‘গণধর্ষণের পর আত্মহত্যা’, পান্নার মরদেহ মমেকে
নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা গ্রামের কিশোরী পান্না আক্তারের মরদেহ পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের (মমেক) ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে পান্নার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ৫ সেপ্টেম্বর তাকে দাফন করা হয়।
সিভিল সার্জন মো. তাজুল ইসলাম খান বলেন, পুনরায় ময়নাতদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত না করে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে পান্না আক্তারের লাশটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়।
এর আগে গতকাল দুপুরে আদালতের নিদেশে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য পান্নার মরদেহ কবর থেকে তোলা হয়।
সিভিল সার্জন আরো জানান, প্রথমবার করা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে কী আছে তা আগামী রোববার জানা যাবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের (আরএমও) আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে তাৎক্ষণিক বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্থানীয় কয়েকজন ও নিহত কিশোরীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরী পান্না আক্তার ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করে। পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করতে গত ৩১ আগস্ট ঠাকুরাকোনা গ্রামের বাড়িতে যায় পান্না। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনসংলগ্ন একটি ঘরে মা-বাবার সঙ্গে থাকত সে। ঈদের পরের দিন ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গ্রামের যুবক মামুন কাজের কথা বলে পান্নাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যান। রাত হয়ে গেলেও ফিরে না আসায় মা আলপনা মেয়েকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। রাত ৮টার দিকে এলাকায় মাছের খামারের একটি ঘর থেকে মামুন, ছাত্রলীগ নেতা কৌশিক সরকার অপু ও সুলতানের কাছ থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করেন তিনি। এ সময় তাঁর মেয়ে ধর্ষণের কথা জানিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে যুবকরা ঘটনা প্রকাশ না করতে হুমকি দেন। একপর্যায়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে জানাজানি হলে পরের দিন সকালে ঘরের আড়ার সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে পান্না।
খবর পেয়ে নেত্রকোনা মডেল থানার পুলিশ পান্নার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ৫ সেপ্টেম্বর পান্নাকে দাফন করা হয়।
পান্নার মা-বাবা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে নেত্রকোনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির তৈমুর ইলি গণধর্ষণ ধামাচাপা দিতে শুধু অপমৃত্যুর মামলা নেন।
ওসি ময়নাতদন্তের আগেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘পান্না রেপটেপ হয়নি। সে প্রেম সংক্রান্ত অভিমানে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। সুতরাং অপমৃত্যুর মামলা চলবে।’
এদিকে দোষীদের আটক না করায় এবং পুলিশের ভূমিকায় ফুঁসে ওঠে নেত্রকোনার সর্বস্তরের মানুষ। তারা ধর্ষকদের গ্রেপ্তার এবং ওসিকে প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। এ আন্দোলনে সমাজের অন্তত ১৫টি বিভিন্ন সংগঠন অংশ নেয়। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার (এসপি) জয়দেব চৌধুরীর নির্দেশে রহস্য উদঘাটনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি কিশোরীর পরিবার ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
পরে পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার আটদিনের মধ্যে থানায় গণধর্ষণ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করতে পারেন কিশোরীর মা আলপনা। প্রত্যাহার করা হয় অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাক আহমেদকে। আর গণধর্ষণ মামলার একদিন যেতে না যেতেই তিন আসামির দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন ঠাকুরাকোনা গ্রামের মামুন আকন্দ ও ছাত্রলীগ নেতা কৌশিক সরকার অপু। পরে গত বুধবার বিকেলে তাঁরা ধর্ষণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
পান্নার মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নেত্রকোনা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ নূর-এ-আলম জানান, প্রথমে লাশ উদ্ধারের পর হত্যা না আত্মহত্যা জানতে চেয়ে ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন এখনো আসেনি। মামলার আরেক আসামি সুলতান পলাতক রয়েছেন। তাঁকে ধরতে অভিযান চলছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা।