শতকোটি টাকার গম আত্মসাৎ, তিন বছর পর মামলা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা শতকোটি টাকার গম লুটপাট হওয়ার ঘটনায় দক্ষিণ কোরিয়ার ‘মেরিট ফায়ার অ্যান্ড মেরিন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের’ পক্ষে মামলা করা হয়েছে।
গত বুধবার চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে কোরিয়ান কোম্পানির পক্ষে মামলাটি দায়ের করেন সোহেল রানা নামের এক ব্যক্তি। মামলায় ব্যবসায়ী ও যুবলীগ নেতাসহ খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাতজনকে আসামি করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন নুরুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, আক্তারুজ্জামান খান মামুন, আবদুল মালেক মাঝি, সাইফুল ইসলাম, আবদুস সালাম ও শওকত হোসেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী আমিরুল ইসলাম নাজির মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আদালত মামলাটি গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বন্দর থানাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে একই ঘটনায় গত ২০ জুলাই হাইকোর্টে আরেকটি ক্ষতিপূরণ মামলা করা হয়। মামলায় পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তাঁরা সবাই গত বুধবার করা মামলারও আসামি।
মামলার আসামিদের মধ্যে আবদুল মালেক মাঝি আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। অন্য আসামি সাইফুল ইসলাম জামিন নিতে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম তাঁর জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন সাইফুল। অন্য পাঁচ আসামি পলাতক।
মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৭ মে পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থানার পোর্ট কলোনি এলাকায় টিসিবির নয়টি গুদামে ওই গম সংরক্ষিত ছিল। বিক্রির বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কোম্পানি লিমিটেডের ৫০ হাজার টন গম সরবরাহের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই ১৯ হাজার ৫০০ টন গমের একটি চালান নিয়ে ‘এমভি ব্রেভ লিডার’ নামের একটি জাহাজে করে মোংলা বন্দরে আসে।
পরবর্তীকালে রোমানিয়া থেকে ‘এমভি ভাইরিস্তা’ নামের একটি জাহাজে করে ৩৩ হাজার টন গমের দ্বিতীয় চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওই গম প্রতারণা করে দেশের বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ১১ মার্চ মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান চো ম্যান উগ বাদী হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থানায় নিরাপত্তার জন্য জিডি করেন।
পরে একই বছর ৩১ মে চট্টগ্রাম বন্দর থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন খুলনার শেখ আবদুল আজিজ। মামলাটির তদন্ত প্রথমে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া হয়। দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এ ছাড়া তাঁদের বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এমনকি বিদেশ গমনেও বাধা দেওয়া হয়নি।
আবদুল আজিজ জানান, তিনি এমভি ভাইরিস্তা জাহাজের এক্সক্লুসিভ এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা পাওনা রয়েছে। পাওনা টাকা আদায়ের জন্য তিনি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন।
আদালত রায়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম থেকে সাত হাজার টন গম বিক্রি করে আবদুল আজিজের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি গুদামে গিয়ে দেখেন আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পুরো ৩৩ হাজার টন গম বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
আবদুল আজিজের অভিযোগ করেন, এই শতকোটি টাকার গম আত্মসাতের মূল হোতা আখতারুজ্জামান খান মামুন। তিনি নিজেকে খাদ্যমন্ত্রীর আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দেন।
এ বিষয়ে জে কে শিপিং লাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের লিখিত নির্দেশে তাঁরা গম বিক্রির অর্থ প্রধান এজেন্ট মামুনের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দেন।
কামরুল ইসলাম আরো জানান, আবদুল আজিজের করা মামলাটি স্থগিত রয়েছে। মামুন ও সাইফুলের কাছে গম বিক্রির টাকা পাওনা রয়েছে। ওই টাকা পাওয়া গেলে আবদুল আজিজের টাকা পরিশোধ করা যেতে পারে।
এদিকে, ওই গমের একজন ক্রেতা রোকেয়া অটোমেটিক ফ্লাওয়ার মিলের মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা ওই গম কিনেছিলেন। কিন্তু জানতেন না গম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি করা হয়েছিল। তিনি গমের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করেছিলেন বলে জানান।
এ বিষয়ে কথা বলতে মামলার আসামি আখতারুজ্জামান মামুনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁর তিনটি ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। তবে মামলার আরেক আসামি কামরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে মামুন দেশের বাইরে রয়েছেন।
আজ শুক্রবার চট্টগ্রাম বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে আদালতের কোনো আদেশ পাননি তিনি। আদালত আদেশ দিলে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।