সাক্ষাৎকার
‘বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে আসি’

ড. কামাল হোসেন। বাংলাদেশের সংবিধান বললে ওই নামটিই চলে আসে। তিনি ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান। কিংবদন্তি আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের ব্যক্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘদিন হয়েছে। গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
গত ২০ এপ্রিল ছিল কামাল হোসেনের ৮০তম জন্মদিন। ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পা দিয়েছেন ৮১ বছর বয়সে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে এ স্বপ্ন দেখেন তিনি। এ নিয়ে তিনি আশাবাদীও।
কামাল হোসেনের স্ত্রী মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন। দুই সন্তান। সারা হোসেন একজন ব্যারিস্টার। দিনা হোসেন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেন।
নিজের জীবন ও বাংলাদেশ নিয়ে কামাল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে দিয়েছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব। রাজধানীর নিউ বেইলি রোডের (নাটক সরণি) বাসায় ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকের হোসেন।
এনটিভি অনলাইন : রাজনীতিতে এলেন কীভাবে?
ড. কামাল হোসেন : ১৯৬৬ সালে প্রথম বারের মতো বার কাউন্সিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমি ওই নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হলাম। ১০ জনের মধ্যে সবেচেয়ে জুনিয়র অইনজীবী হিসেবে আমিও বিজয়ী হলাম। আমাকে ভাইস- চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হলো। পরে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করা হলো। পরে আমি আইনি নোটিশ প্রদান করি। ওই নোটিশের পর একটা সময় বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দিল। সেখানে ছাত্ররা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার দলে যোগদান কর।’
রাজনীতি করার চিন্তা মাথায় ছিল না। পরিকল্পনা করেও আসা হয়নি। ভাগ্য বলেন আর আল্লাহর রহমত বলেন, দুটোই আমাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ১৯৬০-৬১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। উনার জামিনের জন্য সরোজি সাহেব গেছেন। আমি ও পেছনে পেছনে গিয়েছি। আমি বলতাম মুজিব ভাই। দেখার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, কামাল তুমি আইনজীবী হলে অনেক টাকা আয় করতে পারবে এটা সত্য। কিন্তু রাজনীতি করলে মানুষের ভালোবাসা পাবে। মানুষের সেবা করার সুযোগ রাজনীতি করে যেভাবে সম্ভব সেটা আর কোনোভাবে সম্ভব নয়।
তখন সারাদেশে মার্শাল ল’ চলছিল। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাহেবের বাসায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী থাকত, আমিও যেতাম। ওখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই কথা বলি যে,মার্শাল ল’ কতদিন চলবে? তো উনি বললেন যে পাঁচ বছর, খুব বেশি হলে ১০ বছর। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। যখন ১৯৬৯ এ আইয়ুব ক্ষমতা থেকে চলে যায়, তখন আমি উনাকে বলেছি আপনি কীভাবে অঙ্ক করলেন? ঠিক আপনার কথা মতোই তো আইয়ুব খান বিদায় নিচ্ছে। তখন বঙ্গবন্ধু হাসলেন। এসব ব্যাপারে উনার অসাধারণত্ব আমি খেয়াল করেছি। এভাবেই উনার সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি।
এনটিভি অনলাইন : এরপর ছয় দফা ...
