ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা : দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি এলাকাবাসীর

সাভারের আমিনবাজারে দশ বছর আগে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার মামলার ১৩ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় এলাকায় স্বস্তি নেমে এসেছে।
দ্রুত আদালতের রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন আমিনবাজারের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন।
এর আগে ২০০৪ সালে আলমাস উদ্দিন লালটু হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন আনোয়ার হোসেন। এবারও অপর সাত প্রার্থীর সঙ্গে তৃণমূল থেকে আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর স্ত্রী ওয়াহিদা আনোয়ারের নাম চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে তৃণমূল থেকে মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
এলাকাবাসী এবং আওয়ামী লীগের একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে আমিন বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আনোয়ার হোসেন।
এ ছাড়া আমিনবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অখিল উদ্দিনসহ দণ্ডপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারে বেড়াতে আসা ছয় ছাত্রকে ডাকাত বানিয়ে পিটিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
নিহত ছয়জন ছাত্র হলো—ধানমণ্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শাম্মাম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের টিপু সুলতান, মিরপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র কামরুজ্জামান।
যাদের নেতৃত্বে লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, বিভিন্ন সময়ে তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে এসে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা রকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে এলাকাবাসীর প্রতিটি দিন কাটতো ভয় আর আতঙ্কে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহান।
অভিযুক্ত ৬০ আসামির মধ্যে তিন জন বিচার চলাকালে মারা যান। বাকি ৫৭ আসামির মধ্যে ১৩ জনকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়েছেন বিচারক। পাশাপাশি তাদের সবাইকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অন্য একটি ধারায় আরও সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রমাণ না হওয়ায় মামলার বাকি ২৫ আসামিকে বেকসুর খালাস দিন আদালত।
রায়ের পর দিন আমিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে সুনসান নীরবতা। সর্বত্রই ছিল থমথমে পরিবেশ। দশ বছর আগে পুরো দেশকে স্তম্ভিত করা আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় জনকে পিটিয়ে হত্যার ওই ঘটনায় রায় নিয়েও ছিল আলোচনার ঝড়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, এ রায়ের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে সাভারের আমিনবাজার। পাপ করলে যে সাজা নিশ্চিত—এ রায়ের মাধ্যমে সে বার্তাটির পুনরাবৃত্তি দেখছেন স্থানীয়রা।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আনোয়ার হোসেন থেকে শুরু করে দণ্ডপ্রাপ্ত ৩২ আসামি ছিলেন এলাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী।
এ হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীরাই বাদী হয়ে নিরীহ কলেজ ছাত্রদের বিরুদ্ধেই ডাকাতের মিথ্যে মামলা করেছিলেন।
অন্যদিকে, ডাকাতির অভিযোগ এনে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আল-আমিন এবং তার নিহত ছয় বন্ধুর নামে মামলা করা স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আব্দুল মালেকও আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় আমিনবাজারের বালুর গদিসহ সর্বত্রই ছিল থমথমে ভাব।
স্থানীয়রা বলছেন, দেশ কাঁপানো লোমহর্ষক ছয় ছাত্র হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা এলাকায় ফিরে এসে পুরোনো কায়দায় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান হওয়ায় তাদের দাপটে এলাকাবাসী ছিল অসহায়। তাঁদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন পুনরায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তোড়জোড়ও শুরু করেছিলেন।
আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাহুমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এলাকাবাসী। পাশাপাশি এ রায়ের মাধ্যমে এলোমেলো হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব।
উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং স্থানীয় নেতৃত্বে যোগ্য নেতা বাছাইয়ে ব্যর্থতার মাশুল দিতে হচ্ছে দলকে।
আবার, নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদে ছয় কলেজছাত্র হত্যার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে। এ সরকারের আমলেই এ রায় সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বড় একটি বার্তা দিয়েছে বলেও মনে করছেন তাঁরা।