ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আদালতে ‘বিচলিত’ বাবা, রায়ে সন্তুষ্ট

নয় বছর আগে শবে বরাতের রাতে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার মামলায় প্রধান আসামি মালেকসহ ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ২৫ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। এ দিকে রায়ের পরে নিহতের পরিবার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন নিহত কামরুজ্জামান কান্তর বাবা আব্দুল কাদের। কামরুজ্জামান কান্ত (১৬) ছিলেন মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মেধাবী আর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের ছিল আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এক রাতেই শেষ করে দেয় ঘাতকরা; ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।
আব্দুল কাদের গত নয়টি বছর বিচারের আশায় বসেছিলেন, ধৈর্য্য ধরেছেন। আজ সকালেই ছেলে কামরুজ্জামানের একটা ছবি বুকে ধরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চলে আসেন। অন্য সব বিচারপ্রার্থী আদালতের কক্ষে প্রবেশ করলেও আব্দুল কাদের ছিলেন বারান্দায়। তিনি বিচলিত আর উদ্বিগ্ন হয়ে পায়াচারি করেছেন আর ছেলের ছবি দেখেছেন। ছেলে হত্যার ন্যায়বিচার কী তিনি পাবেন, খুনিরা কি সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে- এসব দুশ্চিন্তা যেন গ্রাস করে ফেলেছিল আব্দুল কাদেরকে।
বিচলিত হয়ে আব্দুল কাদের একটু পর পরই জিজ্ঞাসা করছিলেন, জানতে চাচ্ছিলেন- কী রায় হয়েছে? রায় পড়ার সময়টুকুতে যেন তাঁর তর সইছিল না। রায় ঘোষণা হওয়ার পর তিনি প্রথম সাংবাদিকদের কাছ থেকে তা শুনতে পারেন।
রায় শুনেই আব্দুল কাদেরের চোখে পানি চলে আসে। তিনি বলেন, ‘মামলাটির রায়ে আমি সন্তুষ্ট, দীর্ঘদিন পরে হলেও রায় হয়েছে। রায়ে প্রকৃত দোষী আসামিদের শাস্তি হবে এই প্রত্যাশা ছিল আমাদের। আজকের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।’
এদিকে রায়ের পরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।’ তিনি বলেন, ‘এ রায়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম আসামিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মদে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এই রায়ে আমরা আংশিক সন্তুষ্ট। যারা প্রধানত উসকানি দিয়েছিলেন, তাদের সাজা হয়নি। এ বিষয়ে রায়ের কপি পাওয়ার পরে আমরা আপিল করবো কি না। তা সিদ্ধান্ত নিব।’
নয় বছর আগে শবে বরাতের রাতে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার মামলায় প্রধান আসামি মালেকসহ ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ২৫ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বিচারক ১৩ আসামিকে মৃদ্যুদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। এছাড়া, অন্য একটি ধারায় এই ১৩ জনকে আরও সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করেছেন। তা তাঁরা দিতে ব্যার্থ হলে আরও ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগের নির্দেশ দিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন: আবদুল মালেক, সাইদ মেম্বার, আবদুর রশীদ, ইসমাইল হোসেন, জমশের আলী, মীর হোসেন, মজিবর রহমান, আনোয়ার হোসেন, রজ্জব আলী সোহাগ, আলম, রানা, আবদুল হামিদ ও আসলাম মিয়া।
পিপি আরও বলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া ১৯ জন আসামিকে রায়ের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। অন্য একটি ধারায় তাদের আরও সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করেছেন। তা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজীব হোসেন, ওয়াসিম, সাত্তার, সেলিম, মনির হোসেন, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নুর ইসলাম, শাহাদ হোসেন, টুটুল, মাসুদ, মোকলেছ, তোতন ও সাইফুল।
মামলার ৫৭ আসামির মধ্যে ৪৪ জনকে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালতে আনা হয়। এরপর তাদের রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। সেখান থেকে বেলা ১১টার পর এজলাসে তোলা হয়।
মামলার মোট আসামি ৬০ জনের মধ্যে এরই মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। অবশিষ্ট ৫৭ জনের মধ্যে ৪৫ জন ছিলেন হাজতে এবং পলাতক রয়েছেন ১২ জন।
গত ২২ নভেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য এ দিন ধার্য করেন। মামলায় ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে বিভিন্ন সময় ৫৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া এ মামলায় ৬০ জনের মধ্যে ৪৪ জন কারাগারে রয়েছেন ও বাকিরা পলাতক।
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামের কেবলার চরে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
নিহতেরা হলেন—বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাপললিফের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শামীম (১৮), মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ (২০), একই কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল (২১), উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত (১৬), তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান (১৯) এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবির মুনিব (২০)।
ঘটনার পর নিহতদের বিরুদ্ধেই ডাকাতির অভিযোগ এনে গ্রামবাসীর পক্ষে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন আব্দুল মালেক নামের এক বালু ব্যবসায়ী। অন্যদিকে, ছয় কলেজছাত্র হত্যায় ৬০০ গ্রামবাসীকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন সংশ্লিষ্ট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন।
২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন আহমেদ ৬০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ওই বছরের ৮ জুলাই মামলার ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলালউদ্দিন।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন—ডাকাতি মামলার বাদী আব্দুল মালেক, সাঈদ মেম্বার, আব্দুর রশিদ, ইসমাইল হোসেন রেফু, নিহর ওরফে জমশের আলী, মীর হোসেন, মজিবর রহমান, কবির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, রজুর আলী সোহাগ, আলম, রানা, আ. হালিম, ছাব্বির আহম্মেদ, আলমগীর, আনোয়ার হোসেন আনু, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নূর ইসলাম, আনিস, সালেহ আহমেদ, শাহাদাত হোসেন রুবেল, টুটুল, অখিল, মাসুদ, নিজামউদ্দিন, মোখলেছ, কালাম, আফজাল, বাদশা মিয়া, তোতন, সাইফুল, রহিম, শাহজাহান, সুলতান, সোহাগ, লেমন, সায়মন, এনায়েত, হায়দার, খালেদ, ইমান আলী, দুলাল, আলম, আসলাম মিয়া, শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজীব হোসেন, হাতকাটা রহিম, মো. ওয়াসিম, সেলিম মোল্লা, সানোয়ার হোসেন, শামসুল হক ওরফে শামচু মেম্বার, রাশেদ, সাইফুল, সাত্তার, সেলিম ও মনির। আসামিদের মধ্যে কবির হোসেন ও রাশেদ মারা গেছেন।