ড. কামাল হোসেন : বাংলাদেশ নামক একটি দেশ প্রতিষ্ঠার দাবি শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। ‘ছয়দফা’ আন্দোলনের মাধ্যমে। জাতীয় সংসদে শতকরা ৫৬ ভাগ থাকার পরও সরকারি চাকরিতে বৈষম্য করা হচ্ছিল। এ দেশের মাত্র পাঁচভাগ মানুষকে সরকারি চাকরি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দ না দিয়ে মনগড়া বরাদ্দ দেওয়া হতো। আমাদের দাবি ছিল, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে জাতীয় বরাদ্দ দিতে হবে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা তুলে ধরা হলে আইয়ুব খান ঘোষণা দিল অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় আইয়ুব খানের। মামলা থেকে তাঁকে মুক্ত করে ছাত্রসমাজ শেখ মুজিবুর রহমানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধি দেয়।
এনটিভি অনলাইন : প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হলেন, মুক্তিযুদ্ধও চলে এলো
ড. কামাল হোসেন : সারাদেশে ছয়দফা বাস্তবায়ন অথবা এক দফা (স্বাধীনতা) দাবি করা হয়। পরে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসলামাবাদে গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দফার দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের আলোচনা চলতে থাকল। ছয়দফার বিষয়ে আমরা আপসহীন থাকলাম। এরইমধ্যে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তিনি মার্শাল ল’ জারি করেন। আমরা ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দসহ সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব দিলে ইয়াহিয়া খান আনুষ্ঠানিক ভাবে মেনে নিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন পাচ্ছিলাম না। পরে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হলো। নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আমরা জয়লাভ করলাম। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পুরানো ঢাকা এবং তেজঁগাও এলাকা দুটি আসন থেকে জয় লাভ করলেন। পরে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন আমাকে তো একটি আসন ছাড়তে হবে। তুমি তেজঁগাও আসন থেকে সংসদে আস। আমি উপনির্বাচন করলাম। বঙ্গবন্ধুর আসনের কারণে আমার বিপরীতে কেউ প্রার্থী হতে সাহস করল না। আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলাম। প্রথম বারের মতো আওয়ামী লীগের সংসদ হলাম। কিন্তু নির্বাচনের পরও পশ্চিমা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহনা শুরু করল।
নির্বাচনের ফলাফল দেখে ভুট্টো আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। ভুট্টো আর সংসদীয় অধিবেশন ডাকেন না। এতে সংসদ সদস্যরা একত্রিত হয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে করণীয় সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়। সেখানে ঘোষণা হলো ছয় দফার বাস্তবায়ন অন্যথায় এক দফা (স্বাধীনতা)।
অবশেষে চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশনের ঘোষণা দিলেন। আমরা সংবিধান তৈরির জন্য চেষ্টা করলাম। এরই মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি আমরা গোপন সূত্রে জানতে পারলাম অধিবেশন মুলতবি করা হবে। পরে রেডিওতে ১ মার্চ বলা হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি করা হলো। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিকেলে হোটেল পূর্বাণীতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন,‘আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত।’ ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন, বিমান, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক-বিমা অফিস-আদালত সব কিছুর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ল। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন এ ধরনের ঘোষণার জন্যই অপেক্ষা করছে বাংলার মানুষ। সরকারি চাকরিজীবীরা রাস্তায় নেমে এলো। কিন্তু হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, থানা খোলা রাখা হলো। এ সময় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হলো। অতিরিক্ত সচিব সানাউল হকের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিজীবীরা এসে ঘোষণা দিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকারি অফিস-আদালত চলবে।
