শৈশব থাকুক অক্ষত, উন্নত

যে বয়সটিকে আমরা মনে করি খেলার, সেই বয়সটিতেই শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বপন। সেই স্বপ্নই বেড়ে ওঠে শিশুমনে, পৌঁছে যৌবনে। তাই শিশুকাল বিশেষভাবে বিশেষায়িত হতে হয়। শিশুর আশপাশ, পরিবেশ, শিক্ষা তাকে পরবর্তী জীবনে দূরদর্শী হতে শেখায়। কিন্তু কমলমতিদের কি আমরা ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু তৈরি করে দিতে পারছি? অথচ, তাদের জন্যই আমাদের আগামী বেড়ে ওঠে, তারা তৈরি করে আগামীকে।
শিশুর চাওয়া ও আমরা
শৈশব যে কেবল খেলার এবং আনন্দের সময় নয়, বরং একটি শিশুর মনের ভেতর যে স্বপ্ন, আশা, ভয়, স্নেহ, পছন্দ, অপছন্দ, এবং অনুভূতি গড়ে ওঠে, তা তার পরবর্তী জীবনকে এক অনন্য দিশা দেয়। শিশুরা শুধু এই পৃথিবীকে উপলব্ধি করে না, বরং তার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়ে তোলে। শিশুমনে পৃথিবীর অস্থিরতা, অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যতা খুব সহজেই প্রবাহিত হতে থাকে। তাই, এই সময়টিকে যথাযথ ভাবে বিকশিত করা, তার চিন্তা-চেতনার জগতকে সুস্থ এবং পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব।
শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যাও বর্তমান
বর্তমান সময়ে দুর্ভাগ্যবশত আমরা শৈশবের অমূল্য সময়টিকে প্রায়শই হারিয়ে ফেলছি। শিশুরা আজকাল বাড়িতে, স্কুলে কিংবা সমাজে সেই সঠিক নিরাপত্তা, স্নেহ এবং দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। তারা একদিকে প্রযুক্তির আধিক্যে আক্রান্ত, অন্যদিকে পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলায় ভুগছে। শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যা, যেমন—দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, আবার নতুন নতুন সংকট যেমন মাদকাসক্তি, অবৈধ কাজকর্ম, শিশুশ্রম—সব কিছুই শিশুর শৈশবকে ধ্বংস করছে। শৈশব সেই জায়গা, যেখানে শিশুর আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, যেখানে তার ভবিষ্যৎ গড়ার প্রথম পাথর রাখা হয়। কিন্তু যদি সে শৈশবে ন্যূনতম সহানুভূতির অভাব অনুভব করে, তবে তার জন্য ভবিষ্যতের পৃথিবী অনেক কঠিন হয়ে উঠবে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি।’ যদিও তিনি অল্প বয়সে তা নিজে করে যেতে পারেননি। তবে, চেষ্টা ছিলো বলেই এই পঙক্তিকে ধারণ করে অনেকে কাজ করে চলেছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই উক্তি শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের প্রতি একটি গভীর দৃষ্টি দেয়। তার ভাষায়, পৃথিবীকে আমরা অঙ্গীকার করতে পারি যে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর, সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা শুধু একটি আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা।
কখন ভবিষ্যতের অন্ধকার বাড়ে?
আমাদের সমাজে যখন আমরা শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ, ন্যূনতম সুযোগ এবং শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই, তখন ভবিষ্যতের অন্ধকার বাড়ে। শিশুরা পরিণত হয় মানসিক এবং শারীরিকভাবে আহত, হয়তো কোনো একদিন তারা আমাদের সমাজে ফিরে আসে এক কষ্টের কাহিনী নিয়ে—অথবা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে সেই কষ্টের ফলস্বরূপ।
এখনও এমন অনেক শিশু আছে, যারা খেলার পাশাপাশি তাদের স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা বা সহায়ক শক্তি পায় না। তাদের জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হয়, যখন তাদের উচিত ছিল সারা পৃথিবীকে রঙিন দৃষ্টিতে দেখার। কখনো সখনো আমাদের ব্যস্ততার কারণে, আমরা এসব শিশুদের অবহেলা করি এবং তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করি।
শুধু শিক্ষা বা শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, শিশুদের মানসিক বিকাশও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি পৃথিবী যেখানে একটি শিশু মনে করে, তার কল্পনা সীমিত নয়, তার স্বপ্ন সীমাহীন—এই পৃথিবীই হতে হবে আমাদের লক্ষ্য। আমরা যদি শিশুদের পক্ষে একটি নিরাপদ ও সৃষ্টিশীল পরিবেশ তৈরি করতে না পারি, তবে আমরা কি তাদের ভবিষ্যতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি না?
প্রযুক্তি ও শিশু
আজকের দিনেও পৃথিবী অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রযুক্তির উন্নতি, সামাজিক পরিবর্তন, উন্নয়ন—সব কিছুই হয়েছে, তবে শিশুদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কি বদলেছে? তারাও তো এই পৃথিবীর অংশ, তাদেরও তো নিজের অধিকার আছে, তাদেরও তো সুখী ও উন্নত জীবন যাপনের অধিকার। আমাদের উচিত, তাদের জন্য এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলা, যেখানে তারা খেলাধুলা, শিক্ষা এবং প্রগতির সুযোগ পায়।
এখন প্রযুক্তির যুগে শিশুদের জীবন একদিকে যেমন উন্নত হয়েছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিপদও সৃষ্টি করেছে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার—এই প্রযুক্তির ভেতর শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি যেমন তাদের জ্ঞানের পরিসর বাড়াচ্ছে, তেমনি অনেক সময় এটি তাদের মনোজগতকে বিপথে চালিত করছে। যদি আমরা শিশুদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে না পারি, তবে তারা সহজেই অন্ধকারে চলে যেতে পারে, যেখানে তাদের সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে তারা প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে না।
শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়া
এখন প্রয়োজন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে শিশুদের জন্য পৃথিবীটিকে আরো নিরাপদ, সুস্থ ও নির্মল রাখা হবে। তাদের যদি আমরা শৈশবের পূর্ণতা দিতে না পারি, তবে তাদের স্বপ্ন এবং আশা অনুধাবন করতে, তাদের সঠিক পরিচর্যা করতে পারব না। তাই আমাদের উচিত তাদের প্রতি একটি সমানুভূতির দৃষ্টি রাখা এবং তাদের জীবনের প্রতি যত্নবান হওয়া।
শিশুর জন্য ছেড়ে দিতে হবে স্থান
এই পৃথিবীকে এক নতুন, সজীব, রঙিন এবং নিরাপদ স্থানে পরিণত করার দায়িত্ব আমাদের। এই দায়িত্ব শিশুমনের দিকে, তাদের প্রতি অঙ্গীকারের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। মনে রাখতে—‘এসে গেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান:/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে/চ’লে যেতে হবে আমাদের।’