গাড়িতে আগুন ধরেছে দেখেও কেউ পানি দেয়নি, ভিডিও করছিলেন!

রায়হান আলী খান। অফিসের কাজে গিয়েছিলেন রাজধানীর বারিধারায়। সেখান থেকে কাজ মিটিয়ে সহকর্মীসহ মোট চারজন উত্তরার অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন। প্রাইভেটকার চলছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছলেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন যানজটে। সময় তখন রাত ৮টা।
এ সময় সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য সিগন্যাল ছাড়লেন। রায়হান তাঁর গাড়িটি চালাতে যাবেন, এমন সময় সেটি বন্ধ হয়ে গেল। আর চালু করতে পারছিলেন না। এভাবে বেশ খানিকটা সময় চেষ্টার পর সামনের বনেটে নজর দিলেন। দেখলেন, ধোঁয়া উড়ছে।
রায়হান তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে থাকা দুই বোতল পানির এক বোতল ঢাললেন গাড়ির চাকায়। আরেক বোতল ছিটালেন সামনের বনেটে। কিন্তু, ধোঁয়া বন্ধ হচ্ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে এক প্রাইভেটকারচালক, এক পিকঅ্যাপচালক ও এক পুলিশ সদস্য রায়হানকে তিন বোতল পানি দিলেন।
ওই তিন বোতল পানি চাকা এবং বনেটে ঢাললেন রায়হান। কিন্তু, তখনও ধোঁয়া বন্ধ হচ্ছিল না। তবে কমে এসেছে। রায়হান ভাবতে থাকলেন, আরেকটু পানি দিলেই ধোঁয়া কমে যাবে। ফলে, তিনি লোকজনের চলতি পথের গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছিলেন। আকুতি জানিয়ে তাঁকে এক বোতল পানি দেওয়ার কথা জানাচ্ছিলেন।
কিন্তু, কেউ রায়হানের কথায় সাড়া দিচ্ছিলেন না। ছাড়া সিগন্যালে টান দিয়ে চলে যাচ্ছিল সবাই। তখনও রায়হানের গাড়িতে আগুন ধরেনি। শুধু ধোঁয়া উড়ছে। এভাবে বেশকিছু সময় তিনি পানি চাইলেন অনেকের কাছে। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। হঠাৎ গাড়িটিতে আগুন জ্বলতে শুরু করে।
রায়হান ভাবছিলেন, এতটুকু আগুন নিভে যাবে পানি পেলে। কিন্তু, কেউ পানি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। বরং রায়হানের গাড়িতে আগুন ধরা দেখে মানুষজন গাড়ির গ্লাস খুলে ভিডিও করা শুরু করে। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনও একই কাজ করছিলেন। কেউ ছবি তুলতে, কেউ-বা ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিলেন!
ঘটনার শুরুতেই রায়হান জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু, রাস্তায় যানজটের কারণে তারাও এলেন ৪৫ মিনিট পর। ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। পড়ে থাকল শুধু গাড়ির কঙ্কাল। পরে পুলিশ র্যাকার লাগিয়ে গাডিটা সরায়।
গাড়ি পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য অসহায়ের মতো দেখলেন রায়হান আলী খান ও তাঁর সঙ্গে থাকা তিনজন। তাঁদের কিছুই করার ছিল না। ওপরের পুরো ঘটনা এই প্রতিবেদককে জানালেন রায়হান।
কথার এক পর্যায়ে রায়হান বলছিলেন, ‘দুনিয়াটা কোথায় গেল? অনেক মানুষের কাছে অসহায়ের মতো পানি চাইলাম। চিল্লায়ে বললাম, পানির দরকার। অথচ, কেউ এগিয়ে আসেননি। শুরুতে যখন গাড়ি থেকে শুধু ধোঁয়া উড়ছিল, তখনও কেউ পানি দেয়নি। এরপর যখন গাড়িতে আগুন লাগল, তখন পাশে না দাঁড়িয়েও কিন্তু মানুষ পানি ছুড়ে দিতে পারত। কেউ দেয়নি। বরং, গাড়ি থেকে ভিডিও করতে করতে চলে গেল!’
রায়হান আলী খান আরও বলেন, ‘আমার গাড়ির আশপাশে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেল। তারাও কেউ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি। তবে, শুরুতে যে পিকঅ্যাপচালক পানি দিয়েছিলেন, তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমার গাড়িটা বাঁচাতে। আমরা যারা নিজেকে সভ্য দাবি করি, তারা কেউ এগিয়ে আসেননি।’
“৪৫ মিনিট পর যখন ফায়ার সার্ভিস এলো, তখনও পুরো গাড়ি পুড়ে ছাই। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা বিমানবন্দর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘এতগুলো মানুষ শুরুতে পানি না পেলেও মাটি দিয়ে হলেও তো গাড়িটি বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। কারণ, তখনও আগুন ধরেনি’।’’
রায়হান আলী খান বলেন, ‘মনে হয় শর্টসার্কিট থেকে আগুন ধরেছে। যাই হোক, আমার ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার গাড়ি পুড়ে গেল। অনেক মায়া জড়োনো গাড়ি। কিন্তু, আমার কষ্ট লাগছে মানুষের বিবেক কোথায় গেল? সব হারিয়ে গেছে? শুধুই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার নেশা পেয়ে বসেছে আমাদের? কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমি অসহায়ের মতো আকুতি জানালাম সবার কাছে। কেউ এগিয়ে এলেন না। ভিডিও করতে করতে চলে গেল সবাই।’