এ সময় পূর্ব বাংলার সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চলছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগুলো এমনভাবে পালন করছে যে, পাট রপ্তানির দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা পাট রপ্তানি বন্ধ করে দিল। প্রেসিডেন্টের ঘরে রান্না পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলার মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সর্বত্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এ সময়টা এক কথায় পূর্ব বাংলা সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চলছে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। অবশ্য অন্যায়কে প্রতিরোধ করা যে বাঙালির ঐতিহ্য, তার প্রমাণ ওইসময় আমরা পেয়েছি। এই ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৫৮ সালে দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইয়ুবের মাশাল ল-এর প্রতিবাদের মাধ্যমে। এ সময় ছাত্রসমাজ তাঁর শাসনব্যবস্থাকে এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আইয়ুবের কাছ থেকে ডিগ্রিগ্রহণ করেনি। এ কারণে ওইসব ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
এনটিভি অনলাইন : উত্তাল হয়ে গেল মার্চ, গ্রেপ্তারও হলেন।
ড. কামাল হোসেন : এদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। সর্বক্ষণ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অবশেষে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। ৬ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আমাকে ৭ মার্চ ভাষণের খসড়া তৈরির নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় আমার বন্ধু এম আমীর-উল ইসলামও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন- এমনভাবে ভাষণ দিতে হবে যেন, আর্মিরা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ না চালায়। আমরা যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করি তাহলে আর্মিরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। এরই মধ্যে ৭ মার্চ দুপুরের পর শুরু হলো বক্তব্য। এ সময় হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদের ওপর পাক আর্মিরা মেশিনগান তাক করে বসে আছে। যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়, তাহলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কৌশলে বক্তব্য দিলেন সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল এবং এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় পশ্চিমারা পাগল হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এটার সমাধান কী? আমি উত্তরে বললাম, দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো স্বাভাবিক পথ,অর্থাৎ ছয় দফা মেনে নেওয়া অন্যটি হলো অস্বাভাবিক পথ, অর্থাৎ যুদ্ধ। তবে মনে হচ্ছে পাক বাহিনী অস্বাভাবিক পথ বেছে নিচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তাঁর কাছে সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান নীরব থাকেন এবং সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন শুরু করে। এ ছাড়া আমরা জানতে পারলাম জাহাজে ও বিমানে করে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা অবতরণ করছে। দেখতে দেখতে ২৫ মার্চ এসে গেল। সারাদেশে যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। মানুষ বুঝতে পারছে দেশে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
অবশেষে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে বললেন। আমি এবং আমীর-উল ইসলাম একত্রে তাজউদ্দীনের ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে তাঁর বাড়িতে উঠলাম। রাত ৮টার দিকে তিনি তাঁর প্রতিবেশী এম আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যখন সাত মসজিদ রোডের দিকে যাচ্ছিলেন তখনই তাঁরা খবর পান যে রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গাছ কেটে ব্যারিকেড বসিয়েছে। এই সময় মোজাফফর নামের কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য আমাদের জানান যে নিউমার্কেটের সামনে ইপিআর অবস্থান নিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকায় না গিয়ে আপাতত ধানমণ্ডির আশপাশে আত্মগোপনের উদ্যোগ নিলাম। এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাই। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার পর দেখলাম বঙ্গবন্ধু রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমরা গিয়ে তাঁকে আত্মগোপনের কথা বললে তিনি অস্বীকার করেন। একইসঙ্গে আমাদের দ্রুত আত্মগোপনে যেতে বলেন। আমরা লাল মাটিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকা ঠিক হবে না। রাতের পরিস্থিতি বুঝে আলাদাভাবে থাকার পর সকালে নদী পার হয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাব। অবশেষে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামকে বিদায় দিয়ে আমি লালমাটিয়ায় এক আত্মীয়র বাসায় উঠলাম। পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা আমাকে ছেড়ে চলে যান। পরে চারদিন বাড়ি পরিবর্তন করে থাকার পর লালমাটিয়ায় একটি বাসা থেকে ৩০ মার্চ আমাকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সন্ধ্যার সময় আমাকে আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক আর্মি অফিসার আমাকে বলেন, ‘তোমার নেতাকেও এই জায়গায় রাখা হয়েছিল। তুমিও এখানে থাক।’ প্রথম বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একদিন রাখার পর ৩১ মার্চ বা ১ এপ্রিল আমাকে একটি বিমানে করে প্রথমে করাচি পরে ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে রাখা হয়। কারাগারে একটি লকআপে শুধু আমি একাই ছিলাম। পরে সেখান থেকে হরিয়ানাপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্জন একটি কক্ষে আমাকে রাখা হয়। যেখানে গার্ডদের সঙ্গেও কথা বলা নিষেধ ছিল আমার। এ সময় একটি রুটি ও ডাল দেওয়া হতো খাবার হিসেবে। থাকার জন্য ভিআইপি হিসেবে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ নয় মাস নির্জন সেলে বন্দি করে রেখে আমার কাছ থেকে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে তাজউদ্দীন সাহেবের অবস্থান এবং ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় জানতে চেয়ে বারবার চাপ দেয়। এমনকি তাদের সহযোগিতা না করলে খারাপ পরিণতির হুমকিও দেওয়া হয়। তারা জানায় যে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও অনুরূপ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা তারা করছে। অবশেষে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আমার বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে।
পাকিস্তানের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের নোটিশ আমার কাছে ৫ সেপ্টেম্বর এসে পৌঁছায়। লে. কর্নেল ওয়াজির খান মালিক স্বাক্ষরিত নোটিশে একটি বিশেষ আদালতে অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিচারকাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে হঠাৎ করেই অক্টোবরের শেষ দিকে সর্বত্র একটি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিচারকাজ পিছিয়ে যায়। জেলের রং পরিবর্তনসহ বেশ কিছু তৎপরতা বেড়ে যায়। ঘনঘন সামরিক বিমানবহরের উড়ে চলা, সাইরেনের শব্দ, জেলসহ সর্বত্র ব্ল্যাক আউটের যুদ্ধের মহড়া ইত্যাদি বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে একদিন সাইরেন বেজে উঠল। লকআপ থেকে বের করে বাইরে শীতের মধ্যে একটি গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। জানতে পারলাম কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। তাই আমাকে লকআপের বাইরে আনা হয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পরে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটিকে বুঝিয়ে আবার লকআপে চলে গেলাম। এভাবে দিন কাটতে লাগল।
এনটিভি অনলাইন : নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলল। দেশ স্বাধীন হলো। আপনি কারাগারে। কীভাবে বুঝলেন দেশ স্বাধীন হয়েছে?
ড. কামাল হোসেন : ১৬ ডিসেম্বর হঠাৎ দেখলাম খাওয়া-দাওয়া পরিবর্তন। তাদের (কারারক্ষী) ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। এত দিন ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতাম। দেখি, আমার রুমে সোফা আনা হচ্ছে, গালিচা আনা হচ্ছে, একটি খাট দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে বললাম, কী ব্যাপার এত মাস পর হঠাৎ এত পরিবর্তন কেন? সঠিক কোনো উত্তর পেলাম না। তবে অনুমান করলাম বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে পশ্চিমা আর্মিরা পরাজিত হয়েছে।
অবশেষে ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করে জেল সুপার এসে আমাকে সব কিছু গোছগাছ করে তৈরি হতে বললে বিস্মিত হলাম। কাপড়-চোপড় এমনকি বই-পুস্তক যা এত দিন জেল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিল, সব দিয়ে গেটের সামনে এনে গাড়িতে তুলে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আনার পর সিহালার নির্মাণাধীন পুলিশ দপ্তরের একটি বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৫ মার্চের কালরাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শেষ সাক্ষাতের দীর্ঘ নয় মাস পর ২৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির সিহালার এক বাংলোতে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। এ সময় আমরা পরস্পরকে আবেগে জড়িয়ে ধরলাম।বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে পারলাম রাওয়ালপিন্ডির মিওয়ানওয়ালী কারাগারে তাঁকে এই দীর্ঘ নয় মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এর মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখা করে শিগগিরই আমাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থার কথা জানান। তবে নানা অজুহাতে অহেতুক যাত্রা বিলম্বিত করতে থাকে। বিশেষ করে ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলোভীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যেকোনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যথাশিগগিরই দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ভুট্টোকে চাপ দিতে থাকেন।
অবশেষে ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো করাচি বিমানবন্দর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসেন এবং একটি পাকিস্তানি বিমানে করে পরের দিন সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুসহ আমি লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে নামি। পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত আমাদের যাত্রার খবর গোপন রাখা হয়। লন্ডন থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বের অবস্থান থেকে জানানো হয় যে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘণ্টার মধ্যে হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। অতি অল্প সময়ের নোটিশে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে ছুটে আসেন স্যার ইয়ান সাউদারল্যান্ড। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে ছুটে আসেন ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারোল্ড উইলসন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট, রেজাউল করিম, এ কে খান, বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী প্রমুখ দেশি-বিদেশি কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত লন্ডন ফিরে এসে নিজের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত বিমানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন। ওরই মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর যাত্রার সময় ইত্যাদি ঠিক করে ফেলা হয়। অবশেষে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে সাইপ্রাস-শারজাহ ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের মাটিতে আমি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবতরণ করলাম।
পাকিস্তান সরকার ৬/৭ জানুয়ারিতে আমাদের বিমানে তুলল। আমরা বলেছি যে ডাইরেক্ট ঢাকা নিয়ে চল। তাঁরা (পাকিস্তান সরকার) বলল যে যুদ্ধ হয়েছে তারপরে তো এয়ার স্পেস বন্ধ। আমরা ভারতের ওপর দিয়ে ফ্লাই করতে পারব না। তো আমরা বললাম যে, আমাদের জাতিসংঘের প্লেন অথবা রেডক্রসের প্লেনে দিয়ে দাও। ওরা বলল ইরান বা তুরষ্ক। বঙ্গবন্ধু বলল ওই সব দেশে না কোনো নিউট্রাল দেশে। জেনেভায় নিয়ে যেতে পারো, সুইজারল্যান্ড। তো তাঁরা হঠাৎ করে বলে ফেলেছে যে লন্ডনে আমরা নিতে পারি। তো বঙ্গবন্ধু বললেন যে আর তো কোনো কথাই নেই। লন্ডনে আমরা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের লোক পাব। তুমি ইমিডিয়েটলি বল যে, লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুক। তো এইভাবে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বলল যে, ৬/৭ তারিখে আমাদেরকে নেবে। তো ৬ তারিখ রাতে ৭ তারিখ সকালে আমরা প্লেনে উঠলাম। লন্ডনে এসে পৌঁছেছি ৮ তারিখ।
এনটিভি অনলাইন : ফাঁসির মঞ্চ থেকে দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু ...
ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধু তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে এসেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, উনার জীবনটা উনি ফিরে পেয়েছেন। উনার তো মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়ে যায় পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায়। ইয়াহিয়া খান নাকি ভুট্টোকে বলেছেন যে, দেখ তুমি তো এখন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছ। ওই ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধু) তো মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। তো ওকে ফাঁসি দিয়ে দাও। আমি অর্ডারটা সই করে দিচ্ছি। বিচারটা হয়েছে আগস্ট মাসে। মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। আমি ওটাকে কার্যকর করার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।
এনটিভি অনলাইন : নতুন দেশের সংবিধান প্রসঙ্গে ...
ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশে ফেরার পর তিনি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেন। ১৯৭২ সালে আমাকে আইনমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হলো। একইসঙ্গে সংবিধান তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আমাকে কমিটির চেয়ারম্যান বানালেন। কমিটিতে তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলীর মতো তুখোড় নেতারা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরেই তাঁদের অবস্থান। আমি তাঁদের তুলনায় একেবারে জুনিয়র ছিলাম। তাই সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যান থাকতে আপত্তি করলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুমি তো আইনমন্ত্রী হিসেবে পদাধিকার বলে এ কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছ। তুমি চেয়ারম্যান থাকবে। বঙ্গবন্ধুর এসব সততাই আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করে। পরে আমরা বিভিন্ন দেশের সংবিধানের কিছু নমুনা দেখে কাজ শুরু করি।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর একটি খসড়া সংবিধান পেশ করার পর এটি গৃহীত হয়। পরে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা স্বাক্ষর করলাম এবং ওইদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়।
সংবিধান প্রণয়নে চারটি মূলনীতি ছিল। এরমধ্যে প্রথমত; জাতীয়তাবাদের চেতনার উৎস আমরা পেয়েছি ভাষা আন্দোলন থেকে। দ্বিতীয়ত হলো, গণতন্ত্র। এটি পেয়েছি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও পাকিস্তানিদের আমাদের ওপর চেপে বসা। এই জায়গা থেকে আমরা গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনলাম। তৃতীয়টি হলো, সমাজতন্ত্র। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। ওই বৈষম্য দূরীকরণে আমরা সমাজতন্ত্র সংযুক্ত করেছি। চতুর্থটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের এটি একটি অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মুলনীতি। পশ্চিমা শাসকরা ধর্মের নামে আমাদের ওপর অনেক অবিচার করেছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশ রক্ষার নামে তারা আমাদের মা-বোনদের গণধর্ষণ করেছে। মুসলমান হয়ে মুসলমানকে এভাবে মারা, নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা মহা অন্যায়। ধর্মকে রাজনীতিতে অপব্যবহার করা হবে তা আমরা চাইনি। আমরা চাইনি ধর্মকে টেনে আনতে। কিন্তু সবাই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য যেন না হয় এবং কোনো ধর্মের নামে যেন রাষ্ট্র না হয়।
১৯৭১ সালে পাক সৈনিকরা বলল তারা ধর্মের জন্য জিহাদ করছে। জিহাদের নামে তারা গণহত্যা, ধর্ষণ করেছে। ধর্মকে অপব্যবহার করছে। এ ছাড়া মুসলামান হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে তাঁরা জিহাদ করল। এখনো শুক্রবারে তারা জিহাদের নামে মসজিদে হামলা করে। হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে মারছে।
সংবিধানে আমরা চারটি মৌলনীতির ওপর জোর দিয়েছি। আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা,১৯৪৯ সালে দেশ ভাগ,আমাদের ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ত্যাগ ও মনের ভাষা আমরা অনুভব করে সংবিধান সাজিয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়করা সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন কি না?
ড. কামাল হোসেন : আমাদের তো মূলনীতি হিসেবে সপ্তম অনুচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা সংযুক্ত করা হয়েছে। এ সার্বভৌমত্বের মালিক হবে জনগণ। দেশ শাসন করবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তারপর মৌলিক অধিকারের একটি পর্ব রয়েছে। সেখানে সভা সমিতি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চিত্র রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র তো বর্তমানে কেবল কাগজে কলমে আছে। ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ১৯৯৬ সালে বিএনপি যে নির্বাচন করল সেখানে সংবিধানের সংকট তৈরি হলো। তখন একটা সংশোধনী আনা হলো-সেখানে বলা হলো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই সময় একজন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করবেন। পরে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন করা হলো তা বাতিল করা হলো। পরে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে নতুন করে নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তারা যে ক্ষমতাচ্যুত হলো ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ প্রথম বারের মতো ক্ষমতায় আসল। তখন একটি সংশোধন আনা হলো। ১৯৯৬ সালে একটি সংশোধনী আনা হয়। প্রথম বারের মতো আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়। এই বিধানটাকে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বাতিল করে। বেশির ভাগ দল এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বিষয়ে সরকার বলেছে সংবিধানের শূন্যতা রক্ষা করতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৯০ দিনের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার কথা ছিল। আমি সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে বলেছি, অতীতের দিকে না তাকিয়ে সংবিধান যেন শূন্যতা সৃষ্টি হয় সে জন্য এ নির্বাচন হয়। পরে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমন একটি নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নির্বাচনটা হলো না। তিন বছর তো শেষ হয়ে গেল। নির্বাচনের কোনো খোঁজখবর নেই। তারা এখন বলছে ২০১৯ সালে নির্বাচন হবে। তার মানে পাঁচ বছরকে তারা বৈধ নির্বাচন হিসেবে গণ্য করল।
এনটিভি অনলাইন : আওয়ামী লীগ থেকে বের হলেন কেন?
