিল ভাইকে) লিডার সম্বোধন করে কথা বলছি। আসলে আমি ‘লিডার’ সম্বোধন করেছিলাম তাহের ভাইকে। আর শাকিল ভাই সেটা খেয়াল না করে ভেবেছিলেন আমি বুঝি তাঁকেই ‘লিডার’ সম্বোধন করেছি। আমি যখন তাঁর ভুলটা ধরিয়ে দিলাম, তখন তাঁর মুখমণ্ডলে যে লাবণ্য বা উজ্জ্বলতা দেখেছিলাম, তা বর্ণনাতীত।
শাকিল ভাই যেমন আমাকে চিনতেন আগে থেকেই, আমিও তাঁকে চিনতাম হয়তো তাঁরও আগে থেকে। জানতাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন, তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন, সাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, কবিতা লেখেন। কিন্তু দীর্ঘদিনই আমাদের মধ্যে কোনো দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। ধারণা করি, আজ থেকে আট-নয় বছর আগে একদিন মধ্যরাতে তাঁর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা হয়ে যায় কবিবন্ধু সরকার আমিন ও শাহনাজ মুন্নীর হাতিরপুলের বাসায়। আমরা সন্ধ্যা থেকেই ওই বাসায় আড্ডারত ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন আমাদের বন্ধু কানাডাপ্রবাসী বিশিষ্ট গল্পকার সাদ কামালী এবং আরো কেউ কেউ। আমাদের সেই উত্তাল আড্ডায় যোগ দিয়েই তিনি কবিতা নিয়ে তর্ক করতে শুরু করলেন। হ্যাঁ রীতিমতো তর্কই। তখনো আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়নি। হঠাৎ আমার দিকে অঙ্গুলি তুলে বললেন, ‘আপনিই তো কবি ওবায়েদ আকাশ, ঠিক?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তবে কবি কি না, জানি না।’ মুচকি হাসলেন শাকিল ভাই। আর তাঁকে তো আমার না চেনার কিছু নেই। দেখেছি টেলিভিশনে, পত্রপত্রিকায়। তাঁরপর আরো কিছুক্ষণ আড্ডা হলো, প্রাণবন্ত, কবিতায়, সাহিত্যের নানা শাখায়, সাহিত্যিক টার্ম, পরস্পরের ভালোলাগা, মন্দ লাগা, কবি-লেখক, পরচর্চা থেকে অনেক কিছুই। আমাদের আড্ডা যেন ক্রমেই জমে উঠছে আর সেই মুহূর্তে এক ঝটকায় চলে গেলেন শাকিল ভাই।
এরপর প্রায়ই তাঁকে দেখেছি বিভিন্ন আড্ডা অনুষ্ঠান, সমাবেশে। কিন্তু কথা তেমন হয়নি। বছর দুয়েক হলো তাঁর কিছু কবিতা আমার চোখে পড়তে থাকে। আগে তাঁর কবিতায় ততটা মনোযোগ দেইনি। সাম্প্রতিক কবিতাগুলো পড়তে শুরু করলাম। এবং ক্রমশ ভালোলাগা ঘিরে ধরতে লাগল। মাহবুবুল হক শাকিলের কবিতা যতগুলো পড়েছি, সবই জীবন থেকে নেওয়া, সহজাতভাবে নেমে আসা। তাঁর একটি কবিতাকেও বানানো মনে হয়নি। মনে হয়নি তিনি দু-চার বছর ধরে কবিতা লিখছেন। বোঝা গেল, এ হাত পুরোনো। অনেক দক্ষ। তাঁর কিছু কবিতার ভালো লাগা অনুভূতি জানলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা দেখি। পড়ি। একদিন সংবাদ-এর সাহিত্য পাতার জন্য লেখা চাইলাম। তিনি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দিলেন। বহুবার বহু জায়গায় বলতে শুনেছি, সংবাদ-এর সাহিত্য পাতা তাঁর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তিনি সব জায়গায় বলে বেড়াতেন ‘সংবাদ সাময়িকী’ই নাকি এখনো পর্যন্ত বেস্ট সাময়িকী। আমি উপস্থিত আছি এমনও একাধিক প্রোগ্রামে তিনি এ কথা বলেছেন। আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে এলিয়ে পড়েছি। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ তাঁর এ কথার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আমার সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন শালুক-এর বর্তমান প্রকাশিতব্য সংখ্যাসহ পরপর তিনটি সংখ্যায় তাঁর লেখা মুদ্রণ করেছি।
বছরখানেক আগে একদিন ডাকলেন গুলশানের ‘সামদাদো’ নামের একটি জাপানি রেস্তোরাঁয়। (এই সামদাদোতেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।) উদ্দেশ্য চুটিয়ে আড্ডা মারা। সেদিন আমি তাঁর হাতে আমার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতার বই ‘উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল’ উপহার দিলাম। শালুক-এর ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা সংখ্যাটির লেখক কপিটা দিলাম। তিনি আমাকে তাঁর প্রথম বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ উপহার হিসেবে দিলেন। বললেন, পড়তে দিলাম। খাওয়াদাওয়া, আড্ডা দিয়ে পর্ব শেষ হলো। বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে অনেক কাঁচা লেখা আবিষ্কার যেমন করলাম, তেমনি কিছু কবিতার পরিণত রূপ দেখেও মুগ্ধ হলাম।
