ভক্ত-পুণ্যার্থীতে মুখরিত নরসিংদীর বাউলমেলা

বছর ঘুরে আবারও এসেছে নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাউলমেলা। সপ্তাহব্যাপী এ বাউলমেলাকে ঘিরে চলছে মহাধুমধাম। ভক্ত ও পুণ্যার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছে মেঘনা নদীতীরের বাউল আখড়া।
বাউল সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৬০০ বছর ধরে প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে শহরের কাউরিয়াপাড়ায় অবস্থিত শ্রীশ্রীবাউল ঠাকুরের আখড়ায় এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এর এক মাস আগে শিবপুর উপজেলার তেলিয়া বাজারে পূজা অর্চনার মাধ্যমে মেলার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া বাউলমেলা চলবে আগামী সোমবার পর্যন্ত। মেলায় ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েকশ বাউলসাধক যোগ দিয়েছেন।
আয়োজকরা জানান, আজ শুক্রবার মাঘী পূর্ণিমার তিথিতে শ্রীশ্রীবাউল ঠাকুরের মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মেলার উদ্যোক্তা ডা. সাধন, মৃদুল, মিন্টু ও প্রাণেশ বাউল এই মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সার্বক্ষণিক তদারকি করেন।
মেলায় কৃষি উপকরণ, কৃষিপণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, গৃহের আসবাবপত্র, গৃহস্থালির তৈজসপত্র, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, খেলনা, মিষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও কাঠের তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কেনাবেচা চলে।
কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আসা সুমন বাউল বলেন, ‘জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কীভাবে সহজে মানুষ নিজকে নিজে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার ওপর নাই। আমরা গানের মাধ্যমে চিরন্তন সেই সত্য কথাটিই সবার মধ্যে প্রচার করছি।’
বৈঠকে যোগ দেওয়া বাউল মিনাক্ষী বলেন, ‘আত্মরূপে সবার মধ্যে ভগবান অবস্থান করছে। আমরা গানের মাধ্যমে তাঁরই অন্বেষণ করার জন্য এখানে এসেছি। এই ভাবটা যদি সবার মধ্যে থাকে তাহলে আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধি হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার মধ্যে যে ভগবান বিরাজ করছে, সেই ভগবান আপনার মধ্যেও বিরাজ করছে। তাহলে আমি ইচ্ছা করলেও আপনাকে কষ্ট দিতে পারব না। আঘাত করতে পারব না। এই ভাবটা যদি পুরো জগতের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে জঙ্গিবাদ পৃথিবী থেকে উঠে যাবে।’
মেলায় আগত ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে বাউল ঠাকুরের সমাধিতে প্রদীপ প্রজ্বালন করেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন। পরে দুপুরে জগৎবন্ধু ঠাকুরের মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়।
শ্রীমঙ্গল থেকে আসা শংকর লাল পোদ্দার বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা বাউলমেলায় আসছি। আগে আমাদের বাপ-দাদা এই মেলায় আসত। এখন আমরা আসছি। সারা বছর এই মেলার অপেক্ষায় থাকি। মেলায় নিজের ও পরিবারের জন্য ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করি।’
বাউল আখড়ার তত্ত্বাবধায়ক বাউল ডা. প্রাণেশ কুমার বলেন, ‘দেশ ও বিদেশ থেকে কয়েকশ বাউল ও আমাদের অনুসারীরা এই মেলায় যোগ দিয়েছেন। মানবের মিলনের তাগিদে তাঁরা সবাই এখানে মিলিত হয়েছেন। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই। আমাদের বিশ্বাস, একদিন ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে পৃথিবীর সবাই একটি ধর্মে মিলিত হবে। আর সেটা হলো মানবধর্ম।