ড. কামাল হোসেন : আমি যখন দেখলাম ৬৯ সালে যে রাজনীতি আর বর্তমান রাজনীতি এক নয় তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে বের হয়ে যাই। এখন রাজনীতির পরিবর্তে রাজ চালাকি চলছে। রাজনীতিতে এসেছিলাম মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। গরিব বস্তিবাসীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য, দেশের সেবা করার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এ নীতি এখন আর নেই। এখন শুধু টাকার খেলা, মনোয়ন বাণিজ্য,পদ বাণিজ্য চলছে। টাকা দিয়ে সারা দেশ থেকে মানুষ আনা হয় আন্দোলন করার জন্য। অথচ বঙ্গবন্ধুর আমলে সারা দেশের মানুষ হেঁটে ঢাকায় আসত। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সাইকেলে চড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় এবং জমির সরু রাস্তার দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছেছেন। যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নেই তখন আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসেছি এবং রাজনীতির ওপর এক ধরনের খারাপ ধারণা চলে আসে। আমি কিন্তু প্রথমে এসে একটি অধিকার আদায়ের সংগঠন করি। শুরুতে কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠন করিনি।
এনটিভি অনলাইন : জঙ্গি ইস্যু নিয়ে কিছু বলুন।
ড. কামাল হোসেন : ধর্মের একটা অপব্যবহার হচ্ছে। এটি এখন সারা বিশ্বে হচ্ছে। এটি হতে পারে না। ধর্মের নামে নারী-পুরুষ শিশু সবাইকে হত্যা করা হচ্ছে- এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করা হচ্ছে। কোনো ধর্মেই এটি গ্রহনযোগ্য নয়। ধর্মের সঠিক জ্ঞান না থাকায় এসব হচ্ছে।
এনটিভি অনলাইন : ভবিষ্যতে দেশকে কীভাবে দেখতে চান?
ড. কামাল হোসেন : অসাধারণ সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। কৃষক মাঠে ফসল করছে, শ্রমিকরা বিশেষ করে মেয়েরা দিনরাত কাজ করে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে। গণচীনের পরই আমাদের অবস্থান। আমাদের ছেলেরা বিদেশে কাজ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এ সার্বিক উন্নতি দেখে আমি আশাবাদী। সরকারের কেউ কেউ বলছে আগামী কয়েক বছরে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি করব।
আমি চাই এ দেশের জনগণ দেশের মালিকের ভূমিকায় থাকবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকবে তাঁদের জবাবদিহিতা থাকবে। জনগণের মতামত নিয়ে এবং তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আইন প্রণয়ন করা হবে। বৈষম্য থাকবে না। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ হবে। আইনের শাসন থাকবে। আইনের শাসন কাগজে কলমে আছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ ছাড়া বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নিয়ে একটি রায়ও হয়ে আছে। কিন্তু কার্যকর হলো না। আশা করি দূত কার্যকর হবে। কার্যকর না হওয়াতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। টাকার খেলা যেন না হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা হবে বলে আমি মনে করি। নির্বাচন বাণিজ্য, মনোয়ন বাণিজ্য যেন না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। টাকা খেলা বন্ধ করা ও অস্ত্রবাজি না থেকে মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারলে আমি মনে করি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তাহলে সবাইর মতামত নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এনটিভি অনলাইন : দেশ কি সঠিক পথে এগুচ্ছে?
ড. কামাল হোসেন : জনগণ থেকে যাচাই করতে পারেন। যেখানে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় সেখানে কীভাবে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? এজন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৮০ সালের অপশাসন জনগণ মেনে নেয়নি। বর্তমানের এ অপশাসনও জনগণ মানবে না। পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি। গুম, খুন, হত্যা এগুলো অন্ধকার। তরুণ সমাজ এগুলো মেনে নিতে পারে না। এগুলোর সমাপ্তি হবেই।
এনটিভি : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ড. কামাল হোসেন : এনটিভি অনলাইনকেও অনেক ধন্যবাদ।