হত্যায় যে ভূমিকার কারণে নূর হোসেনের ফাঁসি
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ভিকটিমদের অপহরণের পর থেকে তাঁদের হত্যা ও লাশের পেট চিরে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে হত্যাকারীদের লোকবল সরবরাহসহ অন্যান্যভাবে সহযোগিতা করেছেন।
আদালতে হত্যাকারীরা তাঁদের সাক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা নূর হোসেনের এই ভূমিকার তথ্য-প্রমাণ দিয়েছেন, বিচারক সেসব আমলে নিয়েই মামলার প্রধান আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার দণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
আজ সোমবার নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর নয় মাসের মাথায় নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নূর হোসেনসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। যাঁদের অধিকাংশই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্য ছিলেন। বাকি নয় আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) এস এম ওয়াজেদ আলী খোকন রায়ের বরাত দিয়ে এনটিভি অনলাইনকে নূর হোসেনের সাজার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নূর হোসেন হত্যাকাণ্ডের পূর্বপরিকল্পনা করেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রকারী। পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি এ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। অপহরণ করার জন্য র্যাবকে তিনি সকাল থেকে সহযোগিতা করেছেন এবং তা সাক্ষ্য-প্রমাণে সাক্ষীরা বলেছেন। এই কথাগুলো বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন।’
আইনজীবী আরো বলেন, ‘নূর হোসেন ভিকটিমদের অপহরণ করার পর হত্যায় সহযোগিতা করেন। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশগুলো গুম করার জন্য তিনি ও তাঁর বাহিনী সর্বাত্মকভাবে গাড়ি এবং লোকবল দিয়ে সহযোগিতা করেন।’
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে নূর হোসেনের নির্বাচন ও এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ১০-১৫ বছর ধরে শত্রুতা ছিল।
সর্বশেষ সিটি করপোরেশনের রাস্তার কাজকে নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এর জের ধরেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই নূর হোসেন কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিটিং করে পরিকল্পনা করে বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী। তিনি আরো বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে নূর হোসেন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য নারায়ণগঞ্জের র্যাব অফিসে যান। র্যাব অফিসে গিয়ে তিনি নির্ধারণ করেছেন, কবে নজরুল আদালতে আসবেন। পরে নূর হোসেন আদালতে আসার বিষয়টি র্যাবকে শতভাগ নিশ্চিত করেছেন এবং সঙ্গে নজরুলের ছবি সরবরাহ করেন। নজরুল আদালতে আসার পরে নূর হোসেনের লোকজন র্যাবকে ছবি দেয়। নজরুল আদালত থেকে কাজ শেষ করার পর ফেরার পথে র্যাব সদস্যরা তাঁকে অপহরণ করেন।’
আজ সকালে সোয়া ১০টার দিকে রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন মোট ২৩ আসামি। এ মামলার বাকি ১২ জন পলাতক।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আটক ২৩ আসামির মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় মোট ১০৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তবে তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনায় তাঁর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে, তাঁর গাড়িচালক মিজানুর রহমান দীপু জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের খানসাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের পাশ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তাঁর সহযোগী সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করে র্যাব-১১।
পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের এবং ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল আলাদা দুটি মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আদালতে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
এরপর বিভিন্ন সময়ে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পলাতক থাকেন ১৩ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর ১৩ নভেম্বর সাত খুনের দুটি মামলাসহ ১১ মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। ফলে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩-এ। সাত খুনের মামলায় হত্যার দায় স্বীকার করে র্যাবের ১৭ জনসহ ২২ জন এবং ঘটনার সাক্ষী হিসেবে র্যাব সদস্যসহ ১৭ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে অভিযোগপত্র থেকে পাঁচ আসামিকে বাদ দেওয়ায় এবং প্রধান আসামি নূর হোসেনের জবানবন্দি ছাড়া আদালত অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ায় ‘নারাজি’ আবেদন করেন সেলিনা ইসলাম বিউটি। আবেদনটি নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম ও জজকোর্টে খারিজ হয়ে গেলে বিউটি উচ্চ আদালতে যান।
হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, পুলিশ চাইলে মামলাটির ‘অধিকতর তদন্ত’ করতে পারে এবং ‘হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার’ ধারা যুক্ত করে নতুন করে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে। তবে তদন্তকারী সংস্থা জানায়, তাদের অভিযোগপত্র ‘নির্ভুল ও চমৎকার’।