মানবপাচার : শরীয়তপুরে প্রকাশ্যে ঘুরছে দালালরা
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/06/10/photo-1433880651.jpg)
স্থানীয় দালালদের প্রলোভনে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সখিপুর থানার আট যুবক নিখোঁজ হয়েছেন। তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। বাকিরা তিন মাস আগে রওনা হয়েছেন। খবর আসবে এই আশা নিয়ে এখনো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তাঁদের পরিবারের স্বজনরা।
এই ঘটনায় স্থানীয় মোবারক খানের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ এনে নড়িয়া থানায় মামলা করেছেন ছিডু মাদবরেরকান্দির নিখোঁজ তিন যুবকের স্বজনরা। কিন্তু আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মোবারক।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে অভাবের তাড়নায় শিশুসন্তানদের নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাড়ি ও আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নিখোঁজ হারুন খান ও মনির হাওলাদারের স্ত্রী-সন্তানরা।
নিখোঁজদের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, নড়িয়া উপজেলার ছিডুমাদবরের কান্দির দালাল মোবারক খান একই গ্রামের তিন ব্যক্তিকে জাহাজে করে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেবে বলে রাজি করান। মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিতে জনপ্রতি দুই লাখ ৪০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। ২০১৩ সালের ১২ মে মৃত রফিজ উদ্দিন খানের ছেলে হারুন খান (৩৫), মালেক হাওলাদারের ছেলে মনির হাওলাদার (২৭), খোকন দেওয়ানের ছেলে রুবেল দেওয়ান (১৭) নামের তিন যুবকের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে মোবারক তাদের নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু টেকনাফ থেকে ট্রলারে উঠিয়ে দিয়ে দালাল মোবারক ফিরে আসেন। এরপর দীর্ঘ দিন পার হয়ে গেলেও ওই তিন যুবকের কোনো খোঁজ পায়নি পরিবারের সদস্যরা। পরে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা থাইল্যান্ডে আটকা পড়েছেন বলে জানান দালাল মোবারক।
একই বছরের (২০১৩) ১৭ জুলাই নিখোঁজ রুবেলের মা হালিমা বেগম বাদী হয়ে দালাল মোবারক খান, তাঁর ভাই জিয়াউর রহমান খান ও দালালের সহযোগী পলাশ মাদবরকে আসামি করে একটি মামলা করেন। আসামিরা আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন।
এদিকে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে শিশুসন্তান মিম আক্তার (৪) ও রায়হান খানকে (৩) নিয়ে আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নিখোঁজ হারুন খানের স্ত্রী বিউটি বেগম। আর মনির খানের স্ত্রী দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাবার বাড়িতে।
ছেলে ফিরে আসার আশার পথ চেয়ে বসে আছেন হালিমা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ছেলের পথ চেয়ে থাকি। দিন গিয়ে বছর গড়িয়ে গেছে ছেলে তো আর আসে না। বিচার চেয়ে মামলা করেছি। দালালরা সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। দালালদের বিচার দেখে মরতে চাই।’
শুধু তরাই নয়, নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের কান্দাপাড়ার আবু তাহের হাওলাদার (৩৫),আলমগীর হাওলাদার (২৮) ও আইটপাড়ার নাছির ঢালী (৩০) প্রায় তিন মাস আগে একই ইউনিয়নের দিগম্বরপট্রি গ্রামের মানব পাচারকারী মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুল খানের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। মালয়েশিয়া পৌঁছালে আব্দুল খানের বাবা মনছুর খানের হাতে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে তারা বাড়ি ত্যাগ করে। দীর্ঘদিন থেকেই আব্দুল খান মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে মানুষ জোগাড় করে বিভিন্ন পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ করে মানব পাচার করে আসছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, গত এক বছরে এই পথে শুধু বিঝারী ইউনিয়ন থেকেই প্রায় ৫০ জন মানুষ পাচার করেছে আব্দুল খান। তিন মাস পার হয়ে গেলেও এই তিন যুবকের এখনো কোনো সন্ধান মিলেনি।
নিখোঁজ আলমগীর হাওলাদারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী লাকি বেগম বলেন, ‘প্রায় তিন মাস আগে বাড়িতে কিছু না বলেই ও চলে যায়। টেকনাফে গিয়ে ট্রলারে উঠে আমাদের ফোন করে জানায় আমি মালয়েশিয়ার পথে জাহাজে রয়েছি। তোমরা টাকার জোগার করে রাখ। আমি পৌঁছে ফোন দিলে মনছুর খানের কাছে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা পৌঁছে দিও। ’
অন্যদিকে, নড়িয়ার নওয়াপাড়ার মানবপাচারকারী আরশাদুল শিকদারের দেখানো পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন সখিপুর থানার চরভাগা ইউনিয়নের ঢালীকান্দির দিদার মোল্লা (৩৮) ও মো. হানিফ বেপারী (৩০) নামে দুই যুবক। প্রায় তিন মাস আগে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে পাচারকারী আরশাদুল শিকদার টেকনাফ থেকে তাঁদের ট্রলারে তুলে দেন।
নিখোঁজ দিদারের স্ত্রী তাছলিমা বেগম বলেন, ‘দালাল আরশাদুল আমার স্বামীকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে জাহাজে উঠিয়ে দিয়েছে। এখন তিন মাস ধরে তাঁর কোন খোঁজ পাচ্ছি না। ’ যোগাযোগ করা হলে আরশাদুল বলেন, ‘ওরা থাইল্যান্ডে আটকা পড়েছে। দুই-একদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে তোমরা টাকার জোগাড় কর।’
নড়িয়া উপজেলার ছিডু মাদবরের কান্দির মানবপাচারকারী মোবারক দালালের দাবি, তিনি মানবপাচারকারী নন। তাঁর ভাই মালয়েশিয়ায় থেকেই সব কিছু করেন। যাঁরা মালয়েশিয়া পৌঁছায় তাদের স্বজনদের কাছ থেকে শুধু টাকা গ্রহণ করেন তিনি। অন্য মানবপাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কাউকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, অবৈধ পথে মানবপাচারের বিষয়টি পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। কোনো মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনের আওতায় আনা হবে।