এরপর বহুবার গুলশানের ওই ‘সামদাদো’ রেস্তোরাঁয় গিয়েছি তাঁর ডাকে। আড্ডা দিয়েছি। প্রায়ই রাত গভীর করে বাসায় ফিরেছি। সামদাদো ছিল তাঁর দ্বিতীয় বাসার মতো। ওখানে বসে তিনি কবিতা লিখতেন, গান শুনতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন, বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতেন।
কবিতার মতো গানও তাঁকে কাতর করত গভীরভাবেই। গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন শাকিল ভাই। পুরোনো দিনের গান, ফোক, গজল, আধুনিক, উর্দু, হিন্দি, উচ্চাঙ্গসংগীত, পঞ্চকবি- কার গান না শুনতে দেখেছি।
গত ফেব্রুয়ারি বইমেলায় প্রকাশিত হলো তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘মন খারাপের গাড়ি’। এবারের বইটি তাঁর সগর্বে তুলে ধরার মতো একটি বই। কবিতাগুলো যে কোনো সাহিত্য সমালোচক থেকে বোদ্ধা মহলে নিশ্চিন্তে গ্রহণযোগ্য হওয়া মতো। তার চেয়ে বড় কথা, জীবন নিংড়ে লেখা এই কবিতাগুলো পাঠক মহলে সাড়া ফেলবার মতোই। বইটি আমাকে মুগ্ধ করায় ‘সংবাদ সাময়িকী’তে একটি আলোচনাও লিখেছিলাম। পড়ে খুশি হয়েছিলেন। অনেককে দিয়ে পড়িয়েছিলেন।
তিনি নতুন যে বইটির কাজ করছিলেন এবং কবিতাগুলো ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন, সেই লেখাগুলো আরো বেশি আকর্ষণ করছিল। মনে হচ্ছিল মাহবুবুল হক শাকিল তাঁর সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে কবি হিসেবেই বেশি মার্কস পাবেন। এ কথা অনেককেই বলতে শুনেছি।
আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি গল্প পড়ে। গল্পগুলো যে কতটা নির্মেদ এবং ক্লাসিক্যাল ঘরানার ছিল, তা না পড়লে আন্দাজ করা কঠিন। এবারের বইমেলায় কবিতার বইয়ের পাশাপাশি একটি গল্পের বই প্রকাশেরও ইচ্ছা ছিল তাঁর। আড্ডাচ্ছলে বলেছিলেনও সে কথা।
শাকিল ভাই কেন যেন আমার কবিতার অন্ধভক্ত ছিলেন। নানা জায়গায় প্রকাশ তো করতেনই, এর বাইরে তিনি তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ প্রকাশক বন্ধুর কাছেও আমার কবিতার প্রশংসা করেছেন। সেটা তাঁরা আমাকে বলেছেন। আমার বই প্রকাশের আগ্রহ দেখিয়েছেন তাঁরা। ফেসবুকে অনেকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন বন্ধু হওয়ার জন্য। বলেছেন, ‘শাকিল ভাইয়ের কাছে আপনার কবিতার প্রশংসা শুনে আপনার প্রতি আগ্রহী হয়েছি।’ আমি প্রতিবার বিস্মিত হয়েছি! শাকিল ভাই তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের পাণ্ডুলিপি যখন প্রুফ দেখাতে দিলেন, জানানো হলো সেখানে ‘কবি ওবায়েদ আকাশকে দুটো কবিতা উৎসর্গ করা আছে।’ ব্যাপারটি খারাপ দেখায় বলে পরে একটি থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছেন। এত ঋণ আমি তো কিছুই শোধ করতে পারলাম না শাকিল ভাই! তাঁর আগেই কেন এক অবিশ্বাস্য এলিজি হয়ে উধাও হয়ে গেলেন?
শাকিল ভাই প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। খবর পেতাম, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। একবার স্কয়ারে বন্ধু মুজিব ইরম ও ডা. আব্দুল্লাহ জামিলসহ দেখতেও গিয়েছিলাম। একবার শুনলাম তিনি কিছু খেতে পারেন না। তাঁর লিভারের সমস্যা ধরা পড়ল। দেখা হলেই বলতাম, শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। কিন্তু শুনতেন না কিছুই। স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতেন। কখনো কখনো তাঁকে একটু অস্বাভাবিকও মনে হতো। এটা তাঁর শারীরিক সমস্যার কারণেই।
এই তো সেদিন, এক মাসও পেরোয়নি। বন্ধুবর শাকুর মজিদের জন্মদিনে বনানীর একটি বাড়িতে আমরা শেষ আড্ডা দিলাম। সেই একই শাকিল ভাই, একই মানুষ, প্রাণখোলা, তুখোড় আড্ডাবাজ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তাঁর চলে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল, তা কি তিনি জানতেন?
কিংবা যদি জানত কোনো মানুষ কিংবা জানতাম আমি, তাহলে অনন্ত রাত্রি আমি তাঁর হাত ধরে বসে থাকতাম, যেন পালাতে না পারেন। শাকিল ভাই, আপনার এই অভিমান কি খুব বেশি হয়ে গেল না? এত অভিমান ভালো না শাকিল ভাই। আমার দু চোখ মানে না। আজ চারদিন ধরে কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠে আমার বুক। আমি স্বাভাবিক হতে পারি না।